১৩/০৪/২০২০-করোনা এবং গার্মেন্টস শিল্প

যে যাইই কিছু বলুক আমাদের এই গার্মেন্টস শিল্পকে ব্যাংগাত্তক করে, কেউ একে রক্তচোষা মালিক পক্ষ বলেন, কেউ কেউ মনে করে এই শিল্পের মালিকগন মাসে মাসে কোটি কোটি টাকা আয় করেন আর ঘুরে বেরায়। যারা এইসব কথা বলেন, তারা এর সেকটরে ১% জ্ঞান রাখেন না বলেই আমার ধারনা। যে দেশে ৮৬% ফরেন কারেন্সী আয় করেন যে সেক্টর, যে সেক্টর আমাদের অন্যান্য খাতের জরুরী জিনিষ ক্রয়ের নিমিত্তে ফরেন কারেন্সি সরবরাহ করে, যে সেক্টর দেশের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশী কারেন্সীর ব্যবস্থা করে, যে সেক্টর আপনি যে গাড়িটা চালান তার এবং সেটার পেট্রোল অকটেন কেনার ডলার আনে, সেই সেক্টরকে অনেকেই মুল্যায়ন করে বলে মনে হয় না। বর্তমান প্রতিযোগী গ্লোবাল মার্কেটিং এ যে এই সেকটর দাঁড়িয়ে আছে, সেটা তাদের নিজেদের পরিশ্রমের ফল।

এদেশে গার্মেন্টস ছাড়াও আরো অনেক সেক্টর আছে যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী কাজ করেন। সে সব কর্মচারির দায়দায়িত্ত অই সব সেক্টরের মালিকগন কেনো নিচ্ছেন না, সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন আসে না। আবাসন খাত, কন্সট্রাকশন খাত, কৃষি খাত, চামড়া খাত, আরো অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের কথা তো কেউ বলেন না যে, তারা কেনো এই সব শ্রমিকদের দায় দায়িত্ত নেয় না?

একদম ক্ষুদ্র একটা উদাহরণ দেই, যারা এতো বড় গলায় বাহাদুরী করে কথা বলেন, তাদের বাসার যে ৩/৪ জন ছুটা বুয়া কাজ করে, সেই সব ছুটা বুয়ার আগামী তিন মাসের বেতন ভাতা যদি আজকে দিতে বলা হয় কোনো কাজ না করিয়ে, অথবা বলা হয় যে, কেউ ঐ সব ছুতা বুয়ার যে টাকাতা দিতে হবে তা সরকার বা অন্য কোনো লোক ধার দেবেন কিন্তু টাকাতা পাবে সরাসরি বুয়ারা কিন্তু লোনটা হবে গৃহকর্তার নামে, তখন তারা এক নিঃশ্বাসে বলবেন, আরে, কাজ করে নাই তাহলে আমি তিন মাসের বেতন ভাতা সেটা কিনা প্রায় হাজার বিশেক টাকা আমি দেবো কেনো? কিন্তু অন্যের বেলায় ঠিকই মন্তব্য করবেন, যাদের ঘামে আজ এই সেক্টরের মালিকরা কোটিপতি, তারা এই ভার নিবে না কেনো? কই, আপ্নারা যারা এতো লম্বা লম্বা কথা বলেন, তারা উদ্যোক্তা হন না কেনো? পরের গোলামি না করে দিন না একটা গার্মেন্টস কারখানা? আপ্নারাও কোটি পতি হয়ে যান!! খালি ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখে ফেসবুক কাপালেই ইন্টেলেকচুয়াল হওয়া যায় না।

আমার এই মন্তব্য সবার বেলায় প্রযোজ্য না, কিছু কিছু লোক আছে যারা গোলামি করতে পছন্দ করে কিন্তু যার গোলাম  তাকে সে ঘৃণা করে। তার ঘৃণার একটা কারন হচ্ছে- সে কেনো পারবেনা, আর অন্য কেনো পারলো। আর যেহেতু সে নিজে পারলো না, তাই, যখনই পারো, মারো গুতা। আবারো ছোট আরেকটা উদাহরণ দেই? আমাদের প্রানপ্রিয় সেনাবাহিনীর নামেও কিন্তু কেউ কেউ কথা বলার সময় কম কয় না? কিন্তু বিপদের বেলায় এই বাহিনি ছাড়া চলে না। সার অব্যবস্থাপনা? আর্মি। বন্যা? আর্মি। মহামারী? আর্মি। যেই বিপদ শেষ, আর্মি আবার কেডা। ঠিক এইরকম, যখন ডলার লাগবে, গার্মেন্টস শিল্প, যখন রিজার্ভ বাড়াতে হবে, এই শিল্প,। চাকুরী নাই? তো গার্মেন্টস তো আছে। আবার এই শিল্পকে কিভাবে চেপে ধরা যায়, কথার ফুলঝুরি আর মাটিতে পড়ে না। অনেক শিক্ষিত মানুষের মুখেও এই রকমের কথা শুনি যিনি গার্মেন্টস এর টার্মনোলজিই জানে না। এলসি কি, ইউপাস কি, শোর টু শোর কি, ব্যাক টু ব্যাক কি, কমপ্লায়েন্স কি, ইডিএফ কি, ইউডি কি, এফ ও বি কি, থার্দ পার্টি কি, কিছুই না। কিন্তু কথা যখন বলে, মনে হয় পায়ের নীচে রাজপ্রাসাদ।

অথচ গার্মেন্টস শিল্প একটা প্রতিনিয়ত চেলেঞ্জের মুখে কাজ করছে। কখনো বিদেশীদের দাবীর মুখে একর্ড, এলায়েন্স আরো কত যে বাহানা। কই ওইসব বায়াররাও তো এতোদিন মানবতা, সোস্যাল রাইটস নিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে, ১৮ বছরের নীচে শ্রমিক নেয়া যাবে না, একর্ড কোয়ালিফাই না হলে অর্ডার দেওয়া যাবে না, ইত্যাদি। তারাও তো এখন তাদের আওড়ানো বুলির ধারে কাছেও নাই। তারা তো তৈরী পোষাকগুলিও নিতে অস্বীকার করছে!! আর এবার? এই করোনা ভাইরাসের প্রভাবে খুব বেশী দেরী নাই যে, এটা আমরা পসিবল কম্পিটিটরদের কছে মার্কেট হারাতে বসেছি। এখন খালি সময়ের ব্যাপার।

একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরছিঃ গত ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের গার্মেন্টস এর যারা প্রতিযোগী দেশ, তাদের করোনা পরিস্থিতিটা একবার দেখুন। তাহলে বুঝা যাবে, আমাদের থেকে এই অর্ডার ঐসব দেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা যুক্তিসংগত।

দেশ/ আক্রান্ত সংখ্যা/ মৃত্যুর সংখা/ টেস্ট এর সংখ্যা /পারসেন্টেজ হার

** বাংলাদেশ- ৮৬০/৩৯/১১২২৩ / ৭.৭%

ক। কম্বোডিয়া- ১২২/০ / ৫৭৬৮/ ২.১%

খ। ভিয়েতনাম- ২৬৫/০ /১২১৮২১/ ০.২২%

গ। শ্রিলংকা- ২১৭/৭ /৪৫২৫/ ৪.৮%

ঘ। ইথিউপিয়া-৭৪/৩/ ৫৪১০/ ১.৩৫%

চ। তাইওয়ান- ৩৯৩/ ৬ /৪৭২১৫/ ০.৮৩%

ছ। মায়ানমার ৪১/৪

জ। ইন্ডিয়া- ৯৬৩৫/৩৩১/১৮১১১১ / ৫.৩১%

এর মধ্যে আরো একটা খবর দিয়ে রাখি-

শিল্প বিপ্লবের প্রথম ধাপে ঘটে বস্ত্রশিল্প বিপ্লব। সুতরাং এই বিপ্লবে গার্মেন্টস সেক্টর চলে যাবে চীনের বলয়ে। চীন আফ্রিকার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলাকে দখল করে নিচ্ছে। এ বছরেও ৫০ বিলিয়ন ডলার লোন দিয়েছে শুধু আফ্রিকার দেশগুলোর অবকাঠামো ঠিক করার জন্য। সেসব কাজের ঠিকাদারি করছে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোই। বেশ জোরেশোরেই চলছে নির্মাণ যজ্ঞ। বড় বড় ব্রীজ, বিরাট সব পাওয়ার প্লান্টের কাজ চলছে। টাকা দিচ্ছে চায়না, কাজ করছে চায়না, শুধু লোনটুকু ফিরিয়ে দেবে আফ্রিকা! বাজি ধরেই বলা যায়, আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে চীন বিশ্বে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। চীন জানে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো তাদের টাকা ফিরিয়ে দিতে পারবে না, যেমনটা পারেনি শ্রীলঙ্কা। লোনের দায়ে হাম্বানটোটা বন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে বাধ্য হয়েছে লঙ্কানরা। আফ্রিকার সমুদ্র বন্দর এবং সস্তা শ্রমের দিকেই নজর চীনের। এইসব সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলো পুরোপুরিভাবে তৈরি করার পরপরই চীন যা করবে তা আমাদের জন্য ভয়ংকর দুঃসংবাদই বয়ে আনবে।

ইতিমধ্যে ইথিওপিয়ার মত দেশও আমেরিকার কাছ থেকে বড়সড় অর্ডার নিচ্ছে। ওদের মজুরিও আমাদের চেয়ে কম। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা-ইউরোপ বেশ কাছাকাছি। সুতরাং কমে যাবে শিপিং কস্ট, কমে যাবে লেবার কস্ট। ওদের শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়লে এবং এই খাতটা একটু ম্যাচিউরড হলেই ইউরোপ আমেরিকার বায়াররা বাংলাদেশের মতো দূরবর্তী দেশে আসবে না- একথা বলাই বাহুল্য।

রেমিট্যান্স প্রায় শুন্যের কোটায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, পাট শিল্প এখন আর সোনার ডিম নয়, চিংড়িখাত ভংগুর, এখন বাকী আছে শুধু গার্মেন্টস সেক্টর। সেটাও এই করোনা এবার ভালোভাবেই আক্রান্ত করেছে।

যদি একে হাতছারা করি, তারপর কি? অনেক বিজ্ঞজনেরা অনেক কিছু না জেনেই অনেক মন্তব্য করেন বটে, কিন্তু যেদিন নিজের প্লেটে আর আগের মতো বিরিয়ানী আর পিজ্জা উঠবে না, তখন মনে হবে- সোনার ডিম পাড়া মুরগীটা গেলো কই?