১৫/০৭/২০২২-যখন বয়স ছিলো ১২ কি ১৩

যখন বয়স ছিলো ১২ কি ১৩, তখন স্কুলে কিংবা বড়দের আড্ডায় প্রায়ই একটা ব্যাপারে আমাদের মতো ছোটরা ফেস করতাম-“ জীবনে কি হতে চাও? বা জীবনের লক্ষ্য কি অথবা what is your aim in life?” হয়তো তখন জানতামই না আসলে কি হলে ভালো হয়, কি হলে কি হয়। ফলে বড়দের শিখিয়ে দেয়া বা ইম্পোজ করে দেয়া বক্তব্যই হয়তো হয়ে যেতো আমাদের বক্তব্য। যেমন-ডাক্তার হবো মানুষের সেবা করবো, ইঞ্জিনিয়ার হবো দেশ গড়বো, কিংবা শিক্ষক হবো মহৎ কাজে ব্রত হবো বা সেনাকর্মকর্তা হবো দেশপ্রেমের জন্য ইত্যাদি। কেনো হতে চাই, কি কারনে হতে চাই, এসবের কোনো অন্তর্নিহিত তথ্য বা ভাবসম্প্রসারনের কোনো বালাই কিংবা মাহাত্য জানাও ছিলো না। যদি এই প্রশ্ন কোনো সমবয়সী বালিকাকে করা হতো, হয়তো তাঁর উত্তর একটু ব্যতিক্রম তো হতোই। পড়াশুনা করবে, বিয়ে হবে, ভালো স্বামী পাবে, তারপর সন্তান সন্ততী হবে, একসময় বুড়ো হবে, নায়নাতকোর হবে। জীবন আনন্দে কেটে যাবে। এই তো।

আজ ৪০ বছর পর আমি যখন পঞ্চাশোর্ধ এক মানুষ, এখন আর আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না, আমার জীবনের লক্ষ্য কি। অথবা এটাও কেউ জিজ্ঞেস করে না, কি লক্ষ্য ছিলো, কি হতে পেরেছি আর এখন কোন দিকে যাচ্ছি। এখন সবাই যেটা দেখে, আমাদের গত ৫০ বছরের সাফল্যের ঝুড়ির ভিতরে বর্তমানে কি নিয়ে আমরা বেচে আছি। হোক সেটা বিত্ত, হোক সেটা পজিশন কিংবা হোক সেটা দারিদ্রতা। এই সর্বশেষ ম্যাট্রিক্সটাই হচ্ছে আমাদের জীবনের পাওয়া সাফল্য বা বিফলতা যদিও সেই ছোট বেলার “এইম ইন লাইফের” সাথে এর কোনো মিল নাই বা কিঞ্চিত থাকতেও পারে। স্কুল জীবনে কে কতটা ট্যালেন্ট ছিলো, কে কতটা স্মার্ট ছিলো, কিংবা কে কতটা ভালো রেজাল্ট নিয়ে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরিয়েছে, সেটাই কারো জীবনের আসল সাফল্য না। সবচেয়ে পিছনের বেঞ্চে বসা কোনো এক অমনোযোগী ছাত্র হয়তো এখন এমন এক জায়গায় আছে যেখানে প্রথম সারির মনোযোগী কোনো এক ছাত্র তাঁর ধারে কাছেও না। এই ব্যাপারটা না হয় আরেকদিন লিখবো। এখন যে কারনে আমার লেখাটা, সেটা হচ্ছে-

যে যাইই কিছু করুক, সবার জীবনের একটাই সপ্ন। সবকিছু গুছিয়ে শেষ বয়সে এসে একটু শান্তিতে থাকা। এই যে শান্তি, এটা আসলে কোথায় বা এটা আসলে কি? (ধর্মীয় ব্যাপার এখানে টানতে চাই না, সেটা আরেক প্রকার শান্তি)। এই শান্তি হচ্ছে, আমার খাদ্য, বাসস্থান, সাস্থ্য, নীরাপত্তা আর সাধীনতা যেনো বজায় থাকে, একটু আরামে থাকতে পারি, কোনো টেনশন ছাড়া। কিন্তু আদৌতে কি সেই লক্ষ্যে আমরা পৌছাতে পারি সবাই? বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি- সেতার থেকে অনেক দূরে আমরা। প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা সত্তা। কেউ কারোর জন্যই বেশীরভাগ সময়ে অপেক্ষা করে না, হোক সেটা নিজের সন্তান, নিজের আত্তীয় বা নিজের সংগী। অথচ, আজীবন সবার জন্য সবকিছু করতে করতে একটা মানুষ আসলেই নিঃস্ব হয়ে যায়, নিজের জন্য সে আসলেই আর কিছুই রাখে না। এটা সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে রাঘব বোয়ালদের বেলাতেও প্রযোজ্য। ফলে দেখা গেছে যে, শেষ বয়সে এসে যে সপ্নের জীবনের কথা ভেবে এ যাবতকাল শরীর, যৌবন, মেধা, সঞ্চয়, অকাতরে বিলিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটাই কাল হয়ে যায় নিজের জন্য। অবহেলিত, নির্যাতিত এবং অনিরাপদ জীবন তখন তাঁর সংগী হয়ে যায়। পাশে যাদের থাকার কথা ছিলো, তারা বেশীরভাগ সময়েই আর পাশে থাকে না, আর নিজেরা তখন একেবারেই “একা” হয়ে যান। এই একা জীবনে নিজের নোংরা কাপড়টা ধোয়ার মানুষ থাকে না, খাবারটাও সঠিক সময়ে পরিবেশনের লোক থাকে না, পথ্য খাওয়ানোর কোনো মানুষ আর পাশে থাকে না, এমন কি নিজের যত্ন নিতে যে খরচ দরকার সেটাও আর হাতে থাকে না ইত্যাদি।

কে কিভাবে নিবে জানিনা, আমার মতে, সবার জীবনের সুরক্ষার জন্য সবসময় নিজের জন্য এমন একটা ব্যবস্থা করে রাখা দরকার যখন সব প্রকারের পেইড সার্ভিসে নিজেকে মানুষ সুরক্ষা দিতে পারে। আর সেই পেইড সার্ভিসের জন্য প্রয়োজন একটা ব্যালেন্স সঞ্চয়। এই পেইড সার্ভিসে সঠিক সময়ে পথ্য, কাপড় চোপড় ধোয়ার মানুষ, রান্না বান্নার দক্ষ লোক, যত্নাদি করা লোক সবই থাকতে পারে। যদিও তারা আপন কেউ না।

তাহলে যা দাড়ায়, তা হলো-জীবনের লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিত, “ব্যালেন্স সঞ্চয়” করা যাতে নিজের সব লোক আশেপাশে না থাকলেও সর্বপ্রকার পেইড সার্ভিস নিজেই ব্যবস্থা করতে পারেন এবং জীবন থাকে নিরাপদ। যারা এটা করতে পেরেছেন, তাদেরকে অনেকেই সার্থপর ভাবতে পারেন কিন্তু তারাই সঠিক কাজটি করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। বৃদ্ধাশ্রম বলে আর কোনো অপশন আপনার জন্য প্রয়োজন পড়ে না।

নিজের জন্য করুন, নিজে বাচুন, তারপর অন্যের জন্য করুন। জীবন একটাই।

আজকে যাদের হাতে অনেক টাকাকড়ি নাই, কিন্তু হয়তো এসেট আছে। তাদের উচিত, আগে নিজের জন্য যথেষ্ঠ পরিমান ব্যালেন্স সঞ্চয় রেখে বাকীটা তাদের নিজের লোকদের জন্য রাখা। তাতে যেটা হবে, নিজে ভালোভাবে বাচতে পারবেন, কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না। একটা কথা তো ঠিক যে, নিজের অন্তর্ধানের পর এইসব এসেট, এইসব সম্পত্তির কোনো মুল্য আপনার জীবনে নেই। ঐসব তো করাই হয়েছে যাতে নিজে ভালো থাকা যায়, তাহলে দ্বিধা কেনো? কাজটা অনেক অনেক অনেক কঠিন।

একটা জিনিষ আমি সবসময়ই মনে করি যে, আমরা কোনো কিছুই আমাদের উত্তরসুড়িদের জন্য না রেখে গেলেও তারাই তাদের জীবন আলাদা করে গড়িয়ে নেবে, যেমন আমি আপনি গড়িয়ে নিয়েছি। তাদের ভবিষ্যতের চিন্তায় আজকে নিজেদের বর্তমানকে অবহেলা করে নিজেকে করুন জীবনে বসবাস বুদ্ধিমানের কাজ হয়তো নয়। তাতে সাহস কমে যায়, টেনশন বেড়ে যায়, আর এর কারনেই শরীর খারাপ হতে থাকে, আর শরীর খারাপ হতে থাকলেই আপনার সম্পত্তি বা এসেটের ভাগাভাগিতে উত্তরসুরীরা যতো দ্রুত সেটা নিজেদের করে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। আপনি আবারো আরেক দফায় একা হবেন। একমাত্র বয়ষ্ক ব্যক্তিরাই আরেক বয়ষ্ক ব্যক্তির ভালো বন্ধু হয়। জেনারেশন গ্যাপে নতুন পুরানো জেনারেশনের সাথে মিশে থাকা যায় বটে কিন্তু সেখানে প্রান থাকে না।

(বয়োবৃদ্ধ একজন অসহায় মানুষের গল্প শুনে এই লেখাটা, এটা কাউকে জ্ঞান কিংবা উপদেশ দেয়ার জন্য নয়। এই ফোরামে সম্ভবত এটাই আমার প্রথম লেখা, ভুল মার্জনীয় )