গল্পটা কাল্পনিক নয়। গল্পটা সত্যি। আর এখানে যাদের নামগুলি উল্লেখ করা হয়েছে, তারা তাদের নিজের নামেই রয়েছেন। অনেক অজানা কষ্ট আর বেদনা দিয়ে এই পৃথিবী এতোই ভরপুর যে, সবাই এক নাগাড়ে সবার কষ্টের কথা, বেদনার কথা, সাফল্য আর ব্যর্থতার কথা বলতে গেলে সারা পৃথিবীতে শুধু কান্নার রোলই পড়ে যাবে। তারপরেও মানুষ বেচে থাকে আশা নিয়ে, হতাশাকে দূর করে কিছু আনন্দ আর হাসি নিয়ে। এরই নাম জীবন। কেউ হেরে যায়, কেউ পড়ে যায়, কেউবা আবার পরতে পরতে দাঁড়িয়ে যায়। আজ থেকে অনেক জেনারেশন পর সেসব মানুষগুলি হয়তো জানবেই না, কি ছিলো তাদের সেই কষ্টে ভরা তাদের অতীতের পূর্বসুরীদের জীবন, কিংবা কিভাবে আজ তার এই পর্বে আসা। আজকে এই ঘটনার মানুষগুলিকে সেই চরাই উতরাই পার করে সেই সব পূর্বসুরীরা নতুন প্রজন্মের জন্য নব পরিস্থিতি তৈরী করে গেছে। আজকের গল্পের মানুষ গুলিকে এই পর্বে আসতে অন্তত চারটি জেনারেশন পার করতে হয়েছে। এর মধ্যে ১ম জেনারেশনের কেহই জীবিত নেই, ২য় জেনারেশনের অনেকেই গত হয়েছেন, কেউ কেউ এখনো জীবিত আছেন বটে কিন্তু বয়স অনেক হয়ে গেছে তাদের। ৩য় জেনারেশনের এখন পড়ন্ত বিকেলের মতোই। আর ৪র্থ জেনারেশন তারা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, আর সবেমাত্র তাদের মধ্যে একটা সমন্নয় হলো। এবার দেখার বিষয় পরের প্রজন্মের কাহিনী। হয়তো অন্য কেউ লিখবে তার পরের প্রজন্মের ইতিহাস, এমনো হতে পারে, থাক...।
হামিদা খাতুন আমার মা, বিল্লাল ভাই (বেলায়েত ভাই ) আমার সেই ভাই। বহুদিন একই গ্রামের কাছাকাছি ছিলাম, মাঝে মাঝে এক সাথে দুজনে সিগারেট টানতাম। অতীতের অনেক গল্প শুনতাম। কখনো সেই গল্পে ছিলো হাসি, কখনো ভেজা চোখ আবার কখনো নিগুড় কালো রাতের মতো অন্ধকারের ভীতি সঞ্চারী অনুভুতি। বিল্লাল ভাই মারা গিয়েছেন অনেক বছর আগে। তার সন্তানদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো, এখনো আছে তবে খুব ঘন ঘন নয়। কারন তাদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে গেছে। বিল্লাল ভাইয়ের স্ত্রী এখনো জীবিত আছেন। তিনিই বা কতটুকু গল্পগুলি জানেন তা আমার জানা নাই। তবে তিনিএখন সার্থক স্ত্রীর মতো সার্থক মাও। তার সন্তান সেলিম বর্তমানে নেভাদায় থাকে। আমার ছোট মেয়ে কনিকা আমেরিকায় যাওয়ার সুবাদে এই প্রথম সেলিমদের এবং তার সনাত্নদের সাথে প্রথম দেখা হলো। এরা ৪র্থ জেনারেশন। আমার ফার্ষ্ট নাতি ওরা। আমার মা আজ বেচে থাকলে আর আমার ভাই বিল্লাল ভাই বেচে থাকলে বড্ড খুশী হতেন। জীবন কত বিচিত্র। কোথাও না কোথাও গিয়ে এর রুট মিলিত হয়ই।
“কিছু কথা আছে যা বলতে চাই নাই কিন্তু বলা হয়ে যায়, কিছু কথা ছিলো, বলতে চেয়েছি, অথচ বলা যায় নাই, কিছু সপ্ন ছিলো যা দেখতেই চাই নাই কিন্তু দেখতে হয়েছে আবার কিছু এমন সপ্ন ছিলো সব সময় দেখতে চেয়েছি কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় নাই। এমন কিছু শখ ছিলো সারাজীবন লালন করেছি কিন্তু জীবনের শেষ তীরে এসেও সেটা ধরা দেয় নাই আবার এমন কিছু ভয় ছিলো যা একেবারেই কাম্য নয় অথচ তা আমি এড়িয়েই যেতে পারিনি। কী কারনে আবার এই কিছু কথা না বলতে চেয়েও বলতে হয়েছে, কিছু সপ্ন আমাকে দেখতেই হয়েছিলো অথচ সেটা আমার কাম্য ছিলো না, আবার কিছু স্বপনের ধারে কাছেও আমি যেতে পারিনি। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। আমি এই আফসোসের ব্যাপারটা নিয়ে বহুবার গবেষনা করেছি। কিন্তু জীবনের কাছে রাখা সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। ফলে কোনোই আমি সেইসব প্রশ্নের উত্তর পাই নি, না আমার কাছে, না যাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া দরকার ছিলো তাদের কাছ থেকে। আর উত্তর না পেতে পেতে একসময় আমি কোনো উত্তরের আর আশাও করিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে শতভাগ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, আমার এই অপারগতার কারন না আমি নিজে, না আমার সাথে যারা জড়িত ছিলো তারা। না এটা আমার দোষ, না ছিলো তাদের। আমি যদি আরো গভীরে গিয়ে এর আনুবীক্ষনিক পর্যালোচনা করি, তাহলে হয়তো আমার আরেকটা আফসোসের কথা প্রকাশ না করলেই নয় যে, আমার সেই অপারগতা কিংবা ঘাটতির কিছুটা হলেও কেউ না কেউ সহজেই হয়তো পুরন করতে পারতো, যা ‘সেই কেউ’রা হয়তো চেষ্টাই করে নাই।“
উপরের এই কথাগুলি আমার নয়, কথাগুলি একজন এমন মানুষের যাকে আমি আমার মতো করে চিনতে শুরু করেছিলাম আজ থেকে প্রায় ২৪ বছর আগে যখন আমার বয়স প্রায় ২২। কতটুকু আমি তাকে বুঝতে পেরেছিলাম, সেটা আমার জানা নাই, কিন্তু কেনো জানি আমার খুব মায়া হতো, আর এই মায়ায় মাঝে মাঝে আমি নিজেকে তার ভূমিকায় প্রতিস্থাপিত করে দেখতাম কি হয় ভাবাবেগে অথবা মানসপটে। এই সময়টায় আমি খুব ভাবাগেবিত হয়ে যেতাম। ভাবাবেগিত হতাম এটা ভেবে যে, কি পরিমান চাপ কিংবা কষ্ট নিজের বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখা সম্ভব? তখন আরো বেশী মায়া হতো একজনের জন্য নয়, দুজন নিসংগ মানুষের জন্য যাদের উভয়ের বুকেই ছিলো সমান যন্ত্রনা আর ভাগ্যের আক্ষেপ। একজন যেনো পরাজিত, আর অন্যজন সেই পরাজয়ের কারন। এদের একজন আমার “মা” আর আরেকজন ‘বিল্লাল ভাই’ যাকে সবাই ডাঃ বেলায়েত নামেই চিনতো। আমি আজ সেই তাদের কথাই হয়তো বলবো।
আমার ‘মা’র সম্পর্কে আমি অনেকগুলি লেখা ইতিমধ্যে লিখলেও তার সবচেয়ে বড় দূর্বল বিষয়টি আমি কখনো আমার লেখায় আনিনি। আমি জানতাম এবং অনুভব করতাম আমার মায়ের সেই দূর্বলতা। আমার মায়ের এই দূর্বলতা তার নিজের সৃষ্টি যেমন নয়, আবার তিনি ইচ্ছে করলেও তার সেই অপারগতাকে তিনি অনায়াসেই দুহাত দিয়ে এক পাশে সরিয়ে দিতে পারতেন না। এই দূর্বলতা সমাজ সৃষ্টি করেছে, আর সেই সমাজ আজকের দিনের দুটি মানুষকে বিজন বিজন দূরে ঠেলে দিয়ে দুজনকেই অসুখী একটা বলয়ে জীবিত কবর দিয়েছিলো। আমার মায়ের সেই বড় দূর্বলতা ছিলো এই ‘বিল্লাল’ ভাই। পরবর্তিতে প্রায় তিন যুগ পরে যেদিন আমি আমার মায়ের সর্বশেষ ভিডিওটি করি, তখন অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু সে প্রশ্নগুলির উত্তর আমাকে আরো ব্যথিত করে দিয়েছিলো। সেই প্রশ্নের উত্তর আমাকে প্রতিটিবার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিলো, আমার অন্তরের কোথায় যেনো ছট ফট করছিলো কোনো এক অয়াশান্ত অনুভুতিতে। আর যিনি উত্তর দিচ্ছিলেন, আমার মা, তার দ্রিষ্টি কখনো সেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে নির্লিপ্ত হয়ে ভাষাহীন কিছু শব্দ তেই শেষ হচ্ছিলো যার সাহিত্যিক নাম- আহা, কিংবা উহু। এসব বেদনার রাজত্তে যিনি ছিলেন, সে আর কেউ নয়, বিল্লাল ভাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কে এই বিল্লাল ভাই? যদি এর উত্তর খুজতে চাই, তাহলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে বহু বছর আগে যখন আমারও জন্ম হয় নাই। ফলে আমি যা জেনেছি, শুনেছি, তা পুরুই হয় আমার মার কাছ থেকে, কিংবা আমার অগ্রজ ডঃ হাবীবুল্লাহর কাছে বা স্বয়ং বিল্লাল ভাইয়ের কাছ থেকে জানা কিছু তথ্য। কিন্তু আমার কাছে সব ব্যাপারটাই যেনো মনে হয়েছে, এটা ছিলো একটা ভাগ্য আর সময়ের খেলা।
কেনো ‘ভাগ্য’ আর ‘সময়’ বললাম তারও একটা ব্যাখ্যা আছে। অনেক সময় এমন দেখা যায় যে, “ভাগ্য” আর “সময়” দুটুই কারো জীবনে একসাথে আসে, কিন্তু “ভাগ্য” আর “সময়” ওরা কখনোই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ না। সঠিক ব্যবহারে ভাগ্য পালটাতে পারে বটে কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ভাগ্যও পালটে যায়। কিন্তু এই ‘সঠিক’ ব্যবহার আবার সবাই সবসময় হয়তো পায়ই না যাতে সেই সঠিক ব্যবহারে তার ভাগ্য পাল্টাতে পারে। কেউ কেউ পারে, আবার কেউ কেউ পারে না। আবার কারো কার ব্যাপারে সুযোগটাই আসেনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কোনো ব্যক্তিত্ত সময়ের স্রোতে আবার বেশীদিন অসহায়ও থাকে না। একসময় না একসময় সে ঘুরে দাড়ায়ই যদি তার দৈবক্রম ভাগ্য আবার সেই ঈশ্বর কোনো এক যাদুর কাঠিতে হাল ঘুরিয়ে দেন। শুধু হাল ঘুরিয়ে দিলেই হয়তো তার সেই নির্যাতিত ভাগ্য দৈবক্রম ভাগ্য সঠিক নিশানায় পৌছায় না যদি তার চোখে না থাকে সপ্ন আর প্রবল একটা ইচ্ছাশক্তি। আজকের লেখার প্রধান চরিত্র এই ‘বিল্লাল’ ভাইয়ের ব্যাপারেও সেই দুটু শব্দ প্রায় একই সুরে খেটে যায়। ভাগ্য তাকে সুপ্রস্নন করে নাই, আবার করেছেও। ‘সময়’ তাকে একটা বলয় থেকে ছিটকে ফেলেছিলো বটে কিন্তু আবার সেই ‘সময়’টাই বদলে দিয়েছে তার সব জন্মগত বৈশিষ্ট।
বিল্লাল ভাইয়ের এই ইতিহাস নাতিদীর্ঘ নয়। এই ইতিহাস একটা পূর্ন জীবনের। আর সেই জীবনের বয়স কাল নেহায়েত কমও নয়, প্রায় ৫৫ বছর। এই ৫৫ বছরে পৃথিবী তার অক্ষে ৫৫ বার প্রদক্ষিন করে কত যে ঋতু আর কাল প্রশব করেছে তার কোনো হিসাব নাই। তাই বিল্লাল ভাইয়ের এই ইতিহাস বলার আগে সেই মানুষটির ইতিহাস বলা প্রয়োজন যার জন্য আরেক অধ্যা তৈরী হয়েছিলো বিল্লাল ভাইয়ের। আর তিনিই হচ্ছেন- আমার মা, আর জন্মধাত্রী বিল্লাল ভাইয়ের।
আমার মায়ের পুরু নাম ‘মোসাম্মাত হামিদা খাতুন’। নামটা আমি এভাবেই সবসময় লিখে এসেছি আমার ব্যক্তিগত তথ্যাবলীর মধ্যে। আমার মায়েরা ছিলেন দুই বোন এবং তার কোনো ভাই ছিলো না। আমার মায়ের আরেক বোনের নাম ছিলো ‘মোসাম্মাদ সামিদা খাতুন’। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, গ্রাম্য ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ারিশান সার্টিফিকেটে তাদের দুজনের নামই লিখা হয় যথাক্রমে ‘হামিরন নেছা’ এবং ‘ছামিরন নেছা’। যাই হোক, নাম বিভ্রাটের কারনে আজকাল হয়তো ব্যংকে একাউন্ট করতে জটিলতা থাকতে পারে, কিংবা ক্রেডিট কার্ডে ঝামেলা হতে পারে, কিন্তু এই নামের বিভ্রাটের কারনে আমাদের মুল চরিত্রের মানুষ গুলির জীবনের ইতিহাসে কোনো প্রকার ব্যত্যয় হয় নাই। আর আমার এই লেখাতেও এটা অনেক বড় সমস্যা নয়। আমার নানা অর্থাৎ আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো ‘কেরামত আলি’। আজকাল এই নাম গুলি আর কেউ রাখে না। হয়তো ভাবে যে, নাম গুলি আধুনিক নয়। কিন্তু এই নামের মানুষ গুলি ছিলে ভালোবাসার আর ভরষার ভান্ডার। যাই হোক, যদি আরেকটু আগের জেনারেশনে যাই, তাহলে আমরা সেই ‘কেরামত আলি’র বাবার নাম পাবো ‘উম্মেদ আলী মুন্সী’। এই উম্মেদ আলীর বাবা জনাব হাজী আসাদুল্লাহ (পিতা-আহাদুল) এর শাখা প্রশাখা বিশ্লেষন করলে এমন এমন কিছু বর্তমান আত্মীয় সজনের নাম চলে আসবে যা না আমরা অনেকেই মানতে চাইবো, না আমরা তা গ্রহন করবো। তার কারন একটাই-সমাজের স্তরভিত্তিক কেউ এমন জায়গায় আর কেউ এমন স্তরে যা না মিশে বংশে, না মিশ খায় পরিবারে। কিন্তু বাস্তবতাটাই যে অনেক কঠিন এটা মানা আর না মানাতে কিছুই যায় আসে না। না মানার মধ্যে হয়তো থাকতে পারে একটা বড় অহংকার বা সম্পর্ক ছিন্নকারীদের মধ্যে সামিল, কিন্তু বাস্তবতা পালটায় না তাতে। যাই হোক, সেই ৫/৬ জেনারেশন আগে না হয় নাইবা গেলাম।
আমার মায়ের বয়স যখন সবেমাত্র বারো কি তেরো, তখন সমাজের রীতি অনুযায়ী আমার নানা কেরামত আলি বিবাহযোগ্য মেয়ের বোঝায় চাপ অনুভব করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। আজ থেকে সেই প্রায় সত্তর বছর আগে যেটা হয়তো ছিলো সমাজের একটা রীতি, আজ তা বাল্যবিবাহের নামে সমাজ তাকে অপরাধের কারন বলে উল্লেখ করে। যেটাই হোক, সমাজের রীতি অনুযায়ী আমার মা, খালাদের বিয়ে ওই বারো তেরো বছর বয়সেই হয়েছিলো। আমার মায়ের সেই স্বামীর নাম ছিলো আব্দুল জলিল (সম্ভবত)। সম্ভবত বলছি এই কারনে যে, নামটা এই মুহূর্তে সঠিক লিখলাম কিনা সিউর হতে পারছি না। তবে সঠিক হবার সম্ভাবনা ৭৫%। ১২ বছরের একজন প্রায় নাবালিকা বিয়ের পর এখন অন্য বাড়ির বউ হয়ে গেলো। এই নববধূর পড়নের কাপড়টাই হয়তো তার থেকে প্রায় তিন গুন লম্বা, সবে মাত্র হায় প্যান্ট ত্যাগ করা বালিকাটি এখন নাকে নোলক, হাতে মেহেদী সমেত চূড়ি, কানে দূল, আর মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই পরিচিত সব মানুষ গুলি থেকে আলাদা হয়ে অন্য এক সংসারে একটা আলাদা পরিচয় নিয়ে বাপের বাড়ি ছেড়ে গেলো। তার শখের পুতুল, ছেড়া বই কিংবা সখীদের অনেক গোপন কিছু মজার স্মৃতি সব ছেড়ে কেদে কেদে নিজের সেই খেলার আংগিনা, কাথা বালিশ আর বাড়ির উঠোনের মায়া ত্যাগ করে অন্য কোথাও যেতেই হলো। এ যেনো পালের একটা পোষাপ্রানী যে কিনা এখনো তার মায়ের দুগ্ধপানও ছাড়ে নাই। এই বয়সের একজন অপরিপক্ক নাবালিকা কি সংসার করছে বা করেছে সেটা আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনা কিন্তু বিধাতার সিস্টেমে আমার মা গর্ভবতী হলেন। আর সেই গর্ভধারনের পরে সঠিক সময়ে তিনি সুস্থ্য একটি পুত্র সন্তানও দান করেন তার শ্বশুরালয়ে। এই পুত্রটির নামই হচ্ছে- বিল্লাল হোসেন বা বেলায়েত হোসেন। সবকিছুই ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। স্বামী, সংসার, পুত্রযত্ন সবকিছু। নবাগত পুত্র সন্তানের আদরের কোনো কমতি নাই, নব নাম ধারী হামিদা এখন শুধু হামিদাই নয়, সে এখন ‘মা’ও বটে। তার নতুন নাম ’মা’। চারিদিকেই একটা নন্দ যেনো বাতাসের প্রবাহের মতো সারাটা বাড়ি দোলায়িত হচ্ছে, কেউ পুতুল নিয়ে দেখতে আসে, কেউ দোয়া দিতে আসে, কেউবা আবার আসে এম্নিতেই। সব কিছুই ঠিক যেভাবে চলার কথা সেভাবেই চলছিলো। কেরামত আলী তার মেয়ের জন্য গর্বিত, পাড়ার লোকেরাও। কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনা মানুষের পরিকল্পনার থেকে অনেক বেশী যেমন রহস্যময়ী, তেমনি অনেক কঠিনও। তিনি কাকে কি দিয়ে সুখবর দিবেন আর কাকে কি দিয়ে দুঃখের অতল গভীরে নিয়ে যাবেন, তার হিসাব কিংবা ছক আমাদের কারোরই বুঝার কথা নয়। আর সে অধিকার ঈশ্বর কাউকে দেন ও নাই। তিনি একাই খেলেন, একাই গড়েন, আবার একাই ভাঙ্গেন। কেনো গড়েন, কেনো ভাজ্ঞেন এর ব্যাখ্যা চাওয়ারও আমাদের কোনো উপায় নাই। ফলে দেখা যায়, একই খবর কারো কাছে যেমন শুভ হয় আবার কারো কাছে তেমনি অশুভও হয়। একই জায়গায় মিলিত হওয়া মানুষের রাস্তা যেমন তিনি আলাদা আলাদা করে দেন, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় চলাচলকারী অনেক মানুষের রাস্তাও তিনি এক জায়গায় এনে মিলন ঘটান। একই পরিস্থিতিতে যেমন একজন জীবনকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান, আবার সেই একই পরিস্থিতিতে তিনি আরেকজন জীবনকে অসহায় অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করতে ব্যস্ত করে তোলেন। আমার মায়ের বেলাতেও ঠিক এমন একটা পরিস্থিতি হাজির করলেন বিধাতা। আমার মায়ের স্বামী আব্দুল জলিলকে তিনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। যে নাটাইটায় একটা গুড়ি নিজের আনন্দে নীল আকাশের হাওয়ায় ভেসে একবার এদিক, আরেকবার ওদিক দোল খাচ্ছিলো, হটাত নাটাইটা বিচ্ছিন্ন করে দিলো ফানুশের মতো উরে থাকা রংগিন ঘুড়িটা। ছন্দে ভরা কতগুলি জীবন এক সাথে যেনো ছন্দ পতনের ধাক্কায় চারিদিক বেশামাল হয়ে গেলো। আমার মা হামিদা ভয়ে আতংগকে আর বিষন্নতায় বোবা হয়ে গেলেন, হামিদার বাবা কেরামত আলী মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় মুর্ছা যেতে লাগলেন। আর হামিদার সদ্য জন্মানো পুত্র বিল্লাল কিছুই না বুঝে মায়ের দুধের জন্য বিকট চিতকারে বাড়ি, ঘরময় যেনো আলোড়িত করে দিলো। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমার মা হামিদা খাতুন বিধবার তকমা গলায় পড়ে হাহাকার ঘরে যেনো নির্বাক হয়ে গেলেন।
কোনো নারীর অধিকার তার স্বামীর বাড়িতে স্বামীর বর্তমানে যেমন থাকে, সেই নারীর সেই অধিকার স্বামীর অবর্তমানে আর তেমন থাকে না। হামিদার স্বামীর ইন্তেকালের কয়েকদিন পর বাড়ির অন্যান্য সবাই যখন হামিদার স্বামীর শোকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে থাকে, ততোই যেনো হামিদার উপর অন্যান্যদের খোটার ভার বাড়তে থাকে। এই বয়সে স্বামীকে বুঝার আগেই যখন কেউ স্বামী হারা হয়, তার নিজের মনের অবস্থার কথা কেউ তো ভাবেই না, বরং সব দোষ যেনো সেই অপয়া হামিদারই। পৃথিবীর কেউ এই নাবালিকা বিধবার মনের ভিতরের কষ্ট কিংবা বেদনার অনুভুতি না বুঝলেও হামিদার বাবা কেরামত আলী ঠিক বুঝতে পারছিলেন কি চলছিলো হামিদার ভিতরে। তিনি কোনো কিছুই চিন্তা না করে দুই অবুঝ, এক হামিদা এবং তার পুত্রকে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাড়িতে। হামিদা এখন আবার তার পিত্রালয়ে সেই চেনা পরিবেশে ফিরে এলো। আজকের এই চেনা পরিবেশ যেনো আর আগের সেই পরিবেশ নাই, তার খেলার অনেক সাথীরাই অন্যের বধু। এখন আর দলবেধে কাউকে নিয়ে সেই চেনা পরিচিত নদীতে হৈ হুল্লুর করে জল্কেলীর কোনো সুযোগ নাই। কোথায় যেনো বীনার তার গুলি ছিড়ে গেছে। আর সাথে তো আছেই পুত্র বিল্লাল, যার কাছে দাদা বাড়িই কি, আর নানা বাড়িই কি কোনো কিছুরই কোনো পার্থক্য নাই। শুধু মনের অজান্তে চোখের পানি ঝরছে হামিদার আর তার সাথে অসহায় বিধবা কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা কেরামত আলির। জখম যেনো কিছুতেই ক্ষরন বন্ধের নয়।
শরীরের কোনো কাটাছেড়া, কোনো বাহ্যিক জখম হয়তো চোখে দেখা যায়, ক্ষুধা হলে খাবারের অভাবে ক্ষুধায় হয়তো পেট গুরগুর করে, কিংবা জ্বর সর্দি, কাশি কিংবা মাথা ব্যথা হলে তার সিম্পটম অনায়াসেই বুঝা যায় কিন্তু অন্তরের জখম কি কখনো চোখে পড়ে? অন্তরে কি কখনো জখম হয় আদৌ? আর এই অন্তরটাই বা শরীরের কোন অংগ? এটা কি এমন কোনো জিনিষ যা মাংশ বা হাড় কিংবা এমন কিছু দিয়ে এর গঠন কাঠামো? অথচ এই জখম অনুভুত হয়, এই কষ্ট নিজেকে প্রতিটি ক্ষনে মনকে বিষন্ন করে দেয়। সেই অদেখা অন্তরে রক্তক্ষরন হয়। এই অন্তর্জালা, রক্তক্ষরন আর কষ্টে মাত্র ১৪/১৫ বছর বয়সের এই অবুঝ বালিকা আরেকটি সদ্যজাত নবাগতকে নিয়ে পৃথিবীর সব মানুষের চোখে যেনো একজন অপরাধি সেজে জীবিত অবস্থায় মৃত হয়ে রইলেন। স্বামীর ম্রিত্যু যেনো তারই অপরাধ। তার এই ঘটনার জন্য যেনো তিনিই দায়ী। একদিকে অবুঝ মন, অন্যদিকে সাথে আরেকটি অবুঝ সন্তান, সব মিলিয়ে চারিদিকে এক মহাশুন্যতা। মেয়ের এমন একটি দুঃসহ শুন্যতা নিজে পিতা হয়ে কেরামত আলী কি করবেন? দিন গড়ায়, রাত যায়, শুন্যতা আরো চেপে বসে হামিদার। তার যে বয়স, সে বয়সে তিনি হয়তো বিয়ের মাহাত্তটাই বুঝে উঠতে পারেন নাই, কিন্তু তাকে এখন বিধমার তকমাটাও বুঝতে হচ্ছে, বুঝতে হচ্ছে একজন অবুঝ সন্তানের মা হিসাবে তার অকাল পরিপক্ক দায়িত্ব।
যখন কোনো মানুষের দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, তাহলে সে সবসময়ই চাইবে যে, সে অন্য কারো সাথে তার এই দুঃখটা, কষ্টটা শেয়ার করতে। কেউ তো থাকবে যে, ওর কথা শুনবে। বুঝুক না বুঝুক সেটা আলাদা ব্যাপার, কষ্ট লাগব করুক বা না করুক সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কারো সাথে তো তার এই কষ্টের ব্যাপারগুলি শেয়ার করা দরকার। আর হামিদার এই কষ্টের ভাগীদার কিংবা শ্রোতা হয়ে রইলো শুধু একজন-সেই নাবালক পুত্র ‘বিল্লাল’। চোখ ভিজে আসে তার, মন ভেংগে আসে যন্ত্রনায়, আর মনে হয়-কেনো? কেনো বিধাতা তাকেই এর অংশ করলেন? অন্য কেউ নয় কেনো? সেই অবুঝ পুত্র বিল্লালের কাছে ‘হামিদা’র হয়তো শুধুই একটা জিজ্ঞাসা। নাবালক বিল্লাল হয়তো এর কিছুই বুঝে না, কোনো এক ভিনদেশী ভাষায় হয়তো কিছুক্ষন অদ্ভুত শব্দ করলেও মায়ের সেই কান্নায় ভীত হয়ে নিজের অজান্তেই কেদে দেয় বিকট এক শব্দে যা হয়তো বিধাতার কাছেই তার মায়ের কষ্টের ফরিয়াদ। হয়তো মা ছেলের এই অসহায় কান্নায় বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের চোখের জলে কাপা কাপা গলায় বলতে থাকেন- আমি তো আছি তোর পাশে। ভয় নাই। মা আছে। পৃথিবীর কেউ তোর পাশে থাকুক বা না থাকুক, আমি তো আছি। এভাবেই কাটতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এবং এক সময় কয়েক বছর।
জীবন যেখানে যেমন। যে শিশুটি আজ জন্ম নিলো কেউ জানে না তার জন্য এই পৃথিবী কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা এই প্রিথিবীকে সে কি দিয়ে যাবে। বিধাতা চাইলে যে কোনো কিছুই হতে পারে। হতে পারে আজকে এই শিশুটি হয়তো এই পৃথিবীকে কোনো একসময় কাপিয়েও যেমন দিতে পারে আবার এই পৃথিবী তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। এই বিশ্বভ্রমান্ডে এমন অনেক শিশুই জন্ম নেয় যারা অনেকেই অনেক ভুমিকা রাখে আবার কেউ কেউ কিছুই রাখে না, না পৃথিবীও তাদেরকে মনে রাখে। এমন মানুষের সংখ্যাই হয়তো নেহায়েত যেমন কম না, তেমনি ভুমিকা রাখে এমন শিশুও কম না। যুগে যুগে তারপরেও অনেক শিশু গোপনে পৃথিবীতে আসে, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর একদিন সবকিছু ফেলে সবার থেকে আলাদা হয়ে আবার কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝখানের এই সময়টায় খুব গুটিকতক মানুষ হয়তো নিজের মতো করে কাউকে কাউকে মনে রাখে কিন্তু তাও একসময় মনের স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। কিন্তু ‘বিল্লালের বেলাতে এটা ঘটে নাই। তিনি প্রকাশ্যে দিবালোকে এই সমাজে বৈধভাবে পদার্পন করেছিলেন, তার যোগ্য অভিভাবক ছিলো, তার পরিচয় ছিলো, আর ছিলো পাশে থাকা অনেক মানুষ যারা তাকে নিয়ে ভেবেছে, তার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করেছে। কিন্তু বিধাতা তো আর মানুষের মত নন। তার পরিকল্পনা, তার ইচ্ছা, তার কার্যকারিতা সবকিছুই তার মত। বিল্লালের যখন মাত্র দুই থেকে হয়তো একটু বেশী, তখন হামিদাকে ছাড়তে হলো তারই ঔরসে জন্ম নেয়া তার পুত্র বিল্লালকে। সমাজ বড্ড বেরসিক, সমাজের আইনকানুনগুলিও একপেশে। এই আইন মানতে গিয়ে কে কাকে ছেড়ে যাবে, আর কার জীবন কোন আইনের পদাঘাতে পিষ্ঠ হবে সেটা যেনো সমাজের কোনো দায়বদ্ধতা নাই। আর এর সবচেয়ে বেশী আহত হয় সমাজের নারীরা। নারী বা মহিলাদেরকে এই সমাজে সেই প্রাচীনকালের মতো আজো দেবীর সমান তুলনা করে থাকে কিন্তু আফসোস যে, এটা শুধু মন্দির আর পুজার ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মহিলাদের সাথে আজো লাগাতার অন্যায়, নীপিড়ন, শোষন, অধিকারহীনতা আর অপরাধ ঘটে যাওয়া এটাই প্রমান করে যে, আমাদের সমাজে আমরা যে মহিলাদেরকে দেবী বলি তারা এখনো অনেক দানব দ্বারা ঘিরে রয়েছে যারা তাদের জীবনকে নরক করে তুলেছে। আর এই দানবের প্রথম নাম ‘সমাজ’ আর তার আইন কিংবা ‘মনোভাব’। যে সমাজ ১৩/১৪ বছরের বালিকাকে বিধাতার ইচ্ছায় তারই সংগীকে বিচ্ছেদের কারনে একজন অপয়া কিংবা এই দোষে দোষারুপ করা হয়, সেই সমাজ প্রকৃত কোনো ভরষার স্থান হতে পারে না। সে সমাজে প্রকাশ্যে কোনো মহিলাকে পুড়িয়ে মারা, নির্যাতন করা কিংবা ধর্ষন করা হলেও আজো কেউ হয়তো এগিয়েই আসে না। হামিদা হয়তো সে রকমের একটা অদৃশ্য আগুনে প্রতিদিন পুড়ে অংগার হচ্ছিলেন।
সমাজের এই মনোবৃত্তি আর যাতনায় এবং কন্যাদায়গ্রস্থ কেরামত আলি শেষ পর্যন্ত ১৫ বছরের বিধবা হামিদাকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার আয়োজন শুরু করেন। হামিদার রুপের কোনো কমতি ছিলো না, আর সবে মাত্র সে কিশোরী। এক সন্তানের মা হলেও বুঝার কোনো উপায় নাই যে, তার অন্য কোথাও একবার বিয়ে হয়েছিলো। ফলে, খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয় নাই কেরামত আলিকে। পুরুষ শাসিত সমাজে সব আইন পুরুষেরাই তাদের নিজের সুবিধার কারনে বানায়। এখানে ১৫ বছরের কিশোরীর সাথে ৪০ বছরের বৃদ্ধার বিয়েও কোনো দৃষ্টিকটু নয়। কিংবা কোনো এক প্রতাপশালি ধনী ব্যক্তির পক্ষেও একের অধিক কুমারী কিংবা বিধবা কিশোরীকে বিয়ে করাও কোনো দৃষ্টিকটু নয়। আর সেই প্রতাপ শালী কোন ধনী ব্যক্তি যদি সধবা হন, তাহলে তো তার যেনো বিয়ে করা একটা বৈধ লাইসেন্সের মতোই। হামিদার জীবনে এমনই এক সুপুরুষ-হোসেন আলী মাদবর প্রবেশ করলেন। এই হোসেন আলী মাদবর কোনো কাল বিলম্ব না করে অনেক ঘটা করে বিধবা হামিদাকে বধু হিসাবে নিয়ে আসে তারই সংসারে যেখানে রয়েছে হামিদার থেকেও বয়সে বড় আরো তিনটি পুত্র সন্তান আর চারটি কন্যা সন্তান। কেউ কেউ হামিদার থেকে বয়সে এতো বড় যে, কারো কারো আবার বিয়ে হয়ে তাদের ও সন্তান জন্ম নিয়েছে। তবে একটা ভালো সংবাদ হামিদার জন্য ছিলো যে, তাকে সতীনের ঘর করতে হয় নাই। কারন হোসেন আলি মাদবর ছিলেন সধবা। হোসেন আলী মাদবরের আগের স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় বছর খানেক আগে।
হামিদার যখন প্রথম বার বিয়ে হয়েছিলো, তখন সে পিছনে ফেলে গিয়েছিলো তার খেলার সাথী, খেলার পুতুল আর শৈশবের স্মৃতি। কিন্তু এবার হামিদা ফেলে গেলো একজন অবুঝ পুত্র যে জীবনের কোনো কিছুই বুঝে না। হয়তো সে মা কি জিনিষ তাইই বুঝে না আর বিচ্ছেদ কি জিনিষ সেটা তো তার বুঝবারই কথা নয়। বিল্লাল রয়ে গেলো কেরামত আলীর তত্তাবধানে। বিল্লালের বয়স সবেমাত্র তিনও পূর্ন হয় নাই। এখন বিল্লাল পুরুই অনাথ, শুধু তার চারিপাশে রইলো কেরামত আলী, আর তার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু এই অনাথ ‘বিল্লাল’ নামক পুত্রের এখন কি হবে? সে তো আগেই তার পিতাকে হারিয়েছে, আর আজ হারালো তার মাকে, যদিও তার মা জীবিত। মায়ের নতুন সংসারে তার জায়গা নেই।
ওই যে বললাম, স্রিষ্টিকর্তা বড়ই রহস্যময়। হামিদার বাড়ির আলুকান্দার কাছেই ছিলো আরেক গ্রাম, তার নাম ঘোষকান্দা। সেখানেই স্রিষ্টিকর্তা আরেক ধনাঢ্য এক পরিবারকে রেখেছেন অতীব মানসিক কষ্টে। তাকে ঈশ্বর সম্পদের পাহাড় দিয়েছেন, তাকে সুসাস্থ্য দিয়েছেন, আর দিয়েছেন সমাজে প্রতিপত্তিদের মধ্যে সম্মান আর যোগ্যস্থান। কিন্তু তাকে ঈশ্বর যা দেন নাই সেটা হলো কোনো উত্তরাধীকারী। সন্তানহীনা অবস্থায় মানসিকভাবে এই দম্পতি এতোটাই কষ্টে ছিলেন যে, তাদের না আছে কোনো সন্তানসন্ততী, না আছে কোনো উত্তরসুরী। এই ধনাঢ্য পরিবারের হর্তাকর্তার নাম ‘ইদ্রিস আলী’। তিনি কিংবা তার স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন কিনা কেউ জানে না, কিন্তু ঈশ্বর হয়তো অন্য কোনো নেশায় তাদের এই ঘর পরিপূর্ন খালী রেখেছিলেন এমন একজন অসহায় মানবের জন্য যার বিপক্ষে দোষারুপ করার কোনো ওজরের কমতি ছিলো না। তাদের অন্তরে ঈশ্বর সব ভালোবাসা রচিত করেছিলেন ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য, লালিত করেছিলেন এক অদম্য স্পৃহা কিন্তু সেই ভালোবাসা আর স্পৃহা বারংবার শুন্য ঘরেই বাতাসের মধ্যে হারিয়ে যেত সকাল সন্ধ্যায় কিংবা অলস দুপুর কিংবা বর্ষার কোনো ঋতুতে। কষ্ট ছিলো, আখাংকা ছিলো কিন্তু সন্তান লাভ এমন নয় যে, বাজারে গেলেন, দোকান খুজলেন আর পছন্দমত একজন সন্তান কিনে এনে তাকে বড় করতে শুরু করলেন। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে এটা দেখা যায় যে, কারো কাছে কোনো মানুষ হয়তো খুবই অপাংতেয়, বোঝা, উপদ্রব, কেউ হয়তো তার দিকে এক নজর নাও তাকাতে পারে। হতে পারে সেই মানুষটা এক পরিবারের জন্য বোঝা, কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোথাও কেউ হয়তো ওই অপাংতেয় মানুষটির জন্যই অধীর চিত্তে অপেক্ষা করছে কখন তার আগমন ঘটবে। তাকে পাওয়াই যেনো সমস্ত সুখ আর শান্তির উৎস খুজে পাওয়া। ঈশ্বর এই দুটো ঘটনাই পাশাপাশি ঘটাচ্ছিলেন বিল্লালকে কেন্দ্র করে।
হামিদা চলে যাওয়ার পর হামিদা যেমন মনের ভিতরে সন্তান বিচ্ছেদে কাতর ছিলেন, তেমনি হামিদার বাবা কেরামত আলীও এই অবুঝ বালককে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কি করা যায় সেই চিন্তায় কাতর ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেরামত আলী তার ভায়রা গনি মাদবরের সাথে পরামর্শ করে বিল্লালকে পালক দেয়ার কথা চিন্তা করলেন। আর এতেই যেনো ইদ্রিস আলীর পরিবারে নেমে আসে সেই কাংখিত শুভ সংবাদ যিনি তাকে দত্তক নিতে আগ্রহী। কালক্ষেপন না করে ইদ্রিস আলীর পরিবার যেনো সর্গ থেকে নেমে আসা এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান লাভ করে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করলেন আর নিয়ে গেলেন হামিদার বুকের সবচেয়ে আদরের ধন ‘বিল্লাল’কে। হামিদার দ্বিতীয় বিয়ের কারনে হামিদার পুত্র বিল্লালকে ইদ্রিস পরিবার যেনো অযাচিত এক ধনের সন্ধান পেলেন। নিজেদের বংশমর্যাদা আর পিতৃপরিচয়ে বিল্লালকে আগাগোড়া মুড়ে দিলেন ইদ্রিস আলী পরিবার। কোনো কিছুর কমতি রাখলেন না তারা তাদের এই হাতে পাওয়া সন্তানের জন্য। কিন্তু মা তো মা-ই। সমস্ত কাজের ফাকে, নিজের অবসর সময়ে বারবারই তো মনে পড়ে হামিদার সেই নাড়িছেড়া সন্তানের জন্য। কিন্তু কি ক্ষমতা আছে তার? না সে সমাজের বিপক্ষে কিছু করতে পারে, না সে সমাজের আইনকে থোরাই কেয়ার করতে পারে। হতাশাগ্রস্থ নেশাখোরের মত ক্ষনেক্ষনেই মা হামিদা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়তেন বিল্লালের জন্য। কখনো একাই কাদেন, কখনো একাই ভাবেন, আবার কখনবো এইকথা মনে করে শান্তি পান যে, অন্তত তার নাড়িছেড়া ধন কারো জিম্মায় ভালো আছে যারা তার এখন পিতামাতা।
হামিদার নতুন সংসারে সময়ের রেষ ধরে আমাদের জন্ম হতে থাকে একের পর এক সন্তান। আগের স্ত্রীর ঔরসে জন্ম নেয়া পুত্র-কন্যাদের পাশাপাশি হামিদার ঔরসে ক্রমেক্রমে আরো পাচ কন্যা আর দুই পুত্রের আগমন হয়। কেরামত আলী হামিদার নতুন সংসারের যেমন খোজ রাখেন, তেমনি খোজ রাখেন ইদ্রিস আলির পরিবারে দত্তক নেয়া বিল্লালেরও। হামিদা যখন বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে, তখন হামিদার সৌভাগ্য হয় তার ছেলে বিল্লালকে চোখে দেখার। মা ছেলের এই মিলন বড় সুখের বটে কিন্তু বেদনারও। ফিরে যাওয়ার দিন হামিদার চুমু খাওয়া বিল্লাল হয়তো কিছুই বুঝতে পারে না কি কারনে এই মহিলার চোখে জল আসে। বুঝতে পারে না কেনো বিল্লালের মা কিংবা তার বাবা ইদ্রিস আলী এই মহিলার কাছে এতো ঋণী। শুধু এটুকু বুঝতে পারে মহিলাটা এমন কেউ যাকে পেলে বিল্লালও খুশী হয়। হামিদা বিল্লালকে নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে সুন্দর জামা পড়িয়ে দেয়, আর খুব মিষ্টি করে মাথার চুল আচড়ে দিয়ে কখনো কখনো তার বুকে মাথা রাখতে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। হয়তো এই আদরগুলি বিল্লালকে বারবার মহিলার প্রতি বিল্লালের আকর্ষন বাড়িয়ে দেয়। যেদিন হামিদা আবার তার সংসারে চলে যায়, বিল্লালেরও খুব মন খারাপ হয়। (চলবে)