১৩/০৮/২০১৬- কুরবানীর গরু

Categories

 

গত পরশুদিন অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখেই আমাদের কুরবানীর গরুটি কেনা হয়েছিলো। আমার মেয়ের জামাই গরু দামদর করা থেকে বাসায় আনা পর্যন্ত এই কঠিন কাজটি আমার জন্য সহজ করে দিয়েছিলো। খুব একটা সময় পাই নাই ফ্যাক্টরির কাজের জন্য। অবশেষে গতকাল রাত ১০টার পর কুরবানির গরুটাকে নিরিবিলি দেখার সুযোগ হলো।

বেশ সুন্দর একটি গরু। মধ্যবয়সী। বুঝাই যায়, অতি যত্ন করে গরুর মালিক একে বড় করেছেন। পালা গরু। দেশের অনৈতিক প্রচলন হিসাবে গরুর মালিক নিজে কোন অনৈতিক ঔষধ দিয়ে গরুটাকে বড় করেন নি। বেশ মিশুক। মিশুক কথাটা মানুষের জন্যই শুধু প্রযোজ্য নয়, এটা যে কোনো প্রানির জন্যই প্রযোজ্য। আমি কাছে গিয়ে গরুটার মাথায় একটু আলতো করে হাত বুলাতেই সে বুঝতে পারলো, আমি ওকে আদর করছি এবং আমি ওর ক্ষতিকারক কেউ নই। সব প্রানীই ভালোবাসা বুঝে, আসলে ভালোবাসার ভাষা সবার জন্য এক। ভালোবাসা বহিরপ্রকাশের জন্য কোনো ভাষা লাগে না। হোক সেটা মানুষ, হোক সেটা কোনো ভাষাহীন প্রানি। 

গরুটি আমার হাতের পরশে তার শিং আর মাথার তালু দিয়ে আমার হাতটাকেও এমনভাবে স্পর্শ দিচ্ছিলো যে, আমার মনের ভিতরে তারজন্য একটা মহব্বত, একটা স্নেহ, একটা অনুভুতির পরশ বইয়ে যাচ্ছিলো। কিছু ধানের খের দিতেই দেখলাম, অতি আনন্দের সহিত তা খাওয়া শুরু করলো। মনে হলো ওর ক্ষুধা লেগেছে। আমি কয়েক কেজি ভুষি, পানিতে লবন মেখে একটা বালতিতে রাখলাম। মনে হলো, অনেক দিন পর যেন সে তার চেনা পরিচিত একটা খাবার পেলো। ফলে খের খাওয়ার পাশাপাশি ভুষিগুলুও খেতে থাকলো। ওর খাওয়া দেখে আমারই বড্ড ভালো লাগলো।

রাত প্রায় ১১টা। সবাই প্রায় ঘুমের আয়োজন করছে, আশেপাশের মানুষজনও নিস্তব্ধ। আমি গরুটার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছি। গরুটা কি পরিবেশে বড় হয়েছে, কতগুলু গরু একসঙ্গে বড় হয়েছে, কি তাকে খেতে দেওয়া হত, কিভাবে তাকে খেতে দিলে ও সবচেয়ে বেশী আনন্দ করে খেতো, খাওয়ানোর সময় ওর মালিক কিভাবে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো কিংবা আদৌ পাশে থাকতো কিনা, তার কোনো কিছুই আমার জানা নাই। কিন্তু এই মুহূর্তে এই ভাষাহীন একেলা নিঃসঙ্গ প্রানিটির পাশে আমি আছি। আমি তার শরীরে, মাথায়, গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর ওর ভুষি, খের খাওয়া দেখছি। মাঝে মাঝে ও আমাকে আলতো করে আমার হাতের তালুতে গুতা দিচ্ছে, কিন্তু ব্যাথা দিচ্ছে না। বুঝতে পারছি, আমি ওর বন্ধু হয়ে গেছি।

অনেক সময়ধরে গরুটি অনেক ভুষি আর খের খেলো। তারপর ধীরে ধীরে একটা জায়গায় গিয়ে পিছনের দুই পা সামনের দিকে ভাজ করে আর সামনের দুই পা পিছনের দিকে ভাজ করে ঠিক আমাকে দেখা যায় এমনভাবে শুয়ে পড়লো। জাবর কাটছে গরুটি আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটা চেয়ার নিয়ে খুব কাছেই বসেছিলাম। আমাদের ভাষা ভিন্ন, আমরা আমাদের ভাষায় ওকে কোন কথা বললেও তার বুঝার কোনো ক্ষমতা নেই। মাঝে মাঝে আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর ও তার মাথা আর শিং দিয়ে এমনভাবে সারা দিচ্ছিলো যেনো আমরা কথা বলছি।

এইভাবে কতক্ষন বসে ছিলাম, আমার মনে নাই, কিন্তু এই বসে থাকা অবস্থায় আমি ভাবছি, আগামিকাল সকালে এর জীবননাশ হয়ে যাবে, একে আমি কুরবানী দিবো। এটা ভাবতেই এখন আমার কষ্ট লাগছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার সান্নিধ্য, তাতেই ওর প্রতি আমার একটা মহব্বত, একটা মায়া জন্মেছে। কাল থেকে আর ওকে আমি দেখতে পাবো না কিংবা ও আর এই প্রিথিবীর আলো বাতাশ দেখতে পাবে না, এটা ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার বিধাতার নির্দেশ, সক্ষম ব্যক্তিদের কুরবানী ওয়াজিব। এখানে আমার মহব্বত কত গভীর, আর আমার কষ্ট কতো প্রকট, সেই আবেগের কোনো স্থান নেই।

একটা সিগারেট ধরিয়ে গরুটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আজ থেকে অনেক বছর আগে আল্লাহ ইব্রাহিম (আঃ) কে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিষ, তার ছেলে, ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানি করতে বলেছিলেন। তখনো ইসমাইল (আঃ) একজন অপরিনত সুন্দর, নিস্পাপ এবং কচি একটি শিশু। পিতা নিজের আদরের সন্তানকে তার গলায় ছুড়ি দিয়ে জিবন্ত কুরবানী দিবেন, এটাই ছিলো আল্লাহর নির্দেশ। অনেক অনেক কঠিন একটা নির্দেশ। আল্লাহর প্রতি ইব্রাহিম (আঃ) এর ভালোবাসা কতটা গভীর তার প্রমান হিসাবেই আল্লাহ তাকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন একটা পরীক্ষার কথা ভাবতেই তো গা শিউরে উঠে। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ, অমান্য করার কোন অবকাশ নাই। কিন্তু মানুষের হৃদয় বলে তো একটা জায়গা আছে। মানতে পারা আর মেনে কাজটা করা যেমন দুরূহ, তেমনি সুযোগ্যও হতে হবে। আর এই কাজটাই আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মাধ্যমে আমাদের বাধ্য-অবাধ্যতার পরীক্ষায় ফেলে দিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, সঙ্গে তার কচি নিস্পাপ ছেলে হযরত ইসমাইলও (আঃ)। 

গরুটার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, আল্লাহ কত মহান, তার কি অদ্ভুত পরিকল্পনা, আর কি উদার তিনি যে, তিনি তার রহমত দিয়ে ঐদিন ইব্রাহিম (আঃ) কে তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানটিকে কুরবানী দিতে নির্দেশ দিলেও মহান আল্লাহ ইব্রাহিম (আঃ) এর অগোচরে ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে একটি পশু প্রতিস্থাপন করে কুরবানীকে গ্রহন করেছিলেন এবং প্রতিকী হিসাবে ওই একই কাজ আল্লাহ আমাদেরকে করার নির্দেশ দিয়েছেন। আজ যদি মহান আল্লাহ এই প্রতিকী কুরবানী না জারি রাখতেন, তাহলে আজ আমরা যারা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে পশু কিনছি, তার আর কোনো প্রয়োজন হতো না। কারন নির্দেশমাফিক, আমাদের পরিবারের সন্তানদেরকে একে একে প্রতি বছর কুরবানী করতে হতো। কতই না কষ্টের কাজটি আমাদের করতে হতো। কুরবানীর ঈদ মানে হয়ে যেতো তখন পরিবারের জন্য একটা ভয়ংকর শোকের দিন, হাহাকারের দিন। সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে শোনা যেতো আজ কান্নার চিৎকার। আমার সামনে বসে থাকা ভাসাহীন গরুটিকে দেখছি আর ভাবছি, এই কিছু অল্প সময়ের মধ্যেই এই বোবা প্রানিটির সঙ্গে আমার কতই না খাতির হয়ে গেলো, মায়া জন্মে গেলো। অথচ এই মায়ার বন্ধন, মহব্বতের বন্ধন, আবেগের বন্ধন ছিন্ন করে হলেও আগামিকাল আমি ওকে কুরবানী করবো। ওকে আমি ওর জন্ম থেকে আদর দিয়ে বড় করিনি, ওর কোনো কিছুই আমি জানি না। কখন ওর অসুখ হয়েছে, কখন ও কার ক্ষেতে ফসল খেয়ে কোথায় কতদিন খোয়ারে আটক খেয়েছে, কিংবা কতগুলু চটির আঘাত সে সহ্য করেছে। এ সবের আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু কিছু টাকা খরচ করে ওই পালক মালিকের কাছ থেকে নগদ কিনে নিয়ে চলে এসছি মাত্র। ওকে প্রতিটি ক্ষনেক্ষনে যে লোকটি ঘাস খাইয়ে, ভুষি খাইয়ে, পানি খাইয়ে, যতন করে গোসল করিয়ে দিনের পর দিন বড় করেছে, এই ভাষাহীন প্রানিটিও তার কাছে তার সন্তানের মতোই। আমি মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য ওকে কাছে পেয়েছি। তাতেই আমার ভিতর অজানা এক মায়ার উদ্রেক হয়েছে। এই সামান্য আবেগেই ওকে কুরবানী দিতে আমার মনে কেমন যেনো একটা কষ্ট অনুভুতি লাগছে। আমি আরো ভাবছি, আজ যদি এটা ভাসাহীন প্রাণী, গরু কিংবা ছাগল কিংবা কোনো দুম্বা না হয়ে আমার আদরের সন্তানটি হতো, তাহলে কি আমি পারতাম ঠিক এভাবে এতো নীরবে, আগামিকালের কুরবানীর নির্দেশটি পালন করতে? পারতে তো হতোই। এটাই তো পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়ত আজ আমাদের পরিবারে এতোক্ষন কান্নার রোল পড়ে যেতো, সমাজে প্রতিটি ঘরে ঘরে আজ হতো সবচেয়ে দুক্ষের দিন হতো। আর যিনি কুরবানি হবেন, তারই বা কি হতো মনের অবস্থাটা? আমার ভাবতেই সারা শরীর শিউরে উঠছে। 

অনেক রাত হয়ে গেছে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়ার মত। কিন্তু আমি একা বসে আছি গরুটার পাশে। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এমন নয় যে, গরুটি কোন জ্বালাতন করছে কিংবা ডাকাডাকি করছে কিংবা অজানা কোন ভয়ে সে অস্থির। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। জাবর কাটছে প্রতিদিনকার মত। ও হয়ত জানেই না যে, আজ রাতটাই হচ্ছে ওর জীবনের শেষ রাত। ও আর কখনোই এই পৃথিবীর আলো বাতাস উপলব্ধি করতে পারবে না। কারন কাল ওকে আমি সবার সামনে, জোর করে আস্টেপিস্টে বেধে গলায় ছুড়ি দিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য কুরবানি করে ফেলবো। কত টাকায় আমি আমার এই ভালোবাসাটা কিনেছি, তার জন্য আমার আল্লাহ বসে নাই, তিনি শুধু বসে আছেন এইটা দেখার জন্য যে, আমি আমার ভিতরের ভালোবাসাটা, আমার অতি আদরের সন্তানের পরিবর্তে প্রতিকী এই প্রানীটিকে কতটা মহব্বত করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং তার আদেশ পালন করে তারজন্য কুরবানী করতে প্রস্তুত আছি কিনা। এই গরুটি হচ্ছে আমার সন্তানের বিকল্প একটি প্রাণী। শয়তান আমাকে ধোকা দিচ্ছে বারবার, ধোকা দিচ্ছে অনেকভাবে। কখনো লোক দেখানো, কখনো ধনে-মানে পয়সায় আমি কত বড় তা মানুষের কাছে জাহির করার নিমিত্তে, কখনো অহংকারের নেশায়। অথচ আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য যে ওয়াদা, সেটা আজ প্রায় ভুলতেই বসেছি আমরা সবাই।

সকালে নামাজ পড়ে এসেই অনেক্ষন গরুটার কাছে ছিলাম। আদর করেছি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, শিংগুলুতে হাতের পরশ বুলিয়ে। আবারো খের ভুষি খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম। খুব বেশী খেতে চাইলো না কিন্তু তারপরও সে আমাকে নিরাশ করেনি। আমার শরীর পবিত্র, মাত্র নামাজ পড়ে এসেছি। গরুটাকে আমি ওর গলায় জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন থাকলাম। গরুটাও মনে হলো আমার এই আলিঙ্গন খুব আদর করে অনুভব করছে। হুজুর চলে এসেছে। এখনই কুরবানী হবে। মনটা বড্ড নাড়া দিচ্ছিলো। আশেপাশের অনেক উৎসুক জনতা কেউ গরুটার চামড়া কত দিয়ে বিক্রি করা হবে তার খবরে অস্থির, কেউ কত টাকায় গরুটা কিনেছিলাম, তার দাম দস্তর জিজ্ঞেস করতে অস্থির, কেউ আবার কিভাবে গরুটা জবাই করা হবে সেটা দেখার জন্য ভিড় করে আছে। কিন্তু আমার ভিতরে প্রচন্ড একটা ব্যথা অনুভব করছি। আমি আবারো গরুটাকে একটু আদর করার জন্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, মনে হচ্ছে যেনো আমার অতি আপন একজন কেউ আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। আমার চোখের পাতা ভিজে আসছিলো, গরুটার মুখের দিকে তাকাতেই আমার মনে হলো, আমার শরীরের সঙ্গে এটে থাকা এই ভাষাহীন প্রানিটিরও চোখের পাতা ভিজে এসেছে। ডাগর ডাগর দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়েই থাকলো।