১২/৮/২০২৪- আমি এখন রীতিমত ভয় পাচ্ছি

আমি এখন রীতিমত ভয় পাচ্ছি আগামীদিন গুলিকে নিয়ে। কেনো আমি ভয় পাচ্ছি?

একটা ভূমিকম্পের পর আরো একটা ভূমিকম্প নাকি হবার সম্ভাবনা থাকে। একটা বিপ্লবের পরেও আরো অনেক প্রকারের প্রতি-বিপ্লব ঘটে যায়। সেই প্রতিবিপ্লবের কি নমুনা সেটা বিপ্লব থেকে বিপ্লবে তফাত হয়। এবারের বিপ্লবটা হবার দরকার ছিলো, মানুষের বাকস্বাধীনতা, ভোটাধীকার, ন্যয্য বিচারের আকাল, আইনী শাসনের ক্ষরা, নির্যাতন, নিপীড়ন, বৈষম্যমুলক, পক্ষপাতিত্ব, ব্যবসা বানিজ্যে নৈরাজ্য, আমলাতন্ত্রের কষাঘাতে যে কাজগুলি সহজেই করা যেতো খুব সহজে সেগুলি মানুষকে করতে হয়েছে অনেক ঘুষ বানিজ্য আর তদবীরের মাধ্যমে। যার টাকা ছিলো সে সহজেই পার পেয়ে গেছে, আর যাদের টাকা নাই, তারা মেনে নেয়া ছাড়া কোন গতিই ছিলো না। কোথায় অনিয়ম ছিলো না? সব জায়গায় অনিয়ম, পুলিশ ডিপার্ট্মেন্ট, আমলাদের অফিস, এমনকি, যে অফিসটা অনিয়ম ধরার কথা –“দুদক” সেটাও আর ন্যায় করা শিখলো না। মানুশের দম প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। এমন একটা পরিস্থিতি থেকে মানুষের পরিত্রান পাওয়া কল্পনার অতীত ছিলো বলেই মানুষ ধীরে ধীরে এমন একটা দাসত্বে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছিলো যে, মেনে না নিলেও মানিয়ে চলার অভ্যাস করতে হয়েছে। তরুন সমাজের এই সাহসিক পদক্ষেপে শেষ পর্যন্ত মানুষ যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো। বাচলো কিনা আমি এখনই সাহস করে কনফিডেন্সের সাথে বলতে পারবো না। কারন রাষ্ট্রকে পুরুপুরি সংস্কার দরকার এখন।

কিন্তু আমার যে জায়গায়টায় এখন ভয় করছে তা হচ্ছে-একটা গোটা রাষ্ট্র কি ওভারনাইট রিফর্ম করা সম্ভব? এটা কি এমন যে, গোটা হাজার কিছু লোক পালটে দিয়ে একেবারে সাদা সিস্টেমে আসা যায়? একটা দেশ যেখানে যুগের পর যুগ আপাদমস্তক দূর্নিতি, বেয়াইনি কার্যকলাপ এবং বৈষম্যমুলক সিস্টেমে অভ্যস্থ, সেখানে কি আসলেই হাজার হাজার মানুষ পরিবর্তন করে একটা দেশকে সংস্কার করা ওভারনাইট সম্ভব? আমার কাছে এটা সম্ভবপর মনে হয় না। রিফর্মেশনের জন্য একটা বিস্তর সময়ের দরকার। বলসেভিক রিভ্যলিউশন, ইরান অভ্যত্থান, এমন কি দক্ষিন আফ্রিকার কমলা অভ্যুত্থানও সে কথা বলে যে, রিফর্মেশনের জন্য বিস্তর সময় দরকার। এখন যেহেতু ভূরাজনৈতিক আচরন একেবারেই ভিন্ন, ফলে এখন রিফর্মেশন আরো কঠিন ব্যাপার।

বর্তমানে এদেশে জনগোষ্ঠি আছে প্রায় ১৭ কোটি প্লাস। গত ১৫/২০ বছর আগে জে মানুষটার বয়স ছিলো ১০ কিংবা ১২, তার এখন বয়স ২৫ থেকে ২৭। এই জনগোষ্টীটাই কিন্তু এখন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে, প্রশাসনে, বিচার বিভাগে কিংবা অন্যান্য স্তরে মুল উদিয়মান শক্তি। এই বিশাল জনগোষ্টী যাদের অধীনে যেই স্তরেই হোক কর্মরত ছিলো তারা কনো না কোন ভাবে কম হোক আর বেশি সুবিধাভোগীতেই ছিলো। ঢালাওভাবে বলছি না জে সবাই লিপ্ত ছিল কিন্তু নিজে কিছু লিপ্ত না থাকলেও হয়তো বঞ্চিত ছিলো। তারমধ্যে রাগ ছিলো হয় সিস্টেমের কারনে অথবা নিজে কিছু করতে না পারার সুযোগে। আমি সেনাবাহিনীর চাকুরী সেচ্ছায় ত্যাগ করে ব্যবসা করছি প্রায় ২০ বছরের অধিক সময়। আমি আজ কোথাও দেখি নাই আমার কোনো ন্যায্য কাজ করতে কাউকে কম আর বেশী খুশি না করতে। কেউ হয়তো ঘুষ নিতো না এটা অন্যায় হবে বলে কিন্তু গিফট নিতে অসুবিধা ছিলো না। এভাবেই তো চলে এসছিলো সমস্ত সিস্টেমটা। তাদের বাড়িতে তাদের ইনকামের বেশী খরচ যোগাতে হতো এবং সেটা কোথা থেকে আসতো? তখন তাদের পরিবারের মানুষেরাও কিন্তু কখনো প্রশ্ন করতো না। এর মানে পরিবারের মুটামুটি সবাই দুর্নীতির মেন্টালিটিতেই বড় হয়েছেন। যারা একেবারেই সাদা ছিলেন, তাদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম অথবা তারা হয়তো পূর্বে থেকেই সল্ভেন্ট। আজকে যারা দৃশ্যমান কালো টাকার পাহাড়ের মালিক, এদের বাইরেও প্রায় বেশিরভাগ জনগোষ্টি কালো মনের মালিক। একটা সি এন জি ওয়ালাও বাগে পেলে বেশি দাম হাকিয়ে বেশি রোজগার করে নিতো, একটা শব্জীওয়ালাও পারলে ক্যামিকেল দিয়ে মানুষকে ঠকাতো, একজন মুরগীওয়ালাও মরা মুরগী খাওয়াতে কোনো দ্বিধা করতো না। ফলে উপরের থেকে গোটা লাখ খানেক করাপ্টেড মানুষকে ছাটাই করে যাদেরকে আবার এই টপ লেবেলে আনবেন, তারাও ত সঠিকভাবে বেড়ে উঠেন নাই। তারা হয়তো সুযোগটা কম পেয়েছেন বলে সবার চোখে পড়েন নাই। ফলে গোটা সিস্টেমটাকে রিফর্ম করতে প্রয়োজন একটা ফ্রেস জাতী। হ্যা, কিছু কঠিন আইনের মাধ্যমে আর মনিটরিং এর মাধ্যমে এই দূর্নীতিটা হয়তো কমানো সম্ভব কিন্তু তারপরেও এটা চলতেই থাকবে। এখন যেমন দুর্নীতি, ঘুষ বানিজ্য প্রকাশ্যে করলেও কেউ লজ্জা পায় না বরং এটা যেনো “অন্য আয়” বলে চালান যায়, এখন হয়তো সেটা গোপনে হবে। তাই আমি শতভাগ আশাবাদি নই।

এবার আসি অন্য আরেকটি প্রসংগে;

গত ১৫/২০ বছর ধরে এ দেশে যতো বড় বড় প্রকল্প হয়েছে, যারা বড় বড় গ্রুপের মালিক ছিলেন, যারা দেশের চলমান চাহিদা যোগানে একটা সিস্টেমে জড়িত ছিলেন, তারা প্রায় সবাই আওয়ামিলিগের আমলে। হয় তারা সরাসরি আওয়ামীলিগের সাথে রাজনীতি করতেন আর না করলেও তারা কোনো না কোনো ভাবে আওয়ামিপন্থী ছিলেন। তারা দেশের এই চলমান নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র আয়োজনে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় দূর্নিতি করেছেন বটে অথবা নিত্য প্রয়োজনীয় কমোডিটি বেশী দরে সরবরাহ করেছেন বটে কিন্তু একটা চলমান চেইন সিস্টেম গড়ে তুলতে পেরেছেন বা ব্যাপারটা বুঝেন। তারা তাদের সংস্থার মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা করেছেন আবার একই সাথে প্রাইভেট সেক্টরে তাদের সংস্থার ইনভেস্টমেন্ট যা করেছেন তা কিন্তু খুব চালাকি করে তাদের নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট ইতিমধ্যে তুলেও নিয়েছেন। যেটুকু ইনভেস্টমেন্ট এখন আছে এসব প্রকল্পে বা সংস্থায়, তা আসলে ব্যাংক ঋণ বা বৈদেশিক ঋণ যা জনগনের বা দেশের বোঝা। ইনভেস্টরদের কোনো ইনভেস্টমেন্ট সত্যিকার অর্থে নাই আর। ফলে তাদের এসব মেঘা প্রকল্প, কোম্পানি কিংবা সংস্থা চলমান থাকলেই বা কি আর পুড়ে নষ্ট হলেই বা কি, তাদের কিছুই যায় আসেনা। তারা ক্ষতিগ্রস্থ নন।

ধরুন, এই প্রকল্পগুলি আর চলমান থাকলো না, ঔষধ কোম্পানী, পেট্রোলিয়াম জাতিয় দ্রব্যাদি আমদানি, নির্মান সামগ্রী তৈরীর কোম্পানী হোক সেটা সিমেন্ট, হোক সেটা টাইলস কিংবা অন্যান্য, কিংবা ভোজ্য তেল ইত্যাদি আর এসব আমদানিকারক কোম্পানিগুলি এলসি করে কোনো দ্রব্যাদি আমদানির জন্য কোনো পদক্ষেপ নিবেন না। ফলে বর্তমানে যে স্টক আছে সেটা দিয়ে হয়তো বেশ কিছুদিন চলা কোন ব্যাপার না। কিন্তু একটা সময়ে তো এর ঘাটতি দেখা দিবেই যদি পাইপ লাইনে তাদের পুনরায় এসব কমোডিটি না আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়। সরকার কখনো ডাইরেক্ট কোনো কমোডিটি আমদানী করেন না বা রফতানী করেন না। সরকার এসব আমদানি রফতানী কারো না কারো মাধ্যমেই পরিচালনা করে। ফলে বর্তমানে দূর্নিতিবাজ এই সব মালিকের দ্বারা পরিচালিত কোম্পানিগুলির মাধ্যমে যখন একযুগে সব পাইপ লাইনের আমদানি রফতানি বন্দ হয়ে যাবে তখন হটাত করে এর ঘাটতি বাজারে দেখা যাবে। আবার এর নতুন প্রতিস্থাপক কোম্পানি পাওয়া এতো অল্প সময়ে কিছুতেই সম্ভব না। ফলে দ্রুতই একটা সমস্যার উদ্ভব হবে বা হতে পারে। এর কারনে প্রত্যাহিক জীবনে একটা বিরূপ প্রভাব তো আশংকা করাই যায়। ঘরে টাকা আছে কিন্তু বাজারে কমোডিটি সরবরাহ কম, একটা প্রতিযোগিতা চলবে কে কখন নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল মজুত করে নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত করবেন। নেগেটিভ একটা প্রভাব পড়তেই পারে। 

আমাদের পার্শবর্তী দেশ ইন্ডিয়া এখন আর আগের মতো আমাদেরকে সবকিছুতেই প্রয়োজনীয় রফতানি করবে কিনা সেটা ভাবার বিষয়। আবার নতুন কোন দেশ থেকে একই প্রডাক্ট আমদানি করতে বা নতুন সাপ্লাই চেইন তৈরীতে যে সময়টা ব্যয় হবে সেটাও একটা ব্যাপার। সেখানে আমদানিকারকের সিআইবি, দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা, ব্যক্তি ইমেজ অনেক কিছুই নির্ভর করে। কিন্তু এর মানে এই না যে, এটা সম্ভব না। সম্ভব তবে সময়টা বেশি লাগবে। এই জে সময় বেশী লাগবে, এই গ্যাপেই দেশে একটা উত্তাল পরিস্থিতি হবার সম্ভাবনা থাকবে।

এই যে একটা টাইম গ্যাপ, এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মানে বেশ কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হবার সম্ভাবনা। তাতে আবার সাধারন মানুষের মৌলিক চাহিদার অভাবের কারনে সাধারন জনগন হয়তো ফুসে উঠতে পারে। সেটাও একটা প্রতি-বিপ্লবের মতো। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিপ্লব।

আরেকটা ভয় হয় যে, আমাদের বর্তমান ইন্টেরিম সরকারের মধ্যে এখনো নিজেদের মধ্যেই পারষ্পরিক বন্ডেজ তৈরী হয়নি। সবাই বেশীমাত্রায় সতর্ক। কেউ রিস্ক নিয়ে কাজ করবেন না। ফলে পুর্বে কিভাবে কাজ করা হত এই সাজেশন যখন আমলাদের কাছ থেকে নিতে চাইবেন,  কিন্তা তারা এখন নিজেদের থেকে উপজাজক হয়ে কোনো বুদ্ধি ছাড় করবেন না কিনা সন্দেহ।  ফলে উপজাজক হয়ে তারা বাড়তি কোন পদক্ষেপ নিতে যাবেন না। এতে কাজের গতি অনেক ধীর হবে।

নতুন সরকার রাজনীতিতে খুবই অনভিজ্ঞ, তাদের হয়তো অনেক অভিজ্ঞতা আছে প্রাইভেট সেক্টরে, তারা হয়তো অনেক জ্ঞানিগুনিজন সেসব সেক্টরে। কিন্তু তারা (বর্তমান উপদেষ্টারা) যে চেয়ারগুলিতে বসে আছেন, সেটা একেবারেই রাজনৈতিক চেয়ার। এখানে জনগনের চাহিদার সাথে চেয়ারের সক্ষমতার ব্যালেন্সের একটা ব্যাপার। পলিটিক্যাল অফিস বা চেয়ারের বসে যদি পলিটিক্যাল ম্যাচিউরিটি, ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকে তাহলে এটা হ্যান্ডেল করা সম্ভব না বা খুবই কঠিন। এই চেয়ারগুলিতে কাউকে চা খাইয়ে, কাউকে কিছু ভালো কথা বলে আসলে যাকে যেটা দিয়ে বুঝ দিয়ে ম্যানেজ করার ব্যাপার। অনেক অপ্রতুল রিসোর্স বিশাল জন গোষ্টীর মধ্যে ম্যানেজ করাই অনেক সময় রাজনীতিবিদরা সহজে ম্যানেজ করতে পারেন যা ব্যুরুক্রেটরা করতে পারেন না।

ফলে একটা অসস্থিতে ভোগছি। একদিকে দ্রুত সংস্কার দরকার, অন্যদিকে সবকিছু ব্যালেন্স দরকার। সংস্কার করতে অনেক সময় দরকার কারন সব সেক্টরেই ড্রাস্টিক সংস্কার এতো বেশী দরকার যে ইচ্ছে করলেই ওভারনাইট সম্ভব না, আবার বেশি সময় নিলেও অসুবিধা, জনগন মানতে চাইলেই হয়।

এটা আমার নিতান্তই নিজস্ব মন্তব্য।

(মেজর মোহাম্মাদ আখতার হোসেন অবঃ)

মিরপুর,

এটা ফেসবুকে আমি পোষ্ট করেছিলাম। তার ঠিক একদিন পরেই ফেসবুক আমার এই পোষ্টটা রিমুভ করে দেয়।