১৫/১০/১৯৯৫-আলগোরের ভিজিট

কয়েকদিন যাবত অবর্ননীয় ব্যস্ততায় দিন কাটাচ্ছি। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর হাইতিতে ভিজিটে আসবেন। সাথে আল গোরের স্ত্রীও আসবেন, এই জন্য। চারিদিকে অনেক কাজ, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন প্রকারের নিরাপত্তা বিষয়ক ট্রেনিং, সেমিনার এবং রিহার্সেল, ইত্যাদি। ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের নিরাপত্তার জন্য চারটি লেয়ার নির্ধারন করা হয়েছে। ১ম লেয়ারে থাকবেন আমেরিকার ঈগল বেসের মিলিটারী, ২য় স্তরে থাকবেন আমাদের বাংলাদেশের সামরিক সদস্যগন, ৩য় স্তরে থাকবেন ইন্ডিয়ান এবং পাকিস্থান বাহিনী, আর ৪র্থ স্তরে থাকবেন সিভিলিয়ান পুলিশ প্লাস এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির লোকজন। আমি কিউ আর এফ হিসাবে এস এস (সিক্রেট সার্ভিস) এর সাথে ১ম স্তর এবং ২য় স্তরের সাথে থাকবো। অর্থাৎ আল গোর যখন বিমান থেকে নাম্বেন, তখনো আমরা অর্থাৎ কিউ আর এফ দল তাঁর সাথে থাকতে পারবো। ভাইস প্রেসিডেন্টের গাড়ী বহরের সামনে পিছনে এস্কর্টে থাকবে বাংলাদেশের  নিরাপত্তা বাহিনী। এর সাথে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজনও।

আজ সকাল ৯টার সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট হাইতির বিমান বন্দরে নামলেন। সকাল থেকেই নিরাপত্তা খুবই জোরদার করা হয়েছে। নিয়মিত ফ্লাইট গুলির উপর অনেক করাকড়ি আরোপ করা হয়েছে। যাত্রীদের ইমিগ্রেশনে একেবারে কঠিন চোখ রাখা হচ্ছে। বাথরুম, এয়ারপোর্টের অলি গলি, লবি, সব জায়গায় কঠিন নজরদারী। হ্যান্ড লাগেজ গুলি চেক করা হচ্ছে আগের থেকে আরো বেশী। যাত্রীদের চেকিং করায় বেশী সময় নেওয়াতে ফ্লাইট গুলি, বিশেষ করে আউট গোয়িং ফ্লাইট গুলির যাত্রা বিলম্ব হচ্ছে। অন্যদিকে ইনকামিং ফ্লাইট গুলিরও যাত্রীদেরকে একটা সরল রেখায় যেতে বাধ্য করা হচ্ছে যাতে যাত্রীরা এদিক সেদিক না যায়। আমরা এরই মধ্যে কয়েক রাউন্ড দিয়ে ফেলেছি সব জায়গায়। সিসি ক্যামেরাগুলি চেক করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত যেনো কোনো একটা জায়গাও গ্যাপ না থাকে। ফুল কাভারেজ। এয়ারপোর্টের  ছাদেও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। যে সব জায়গায় আগে সংরক্ষিত ছিলো না, সহজেই কেউ যাতায়ত করতে পারতো, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে কথা।

আমাদের কাছে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের এবং তাঁর স্ত্রীর ভিন্ন ভিন্ন ভিজিট সিডিউল দেওয়া আছে। ম্যাডাম এর নাম এলিজাবেদ টিপার। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিমান বন্দরে নেমেই একটা বক্তৃতা দিবেন। তারপর তিনি চলে যাবেন প্রেসিডেন্ট এরিস্টিডের প্যালেসে। সেখানে তিনি এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা ছোট খাটো ভাষন রাখবেন এবং হাইতির কেবিনেট সদস্যদের সাথে দি-পাক্ষীয় আলোচনা করবেন। কি নিয়ে আলোচনা করবেন তাঁর এজেন্ডা আমাদের কাছে নাই। অন্যদিকে ম্যাডাম এলিজাবেথ টিপার হাইতির একটি শহর সিটি সোলেতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র ভিজিট করবেন। স্বাস্থ্য সেন্টারের নাম ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রীর নামের সাথে মিল আছেঃ এলিজাবেথ স্বাস্থ্য সেন্টার।

ঠিক ১১ টায় ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের অফিশিয়াল বিমান হাইতির এয়ারপোর্টে এসে নামলো। চারিদিকে সুনসান। কোনো দৌড়াদৌড়ি নাই। যার যার জায়গায় তারা কাজ করছেন। বিমানের দরজা খোলার পর আল গোরের দেহরক্ষীগন প্রথমে অস্ত্রসহ বিমানের গেট খুললেন এবং প্রায় ১০ মিনিট অব্জার্ভ করলেন পরিস্থিতি। অতঃপর ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং তাঁর স্ত্রী একে একে বিমান থেকে বেরিয়ে এলেন। বিমানের ইঞ্জিন বন্ধ করা হলো না, সারাক্ষণ গেট খোলাই রাখা হলো। গেটে দুইজন শসস্ত্র পাহারা মূর্তির মতো দাড়িয়েই রইলেন।

বিমানের সামনেই একটা স্টেজ করা হয়েছিলো। যেখান থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর সবার উদ্ধেশে ভাষন দিলেন। আমরা খুব কাছ থেকে সেই ভাষণ শূনলাম কিন্তু সব সময় নজর ছিলো চারিদিকে যেনো কোনো অঘটন না ঘটে। এই সময় সমস্ত যাত্রিদের মুভমেন্ট সম্পুর্নরুপে বন্ধ করা হয়েছিলো। কারো বাথরুম দরকার হলেও এলাউ করা ছিল নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র আউত গেটে কয়েকটা ল্যাভাটরি স্থাপন করা হয়েছিলো, তাও আবার নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োজিত ছিলো। কারো অধিক জরুরী বাথরুমের প্রয়োজনে সেই আউটদোর ল্যাভাটরি গুলি ব্যবহার করতে পারবে।

প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর সবার উদ্দেশ্যে ভাষন দিলেন। এই ভাষনের সময় হাইতির প্রেসিডেন্ট হাজির ছিলেন না। আল গোর ভাষন শেষে গাড়িতে উঠবেন। ম্যাডাম টিপার ও তাঁর জন্য ভিন্ন মটরক্যাদ তৈরী ছিলো, তিনি আলাদা উঠবেন। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়।

আমি কখনো এই ধরনের নিরাপত্তায় কাজ করি নাই। ফলে প্রতিটি কাজ, ড্রিল, এবং স্তর আমার কাছে ছিলো নতুন। ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর যে গাড়িতে উঠবেন ঠিক সেই রকমের আরো তিনটা গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো। তিনি কোনটায় উঠবেন সেটা আমরাও জানি নাই। এটা জানে শুধু সিক্রেট সার্ভিসের লোক। তিনটা গাড়িতেই আমেরিকার ফ্ল্যাগ চড়ানো। একই ব্রান্ডের, একই চেহাড়া, একই কালার, সব কিছু এক। কালো গ্লাসে মোড়ান জানালা। বুলেট প্রুফ গাড়ি। যেই মুহুর্তে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ভাষন শেষ করলেন এবং গাড়িতে উঠার জন্য রেডি হলেন, অমনি দেখলাম, একোতা বলয় সৃষ্টি হয়ে গেলো। এবং খুব দ্রুত বলয়টা তৈরী হয়ে গেলো। এই চক্করের মধ্যে আমি এতো কাছে থেকেও বুঝতে পারলাম না ভাইস প্রেসিডেন্ট কোন গাড়িটায় উঠলেন। উঠার সাথে সাথে গাড়ির সামনে থাকা আমাদের এস্কর্ট এবং সিক্রেট সার্ভিসের দেওয়া এস্কর্ট গাড়ি এতো দ্রুত চলে গেলো যা একটা চমকের মতো। ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর হাইতির প্রেসিডেন্ট এরিস্টিডের প্যালেসে চলে গেলেন। থাকলেন ম্যাডাম টিপার।

ম্যাডাম টিপারের বেলায় ও ব্যাপারটা প্রায় একই রকমের ঘটলো। তাঁর সাথে দুইজন খুব সুন্দুরী মেয়ে বডি গার্ড হিসাবে সার্বোক্ষনিক থাকেন। আমি দেখলাম একজনমহিলা বডি গার্ড সবার সামনেই তাঁর উপরের জামাটা খুলে ফেললেন, কালো ব্রা দেখা যাচ্ছে, আর উপরের জামার পরিবর্তে এইবার তিনি একটা অস্ত্র সহহ জ্যাকেট পড়ে এতো দ্রুত ম্যাডামের গাড়িতে উঠে গেলেন যেনো বিদ্যুৎ। মেয়েটার বয়স সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ২৬ এর মধ্যে হবে। আমেরিকান মহিলা। ম্যাডাম প্রথম গাড়িটাতেই উঠলেন সেটা আমি ক্লিয়ার বুঝতে পারলাম।

ম্যাডাম টিপারকে নিয়ে আমাদের ব্যান কনের মেজর ফিরোজ এস্কর্টের কাজ করলো। আমরা পিছনের গাড়িতে ম্যাডামকে ফলো করছি। যাবো সিটি সোলের একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ম্যাডাম ওখানে হেলথ সেন্টার দেখবেন, পরিদর্শন করবেন। সিটি সোল খুব বেশী দূর নয়। মাত্র ৪০ মিনিটের ড্রাইভ।

সিটি সোলে যাওয়ার পথে ঠিক সিটি সোলে ঢোকার পথেই হটাত দেখা গেলো বেশ অনেকগুলি জনতা রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে টায়ার পুড়িয়ে রেখেছে। ওরা ম্যাডাম টিপারের আগমনে আন্দোলন করছে এই কারন দেখিয়ে যে, ওদের জন্য যে টাকা পয়সা বরাদ্ধ হয়েছে, সেটা তাদের জন্য খরচ করছে না এরিস্টিড প্রশাসন। এর তীব্র প্রতিবাদে তারা ম্যাডাম টিপারের গাড়িতে আক্রমন। অনেক ইট পাটকেল ছুড়ে স্বাভাবিক এস্কর্ট গাড়ির বেশ কয়েকটা কাচ ভেঙ্গে ফেল্লো। আমাদের গাড়িও বুলেট প্রুফ (হাম্বি গাড়ী) এবং অন্তত দুইটা মাইন বিস্ফোরন থেকে রেহাই পায় এমন গাড়ি। মেজর ফিরোজ সেই ধরনের একটা গাড়ি এস্কর্টের কাজ করছিল। হেসিয়ান লোকজন চাচ্ছিলো ম্যাডাম টিপারকে পথে থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা আদায় করতে। আমরা আসলে এই খবরটা পুর্বে জানতেই পারি নাই যে, সামনে এই ধরনের একটা প্রতিবাদ আন্দোলন হতে পারে। ব্যাপারটা একেবারেই স্পন্টিনিউয়াসলি ঘটে গেলো।

মেজর ফিরোজ আমাদের ওয়াকিটকিতে জানালো যে, সামনে বেশ গেঞ্জাম, স্থানীয় লোকজন রাস্তায় টায়ার পুড়িয়ে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে এবং ভিভি আইপির গাড়িতে ঢিল ছুড়ছে। কি করা উচিত এখন? সবচেয়ে বড়সমস্যা হলো, এই ভি ভি আই পি কে নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের নাই এবং নেওয়াও ঠিক না। কিন্তু এটাও বুঝতেছি যে, বেশীক্ষন এই অবস্থায় আটকে থাকলে সমস্যা আরো বেড়ে যাবে। এই খান থেকে যে কোনো উপায়েই বের হয়ে যাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

মেজর ফিরোজ সহসাই তাঁর নেতৃীত্তে টায়ার পোড়া আগুনের উপর দিয়েই বুলেট প্রুফ গাড়ি চালিয়ে পার হয়ে যায়। সাথে অন্যান্য গাড়িগুলিও। এটা ছিলো খুবই একটা রিস্কি ব্যাপার। সফল হওয়াতে সবাই বাহবা দিলেন ঠিকই কিন্তু কোনো মেজর অঘটন ঘটে গেলে ব্যাপারটা দাড়াতো মারাত্তক। ম্যাডাম টিপার ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করেছে বলে পরে সব বাংলাদেশীদেরকে প্রশংসা করেছেন। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয় নাই। ম্যাডাম টিপার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার পর সেখানেও অনেক লোকজন বিদ্রোহ করছিলো। তিন জন উত্তেজিত লোক তো কম্পাউন্দেই ঢোকে গিয়ে গাড়িতে ইট পাটকেল মারতে শুরু করে। টিয়ার গ্যাস ছুড়তে হলো বিদ্রোহী জনতাকে সামাল দিতে।

কিছুক্ষন পর হেসিয়ান বিদ্রোহী জনতারা আমেরিকার বিরুদ্ধেই স্লোগান দেওয়া শুরু করে এই বলে যার অর্থ এই রকম যে, গো হোম ইয়াংকি, গো। ইউ এন সদস্যদের গাড়িতেও তারা অনেক ইট পাটকেল ছুড়ে।

যাই হোক, খুব অসস্থিতেই গেলো দিনটা। কিন্তু আমাদের দেশের মিলিটারী সদস্যদের প্রশংসায় সিক্রেট সার্ভিস, ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং ম্যাডাম টিপার অনেক মেসেজ দিলেন। এও বলে গেলেন যে, দেশে গিয়ে এই রকম একটা সাহসী পুর্ন কাজের জন্য "লেটার অফ এপ্রিশিয়েশন" ইস্যু করবেন। আমি জানি না সেটা আবার কি ধরনের কি।

যাই হোক, জাতিসংঘের মহাসচিব ভুট্রুস ঘালি গতকাল হাইতিতে এসেছেন। আজ বিকেলে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং মহাসচিব দুজনেই চলে গেলেন। একটা ব্যস্ত দিন গেলো সব মিলিয়ে।  এয়ারপোর্টেই এই দুই ভিভিআইপি প্রায় ৩০ মিনিট একত্রে কি কি আলোচনা করলেন, তারাই জানে। এই সময়ে আমাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিলো এতোটাই কঠিন যে, কোনো কেউ এর ভিতর দিয়ে পার পেয়ে যাবার মতো নয়।