১৫/১১/২০০৩-খোলাহাটিতে আবার

খোলাহাটি সেনানীবাসে এটাই আমার প্রথম আসা নয়, এর আগেও একবার এসেছিলাম ২০০১ সালে যখন আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে কর্মরত ছিলাম। তখন এসেছিলাম আমি ক্যাপ্টেন টু মেজর পরীক্ষার একটা গোপন প্রশ্নপত্র নিয়ে। আর এখন এলাম একেবারে পোষ্টিং নিয়ে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে এলাকাটার। আগে তেমন গাছপালা ছিলো না, ফ্যামিলী কোয়ার্টারগুলি তখনো নির্মানাধীন ছিলো, এখন সেই গাছগুলি অনেক বড় হয়ে গেছে, বিল্ডিংগুলি যে নতুন সেটাও বুঝা যাচ্ছে আবার অনেক বিল্ডিং রঙ করা দরকার সেটাও বুঝা যাচ্ছে। আমি পরিবার নিয়ে আসি নাই, ফলে অফিসার মেসেই আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আজ পর্যন্ত যেখানেই পোষ্টিং হয়েছে, আমি আমার পরিবার নিয়ে কখনো থাকি নাই, শুধুমাত্র যখন বগুড়ায় লোকেটিং ইউনিটে চাকুরী করেছিলাম ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত, তখন কয়েক মাসের জন্য আমি আর আমার স্ত্রীকে নিয়ে জাহাংগিরাবাদ সেনানীবাসে কোয়ার্টার নিয়ে থেকেছি। তখন কোনো বাচ্চা কাচ্চা হয় নাই, আমি আর মিটুলই ছিলাম। এবার আমি আমার দুই মেয়ে আর মিটুলকে ঢাকায় রেখেই আমি নিজে ব্যাচলর লাইফ লিড করার জন্য এই খোলাহাটিতে এলাম। মন ভালো নাই, প্রোমশনটা হয় নাই, কোনো কিছুতেই আর আগের মতো সিরিয়াসলি কাজ করতে মন চায় না। অনেক আগে থেকেই এই চাকুরীটা করবো না করবো না করছিলাম, কিন্তু সেটা অনেক কারনেই বাস্তবায়ন হয় নাই, কিন্তু এবার মনে হচ্ছে হয়তো আর থাকা যাবে না। এর আগে চাকুরী থেকে বের হতে পারি নাই অনেকগুলি কারনে যে, আবার নতুন একটা চাকুরী খুজতে হবে, নিজের বাসা নাই স্থায়ীভাবে, কোথায় থাকবো, কোথায় কি ধরনের আবার চাকুরী পাই সব মিলিয়ে আর্মির চাকুরীটাই ভালো মনে হয়েছে বিধায় আর যাওয়া হয় নাই। কিন্তু এবার প্রোমোশন না হওয়াতে আমার জুনিয়াররা যদি আমার সিনিয়র হয়ে আমার থেকেও কম কোয়ালিফাইড হয়ে আমাকে কন্ট্রোল করতে চায়, এটা আমি মানতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত অবস্থা যেমনই হোক, আমাকে বেরিয়ে যেতেই হবে।

খোলাহাটি সেনানীবাস রংপুর সেনানীবাসের অধীনের একটা ব্রিগেড। কিন্তু রংপুর থেকে খোলাহাটি অনেক দূর বিধায় সেনানীবাসের সাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যে কিংবা রুটিন অনেক দেখভালের মধ্যে এটা পড়ে না। এটা একটা লোকাল গ্যারিসন হিসাবে অনেকটাই আরামদায়ক। তাং কম।

সিও ফেরদৌস স্যারের সাথে যেহেতু ক্যাডেট কলেজে অনেক লম্বা সময় ধরে পরাশুনা করেছিলাম, ফলে, আমার সাথে তাঁর সখ্যতা অনেক ফ্রেন্ডলী। তিনিও আমার প্রোমোশন না হওয়াতে খুব আপসেট। আমরা একই সাথে স্টাফ কলেজ করেছি। খুব বেশী দরকার না হলে ফেরদৌস স্যার আমাকে অনেক চাপ দেন না কিংবা আমাকে অযথা হয়রানী করেন না। জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে যারা আছে তারাও খুব ভালো। লেঃ মাহফুজ বর্তমানে এডজুটেন্টের কাজ করছে, লেঃ রাকিব করছে কোয়ার্টার মাষ্টারের কাজ। অনেক পরিশ্রমী ছেলেগুলি। আমি চেষ্টা করি যাতে ওরা আরো ভালো কিছু করতে পারে। ওরাও বুঝে যে, আমার লেঃ কর্নেল হবার কথা থাকলেও যে কোনো কারনেই আমার প্রোমোশন না হওয়াতে ওরাও কিছুটা মনক্ষুন্ন কারন এতো যোগ্যতা রেখেও যখন প্রোমোশন হয় না, এতে ওদের মধ্যেও ক্যারিয়ার গড়ার যে একটা অনুপ্রেরনা থাকার কথা তাতে মনে হচ্ছে ঢিলেমী এসছে।

নতুন মহিলা অফিসার নিয়োগ হয়েছে। আমাদের এই খোলাহাটিতে দুইজন মহিলা অফিসারের পোষ্টিং হয়েছে। আমার ইউনিটে এসছে ২লেঃ তাহমিনা আর পাশের ৮ ফিল্ডে এসছে ২লেঃ নাজনিন। দুজনেই খুব ভালো মেয়ে। তাহমিনার বাবা একজন অবসর প্রাপ্ত জেসিও। হয়তো একটা সময় আসবে যে, ওরা ইউনিট কমান্ড করবে, ব্রিগেড কমান্ড করবে। আমি যখন আর্মি হেড কোয়ার্টারে এমটি ডাইরেক্টরে ছিলাম, তখন মহিলা অফিসার নেয়া হবে কিনা এটার তোড়জোড় শুরু হয়। আমি মহিলা অফিসার নেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্তক পজিটিভ ভুমিকা রেখেছিলাম। আজ সেই ভুমিকার অংশ নিজের চোখে দেখে গেলাম। মহিলা অফিসারের কমিসন হয়েছে।

আমি প্রায়ই ঢাকায় যাই পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য। ঢাকা থেকে একটি মাত্র বাস খোলাহাটিতে আসে আর তাঁর নাম হচ্ছে, "হক বাস সার্ভিস"। অন্যান্য বাসগুলি রংপুর পর্যন্ত এসেই থেমে যায় কিন্তু "হক" বাসটি খোলাহাটি পর্যন্ত আসে। খুব ভাল সার্ভিস না কিন্তু অন্তত এটা খোলাহাটি পর্যন্ত আসে বিধায় আমি সবসময় "হক" বাসের মাধ্যমেই ঢাকা থেকে আসি এবং যাই। এসি নাই।

আসলে আমি প্রতিদিন নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করছি।  কয়েকদিন আগে নতুন অফিসার হিসাবে আসা অফিসারদের জিওসির একটা সাক্ষাতকার ছিলো। আমারো উনি সাক্ষাতকার নিলেন। মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার। বাংলাদেশ আর্মির একজন ডেসিং এবং স্মার্ট অফিসার। উনার সাথে যখন আমার সাক্ষাত হয় বা ইন্টারভিউ হয়, আমি বেশ কিছু উত্তর জানার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা আমি ছোট করে লিখছিঃ

জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আমার সাথে অত্যান্ত চমৎকার ব্যবহার করলেন। উনি নিজেও আমার সব কোয়ালিফিকেশনগুলি দেখে একটা মন্তব্য করলেন যে, আমি আসলেই দুঃখিত যে, তোমার প্রোমোশনটা হয় নাই। আমি স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, উনি তো আমাদের প্রোমোশন বোর্ডে ছিলেন, কোথায় আমার কি সমস্যা ছিলো যার কারনে আমার প্রোমোশনটা হয় নাই। সে ব্যাপারে কি আমি কিছু জানতে পারি? উনি তাঁর একটা ছোট নোটবই (নোট খাতা) বের করে কিছুক্ষন কি যেনো দেখলেন, পড়লেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটা কথাই শুধু বললেন যে, শোন মেজর আখতার, সবসময় যোগ্যতাই প্রোমোশনের জন্য ক্রাইটেরিয়া নয়। যখন কোনো সিনিয়র অফিসার মনে করে যে, সে তাঁর অধস্তন কর্মকর্তার থেকে কম কোয়ালিফাইড, তখন ওই জুনিয়ার অফিসারকে নিয়ে কাজ করতেও অনেকেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে গানার জেনারেলদেরকে জিজ্ঞেস করো কেনো তারা তোমাকে ভয় পায়। জিজ্ঞেস করলাম, কে আমার নামে ভেটো ভোট প্রদান করেছে স্যার সেটা কি আমি জানতে পারি? উনি সরাসরি আমাকে বললেন না কিন্তু বুঝলাম, আরেক মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার (আর্টিলারী) আর মেজর জেনারেল শাহাবউদ্দিন হয়তো এই ব্যাপারে কোন মন্তব্য রেখেছেন। বড্ড খারাপ লাগল শুনে।

আমি জিওসিকে বললাম, স্যার, আমি সম্ভবত এপেন্ডিক্স যে লঞ্চ করতে পারি ভলান্টিয়ারভাবে আর্মি থেকে সুবিধা নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। জিওসি বললেন, দেখো গানার, সময় সব সময় তোমার অনুকুলে হয়তো থাকবে না। একটু ওয়েট করো, হয়তো পরেরবার তোমার প্রোমোশন হবেই।

আমি বললাম, স্যার, যে আমি গত ১৮ বছরে কোয়ালিফাই করতে পারলাম না, কি এমন আমি করে ফেলবো যে, আগামি এক দুই বছরের মধ্যে আমার প্রোমোশন হয়ে যাবে?  তারপরেও উনি আমাকে অনেক এডভাইস করলেন। আমি জিওসিকে বললাম, স্যার, আমার কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না আর। সকাল থেকে শুরু করে যে আমি এতো পরিশ্রম করতাম, এখন কেনো জানি মনে হয়, এসবের কোনো দরকার ছিলো না। এখানে পরিশ্রমের আর যোগ্যতার মুল্য আসলেই নাই। যখন ডিভিশনে বড় বড় কাজের জন্য দায়িত্ত দেয়ার ব্যাপারে অফিসার খুজে বেড়ায়, তখন খুজে খুজে আমাকেই বের করা হয়, যখন স্টাডি পিরিয়ড করার জন্য দিনে রাতে আমাকে স্ক্রিপ্ট তৈরী করে আর্মি হেডকোয়ার্টারে প্রেজেন্ট করতে হয়, তখন সবাই বাহবাই দেয় কিন্তু যখন প্রোমোশনের টেবিলে বসে, তখন আমাদের এই পরিশ্রমের কথা তারা ভুলেই যায়। তাহলে আর পরিশ্রম করার দরকার কি? জিওসি রেজ্জাকুল হায়দার আমাকে বুঝলেন। বললেন, আমার ডিভিসনে তোমার কোনো অবমুল্যায়ন হবে না। তুমি তোমার মতো করে চলো।

জিওসি অনেকবার কাউকে না জানিয়ে খোলাহাটিতে পিটি প্যারেডের সময় চলে আসতেন। আমি প্রায়ই এই পিটি প্যারেড মিস করতাম, কিন্তু জিওসি কখনো আমাকে কেনো মিস করছি, কেনো সময় মতো পিটিতে যাচ্ছি না, এ ব্যাপারে কোনোদিন প্রশ্ন করেন নাই। একসাথে মেসে নাস্তাও করেছি যখন ইউনিটে পিটি প্যারেড হচ্ছিলো। কথা হতো এই জেনারেলের সাথে। ভালো লাগতো।

এভাবে সময় যেতে থাকে, মন ভালো আর খারাপের মধ্যে আমি অনেক সময় পার্থক্য বুঝি না।