১৩/০২/২০১৭- ফাল্গুন মাসের মাহাত্য

Categories

ফাল্গুন মাসের কোনো মাহাত্য আমি আজো খুজে পাই নাই। কেনো এই ফাল্গুন মাসবাঙ্গালীর জীবনে অনেক অতিশায়ী আদরের একটা মাস, তাও আমার মনে কখনো জেগে উঠেনাই। ফলে ফাগুনের আগমনে আমার মন কখনো পুলকিত হয়ে জেগে উঠে নাই। কবিদের কথাআলাদা।

বাংলার অন্যান্য মাসের মতোই এই ফাল্গুন মাস আমার কাছে একটাস্বাভাবিক মাসের চেয়ে আর বেশী কিছু নয়। তবে যখন ছোট ছিলাম, বৈশাখ মাসটাকিছুটা হলেও আমার মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতো, কারন এই বৈশাখ মাসেআমাদের গ্রামে মেলা হতো, মেলায় হরেকপদের জিনিসের কেনাবেচা হতো। পকেটে পয়সাথাকুক আর নাই বা থাকুক, দলবেধে অন্তত ঐ মেলায় গিয়ে কিছুটা সময় হলেও আনন্দকরতে পারতাম। অন্যদিকে কালবৈশাখী ঝড়ের কারনেও মাঝে মাঝে কালো আকাশের চেহারাদেখে নিজে আতংকিত না হলেও বড়দের চোখে ঝড়ের আতংক দেখে ভয় পেতাম। কখনো কখনোঝরের তান্ডবলীলায় কচিকচি আম কুড়াবার যে একটা হিরিক পরতো সেটা একেবারেনেহায়েত মন্দ না। হয়ত এইসব কারনেই বৈশাখ মাসটি আমার কাছে ফাল্গুনের থেকেওবেশি মনে পড়ে।

বর্ষাকালও ফাল্গুন মাসের থেকে আমার জীবনে অনেক বেশীমনে রাখার মতো অনেক কারন ছিলো। আমাদের নৌকা ছিলো না, স্কুলে যেতে হতো হাটুপানি ভেঙ্গে। কখনো কখনো পলিথিনের ভিতরে বইপত্র ঢোকিয়ে বৃষ্টির মধ্যে একগাদাকচিকচি পোলাপান মাইল কে মাইল ভিজে স্কুলে যেতে হতো। কখনো কখনো তুমুলবৃষ্টির মধ্যে নাড়ার আটি দিয়ে পেচিয়ে নকল ফুটবল বানিয়ে ইচ্ছেমতো ফুটবলখেলতাম। বকা খেয়েছি বড়দের, শাসন করেছে বারংবার এই বৃষ্টিতে ভিজে খেলার জন্যকিন্তু কে শুনে কার কথা। আর শীতকালের কথা তো সব সময়ই মনে পড়ে। এখনো মনে পড়ে।

এতোকিছুর পরেও আমি কখনো ফাল্গুন মাস যে একটা আলাদা কোন মাস এবংএটা যে একটা আলাদা কোন বিশিষ্ট আছে তা আমি খুব আলাদা করে কখনো বুঝি নাই।হতে পারে এই মাসে গ্রামের সেই চিরাচরিত সর্ষেফুলের বাহার, জংলীফুলেরসমাহার, কাশবনের সাদা ফুলের প্রাকৃতিক বাহার বড় সুন্দর কিন্তু এইগুলিতোছিলো গ্রামের নিত্যদিনের সৌন্দর্য। যা সবসময় চোখে পড়ে সেটা আর নতুন কি।কবিদের মন আলাদা। তারা বিড়াল দেখলে কবিতা লিখে, গ্রামের মেয়ে কলশী কাঁখেনদী থেকে পানি আনা দেখলেই কবিতা লিখে কিংবা টিনের চালে টাপুর টুপুর বৃষ্টিহলেই কবিতা লিখে। কিন্তু আমি কবি ছিলাম না। বৃষ্টির দিনে আমাদের টিনেরচালের সেই টাপুর টুপুর শব্দ তো আমার কানে লাগতোই না বরং আমাদের চালের কোনফুটা দিয়ে অনর্গল বৃষ্টির পানি ফোটায় ফোটায় পরে ঘরের মেঝ নষ্ট করে দিচ্ছে, কিংবা কাথা বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে বলে হাড়ি দিতেই দিতেই সময় কেটে যেতো। এদিকদিয়ে পানি পড়ে তো এইদিকে হাড়ি লাগাও, ওইদিক দিয়ে পানি পড়ে তো ওইদিকেও হাড়িলাগাও, হাড়ি নাই তো বদনা, বালতি যা আছে তাই লাগাও ইত্যাদি। একদিকে হাড়িদিলে আরেক দিকে হাড়ি দেওয়ার হাড়ি অবশিষ্ট থাকে না। এই অবস্থায় কি আরবৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ কানে আসে? অথবা ঋতুর চাকচিক্য নিয়ে কি কবিতালিখার বা পুলকিত হবার কোনো কারন থাকে? ফলে আমারও ছিলো না, আবার কখনোউপলব্ধিও করি নাই।

এখন বয়স হয়েছে। গ্রামের সেই ফুটা টিনের বাড়িতেআর থাকা হয় না। ফলে বৃষ্টির দিনে বাড়ির সেই ফুটা দিয়ে পানি যে ঘরের খাট, বইয়ের তাক, মেঝের মাটি ভিজে যাবে সেই ভয়ও নাই, আর ভাঙ্গা হাড়ি ধরার আর কোনঅবকাশও নাই। টিনের চালের টাপুর টুপুর শব্দটা হয়ত এখন মনে নাই। তবে এইঅট্টালিকায় বসে কখনো মনে হয়, আহা, যদি আবার সেই কালবৈশাখী ঝড়টায় আরো কিছুকচি আম গাছের নীচে পড়ে থাকতো, আহা, যদি এমন হতো যে, সেই বৃষ্টির দিনেহাফপ্যান্ট ভিজিয়ে আবার যদি সেই কচি বেলার বন্ধুদের নিয়ে হাটু পানি ভেঙ্গেমাইল কে মাইল পার হতে পারতাম। যে ফাগুন মাসের সেই প্রাকৃতিক কাশবনেরসাদাফুল, জংলিবাহার কিংবা সর্ষেফুলের মনমাতানো হলুদ ক্ষেত কখনো ই আমার চোখেধাধা মিশায় নাই, সেই সৌন্দর্য যদি এখন আবার ফিরে আসতো!! হয়ত এখন তা আমারচোখে পড়তো।

মনে হয় যদি আবার সেই জগতে চলে যেতে পারতাম, হয়ত এখন আমিঅন্যমনস্ক হয়ে ভাবতাম, পরুক না হয় কিছু বৃষ্টির পানি, ভিজিয়ে দিক না আমারকাচা মাটির মেঝ। হয়তো আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে আমার সেইটিনের চালের ঢেউ দিয়ে গড়িয়ে পরা পানির সাথে আমার ভিজে আসা চোখের পানিও নাহয় আমার কাচা মাটির মেঝ একটু ভিজিয়ে দিয়ে যাক। আজ আমি শহরের কোনো একঅট্টালিকায় বসে সববয়সি মেয়েদের হলুদ শাড়ির বাহার দেখে বুঝতে পারি, আমাদেরগ্রামে এখন সর্ষেফুল চারিদিকে বাতাসে দোলা খাচ্ছে, আমাদের বাড়ির পাশে সেইজংলীফুল গুলিও বাতাসে নেড়ে চেড়ে উঠছে। হয়ত এখন সেখানে ফাগুন মাস। কিন্তুআমি নেই। তাই এই বিশাল পৃথিবীর অগনিত মানুষের থেকে একেবারে নেই হয়ে যাবারআগে কাল বৈশাখী ঝড়ের মাস, বৃষ্টির মাস, শিটের মাসের মতো আজ এই ফাগুন মাসকেওআমার বড় আপন মনে হলো।

স্বাগতম তোমায় হে ফাগুন মাস। তুমি আমারজিবনে প্রায় ৫০ বছর পর আবির্ভূত হতে পেরেছো। আজ মনে হয়, ফাগুন মাসটাও একটামাস, যাকে আমি কখনো দেখি নাই।

আচ্ছা, ফাগুন মাসে কি চোখ ভিজে? কি জানি, হয়ত ভিজে না। কারো কারো চোখ হয়ত এমনিতেই ভিজে।