Categories
একটা হাংগেরীয়ান মুভি দেখছিলাম আজ। ছবিটার নাম "Dear Elza"। লম্বুস মিহালি নামের এক যুদ্ধা ইষ্টার্ন ফ্রন্ট থেকে যুদ্ধ কালীন সময়ে ১৫ দিনের ছুটি পায়। কিন্তু সে ভুল একটা লাইনে দাড়িয়েছিলো। ছুটির লাইন আর যুদ্ধে যাওয়ার লাইন। সে ভুল করে ছুটির লাইনে না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো যুদ্ধে যাওয়ার লাইনে। ফলে তাকে আবারো ইষ্টার্ন ফ্রন্টেই ছুটিতে না পাঠিয়ে ওয়ার ফ্রন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর সে রাশিয়ান বাহিনী দ্বারা ধরা পড়ে। আর রাশিয়ান বাহিনী তাকে সন্দেহজনক কোনো মাইন ফিল্ডে পা দিয়ে দিয়ে মাইন আছে কিনা সেটা যাচাইয়ের কাজে লাগানো হয়, যা ছিলো একটা মারাত্তক ব্যাপার। এই রাশিয়ান ক্যাপ্টিভিটির সময় তার কিছু বন্ধু সুলভ বন্ধুরা তার সাথে বিট্রে করে বটে কিন্তু তার কিছু শত্রুপক্ষ তাকে সাহাজ্যও করে। ছবিটার শেষে এসে লম্বুস এটাই শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে যে, the effort of military morality and the ancient instinct of survival can not coexist. লম্বুস যুদ্ধে যেতে চায় নাই। তারপরেও তাকে যুদ্ধে যেতে হয়েছিলো। জীবনের ভুল লাইনে কেউ একবার দাঁড়িয়ে গেলে সেই ভুল পথ থেকে ফিরে আসতে হয়তো কারো কারো এক জীবনেও আর ফেরা হয় না। জীবন আসলে কাউকেই ক্ষমা করে না। সেটা ভুলই হোক আর ভুল নাই হোক। হোক সেটা নিজের ভুলে, বা অন্য কারো ভুলে।
ছবিটা দেখতে দেখতে আমারো আমার সৈনিক জীবনের বহুস্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠলো। ভেসে উঠলো আমার অতীত। আমিও এই আর্মিতে যেতে চাইনি। পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে, মেডিক্যালে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সমস্ত সুযোগ এবং কোয়ালিফিকেশন থাকা সত্তেও আমাকে যেতে হয়েছিলো ঠিক যেটা আমি কখনো চাই নাই- সেই সেনাবাহিনী।
শ্ত্রু পরিবেষ্ঠিত বিপদসংকুল চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্সে শান্তিবাহিনির বিরুদ্ধে পেট্রোল করার সময় সবাই যখন জীবনের আতংক নিয়ে খুব সন্তর্পনে পেট্রোলিং করতো, সবাই যখন জীবন বড় অমুল্য ধন ভেবে বাচার জন্য সব ধরনের প্রতিকার নিতো, সবাই যখন জীবনকে বাচিয়ে রাখার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতো, তখন আমি ছিলাম নির্বিকার। কেনো যেনো জীবনের জন্য আমার এতোটুকুও মায়া জমেনি। অবহেলায় গড়ে উঠা আমার এই মাংশপিন্ডের দেহটা যেনো আমারই ছিলোনা। আমার মা ছাড়া আমার এই দেহে কেউ আদর করে দিয়েছে এটা আমার মনেই পড়ে না। ফলে আমার এই দেহ, আমার এই মন ছিলো আমার মনের বাইরে। কখনো কখনো প্রোটেকশন ছাড়াই হাতে একটা এসএমজি নিয়ে একা একা পাহাড়ি পথে হেটে গিয়েছি। কখনো কখনো কোনো অস্ত্র ছাড়াই বিস্তর পথ একাই হেটে বেড়িয়েছি। জীবনের জন্য কখনো অসস্থিবোধ করিনি। জানি এটা সামরীক আইনের পরিপন্থি। তারপরেও মনে হয়েছে- জীবনের নিঃশ্বাস শেষ হবার পর কোনো আইনই তার জন্যে কোনো কিছু না। কিসের বিচার আর কিসের আইন ভাংগার শাস্তি। চরমটা তো পেয়েই গেলাম নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। জীবন যখন তার এসেট ভ্যালু নিয়ে ভাবে না, তখন তার হৃদয়ের দামই বা কি, আর তার নিশ্বাসের দামই বা কি, এটা আর কোনো মানদন্ডে মাপা যায় না।
কখনো একা একা পাহাড়ের জংলী ফুল দেখেছেন? দেখেছেন কখনো কেনো কোন পাখী কিসের কারনে কোন গাছে উড়ে বসে? কখনো উপলব্ধি করেছেন কয়েকদিন নির্ঘুম রাত কাটানোর পর মুখের খোচা খোচা দাড়ি কিভাবে আপনাকে পরিহাস করে? কখনো যুদ্ধ বিধস্ত এলাকায় কোনো এক ছোট বাচ্চার ভয়ের হৃদপিণ্ড দেখেছেন কতটা জোরে জোরে কাপে সে যখন দেখে ইউনিফর্ম পড়া অস্ত্র হাতে কোনো এক কম্বেট্যান্টকে বা সৈনিককে? কখনো কারো মৃত্যু কি নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করতে দেখেছেন? কখনো কি এটা ভেবেছেন যে, আপনার একটা আঙ্গুলের ট্রিগারের চাপে কোনো এক জলজ্যান্ত যুবকের নিঃশ্বাস বের করে দিতে পারে? কখনো কি শুনেছেন ওই যুবকের শেষ কথা যে বাচতে চেয়েছিলো আমার মত, আপনার মত কোনো এক নিয়ন লাইটের শহরে? কখনোও কি সাধ নিয়েছেন অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে জলন্ত নিবু নিবু ভেজা সিগারেটের গন্ধ? আমি এর প্রতিটা স্তর পার করেছি। আমি দেখেছি, কখন আমার জীবন অন্যের হাতে বন্দি হয় হয় ভাব, আমি দেখেছি সেই ঝর্নার মতো বৃষ্টির রাতে নিবু নিবু সিগারেটের গন্ধ। আমি দেখেছি সেই জলজ্যান্ত যুবকের লাশ, যার উপর বসে আমি সকালের চা খেয়েছি। আমি দেখেছি সে পথহারা ছোট বাচ্চার দিগন্তস্পর্শী চিৎকার আমার অস্ত্র সহ ইউনিফর্মের ভয়ার্ত কারনে। আমি তাকে শান্ত করতে যাইনি। আমি শুধু ভেবেছি, সে আমাকে মানুষ মনে করে নাই। আমি তার কাছে নিতান্তই একটা দানব। অথচ আমার পেট ভর্তি কষ্ট, মন ভর্তি মায়া আর অন্তর ভর্তি মহব্বত। কিন্তু এগুলি তো দেখা যায় না। দেখা যায়, আমার ঘুমহীন চোখের অগোছাল মুখাবয়ব, অশান্ত চেহাড়া আর কঠিন চোয়ালে হাতে ধরা একটা অস্ত্র।
কত বিচিত্র সে জীবন। জোনাকির ভিড়ে, কালো অমাবশ্যার রাতে চকচক করা ফুটন্ত ছোট ছোট মরিচ বাতির মতো কোনো এক মিডনাইট, আকাশের মেঘের ফাকে ফাকে সেই দুরন্ত চাঁদ, যে কিনা একাই জেগে থাকে আকাশে। আমি সেই পথ দিয়ে বহুবার হেটে গিয়েছি একা। মরা মানুষের ভীড়ের আস্তানা সেই গোরস্থান দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় সালাম দিয়েছি স্তব্ধ কবরের নির্জীব মানুষগুলিকে। বসেছি কখনো কোনো কবরের উপর। হয়তো সে এই বাহ্যিক প্রিথিবীতে কোনো এক রাজকুমার ছিলো। আজ সে নাই। হয়তো কোনো এক শায়িত কবরের পাশে বসে সিগারেট ফুকতে ফুকতে ভেবেছি, এখানে ঠিক আমার পায়ের নীচে হয়তো লুকিয়ে আছে কোনো এক গ্রাম কাপানো সুন্দুরী। যার সারাটা দিন কাটতো তার রুপের বাহানায়। অথচ আজ সেও নাই। কখনো নিকষকালো জ্যোৎস্নায় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ভেবেছি, কেউ কি এখনো জেগে আছে আমার মতো? হয়তো তখনো আমার মা জেগেই থাকতো তার সেই ছোট পলাতক ছেলেটির কথা ভেবে ভেবে। আমি তখন যোজন দূরে একা কোনো এক শত কিলোমিটার দূরে বৃষ্টির ফোটা মাথায় নিয়ে ভেজা হাতে হয়তো একটা জলন্ত সিগারেট নিয়ে ভাবতাম, আমি আমার মাকে মিস করি।
সেই ছোট বেলা থেকেই চিঠি আসতো না আমার কখনো। অনেকেরই চিঠি আসতো, কোনো এক জনাকীর্ন বাড়ির বউ কিংবা তার ছোট ভাই বোনেরা, কতই না রঙ বেরং এর খামে চিঠি লিখতো আমারই পাশে শুয়ে থাকা আমারই কমরেডদের কাছে। তারা চিঠি পড়তো, হাসতো, আবার কেউ কেউ অন্য মনস্ক হয়ে যেতো। তারাও চিঠি লিখতো। তাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে। আমার কোনো চিঠি আসতো না। চিঠি না আসা মানেই কেউ আমাকে ভালোবাসে না, আমি কখনো এটা মনে করি নাই। মনে হতো, জীবনটাই তো একটা চিঠি। কেউ লিখে রাখে আর কেউ মনে মনে রাখে।
আমি ডায়েরী লিখতাম, কোনো এক "কল্পনা" আপুকে সেই "আনা'র ডায়েরীর মতো। জগত বড় বিচিত্র। হয়তো লম্বুসের চেয়েও আমার জীবন কম ছিলো না। সেই একাকী সোলজার।