১৬/০২/২০১৩- রাজপুত্রের “প্রজন্ম চত্বর”

গোলার টেক, পাল পাড়া রোড,  মীরপুর–১২১৬

আমি খুব ভয়ে আছি এই কয়েকদিন যাবত। আর এই ভয়টা জাগিয়ে তুলেছে শাহ্‌বাগের “প্রজন্ম চত্বর”।  কি সুন্দর নাম “প্রজন্ম চত্বর”।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এই বীরবাঙ্গালী জাতী যতবার আন্দোলন করেছে, যতবার ঘর থেকে রাস্তায় নেমেছে, সবসময় সুফল নিয়েই ঘরে ফিরেছে বারবার। আর এই জন্য আমরা একটা স্বাধীন ভাষা পেয়েছি, একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি। বিশ্বময় আমরা মাথা উচু করে বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের ছেলে। আমার দেশের রাজধানীর নাম ঢাকা। কিন্তু ১৯৭১ সলের পর থেকে যতবারই যে কোন আন্দোলন হয়েছে, কোন না কোন ভাবে সেটা কোন না কোন ব্যক্তি বা দলের দখলে চলে গেছে এবং সেটা আবার ছিনিয়ে আনতে নতুন করে আন্দোলন করতে হয়েছে।

১৯৭১ থেকে ২০০০ এর পর যতসব ঘটনা সবার চেহারা এক। আশা ভাঙতে ভাঙতে এখন আর আশাহত হইনা, আশাহীন হয়ে পরেছি। সবসময় ভেবেছি, মিশর বদলিয়ে দিল একদল তরুন, ৪২ বছরের ইতিহাস এক বছরে পাল্টে গেল, লিবিয়া স্বৈরশাসক মুক্ত হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যে। সিরিয়া, তিউনেসিয়া, আরও অনেক দেশ এখন পাইপ লাইনে চলে এসেছে, সেখানে গনতন্ত্র ছাড়া আর অন্য কোনভিত্তিক শাসন দিয়ে সারা দেশ চালানো সম্ভব নয়। বিশ্ব এখন শুধু হাওয়া বইছে পজিটিভ পরিবর্তনের। অথচ আমরা শুধু “খবর” হয়েছি সারা বিশ্বে হয় বন্যা, না হয় দুর্নীতি, না হয় ক্রসফায়ার, না হয় আভ্যন্তরিন রাজনীতির হিংসাত্তক কর্মকাণ্ডের কারনে। যদিও নোবেল বিজয়ের মত ঘটনাও এ দেশে ঘটেছে, বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন উদ্ভাবনী হয়েছে, গারমেন্টস শিল্প  অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কিন্তু একই সময় আবার এক পদ্মা সেতু সব অর্জন যেন এক নিমিষে সারা পৃথিবীতে আমাদেরকে আরও এক ধাপ পিছিয়ে দিয়ে গেছে। পিছিয়ে দিয়ে গেছে দেশের উন্নতির একটা ধারাবাহিক স্বপ্নের, পিছিয়ে দিয়ে গেছে সারা  বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা উচু করে দাঁড়াবার প্লাটফর্মটা। এটা শুধু একটা লোণ নয়, এটা একটা কলঙ্ক জনক ঘটনা। এটা একটা দেশের চরিত্র, এটা একটা দুঃস্বপ্ন। এই স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যথায় কেউ সোচ্চার হলনা, অথচ আমি জানি এটা নিয়ে দেশের ১ম মানুষ থেকে শুরু করে আপামর সব চেয়ে ছোট মানুষটারও বুকে কস্ট আছে। আমি জানি না কেন এমন হল, আমি জানি না কি করলে কি হত। আমার জানা নাই এখানে কার কতটা দোষ বা কার কতটা গাফিলতি। শুধুজানি, স্বপ্নটা সার্থক হতে আরও অনেক সময় পেরিয়ে যাবে। উদ্ধারকারী খুব কাছে কেউ নেই আমাদের।

ঘর থেকে বের হই খুব ভয়ে ভয়ে। এ ঘরে আবার ফিরে আসা হবে তো? নাকি পথে কোন কারন ছাড়া আমি হয়ে যাব লাশ বা বিশ্বসন্ত্রাসী? উচিত কথা বলবার আমার সাহস নাই, এটা আমার দুর্বলতা নয়, এটা আমার একাকিত্তের ফসল। আমি যেন একা। আমার মত সবাই যেন একা। সবাই যেন কোন এক উদ্ধারকারীর অপেক্ষায় আছে, কবে আসবে সেই বীরপুরুষ? আর কেই বা সেই বীর পুরুষ? চারিদিকে নৈরাজ্য, মারামারি, দুর্নীতি, চাপাবাজি, অবিশ্বাস, চারিদিকে হাহাকার, এখানে একটা লাশ এক ভাগ পুঁটি মাছের দামের থেকেও কম, এখানে একটা যুবতির সম্ভ্রম শকুনের ভাগাভাগি করে খাওয়া গলিত শিয়ালের লাশের থেকেও কম গুরুত্তপূর্ণ।

এমন একটা কঠিন সময়ের মধ্যে হটাত করে শাহ্‌বাগের “প্রজন্ম চত্বর” যেন গহিন সমুদ্রের মধ্যে একছটা আলোর মত মনে হয়। আমার মন আবেগে ভরে উঠে। আশায় ভরে উঠে। দেশের আনাচে কানাচে ভিয়েনামের যুদ্ধের মত সব যৌবন আজ জেগেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের মত সব যৌবন আজ টগবগ করে ফুটছে, এখানে ভোর, সকাল, দুপুর, রাত যেন এক হয়ে গেছে। সময় থেমে গেছে। এখানে আজ ৯০ বছরের থুরথুরে বুড়িও যেন আর বুড়ি নয়, এখানে সব দাত পরে যাওয়া ১০০ বছরের দৃষ্টিহীন বুড়ো যেন তোমাদের স্পর্শে ২৫-৩০ বছরের যুবক বনে গেছে। আমি এখন রাস্তায় বেরোলে আমি জানি তোমরা পাহারায় আছ, আমি জানি তোমাদের সামনে কোন বাধায়ই বাধা নয়। কে আছে আমাকে এখন কটু কথা বলবে? কার এমন দুঃসাহস আছে আমাকে ভয় দেখাবে? আমার পাশে তো “প্রজন্ম চত্বর” আছে। তোমরা তো এখন আমার ক্যাপ্টেন। তোমরাই কি সেই বীর পুরুষ নও? মিশরের মত? লিবিয়ার মত? চেগুভার এর মত? নাকি আবারো হতাশায় ভোগাবে? কোনো উদ্আদেশ্মিয নিয়ে এই প্রজন্ম চত্তর নামে সবার হৃদয়ে আবার শুল চালাবে না তো?

আর কাঁদতে চাই না, আমাকে আর আশাহত কর না, আমি বিশ্বাস করতে চাই, ওই আলো আমাদের, ওখানে কোন আর হায়েনারা নাই, দল নাই, ব্যক্তি নাই, তোমরা জেগে থাক একটা একটা সপ্ন নিয়ে, তোমাদের আর ঘুমিয়ে থাকার অবকাশ নেই। তোমরা কি সেই আলো?  তোমরা কি সেই উদ্ধারকারী? হয়ত বা তাই, আমি তাই বিশ্বাস করতে চাই।  এখন আমাকে তোমরা প্রশ্ন করতে পার, তাহলে আমি ভয় পাই কেন? আমি ভয় পাই এই ভেবে যে, যে আলো তোমরা দেখাচ্ছ, সে আলো কি তোমরা ধরে আছ কিনা, যে আলোর তাপ তোমরা বিকিরন করছ, সে আলোর মিছিল একান্তই আমাদের কিনা। আমার ভাল লাগে যখন দেখি তোমার মাথা আঁচড়ানোর সময় নাই, আমার ভাল লাগে যখন দেখি তোমার গায়ে ঘামের গন্ধ, আমার ভাল লাগে যখন দেখি তোমরা যা অ-গ্রহনযোগ্য তা নিমিষে বর্জন করতে পার এবং সত্যিটাকে আগলে রাখ। কিন্তু ভয় লাগে যখন দেখি দেশি-বিদেশি বর্ণচোরা হায়েনারা তোমাদের পাশে ঘুরঘুর করে সুযোগ খুজছে, আমার ভয় করে যখন দেখি তোমার মাথার চুল আর এবড়ো থেবড়ো নয়, বেকব্রাশ করা পরিপাটি চুল, আমার ভয় করে যখন দেখি তোমার ঘর্মাক্ত সার্ট  আর ঘামে ভিজে নেই, অনেক অসাধু সুযোগ সুন্ধানী হায়েনাদের মত ইস্ত্রি করা। আমি তোমাদের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে চাই, তোমাদের অনেক কাজ। একটা একটা করে করতে হবে, এখানে আশা ভঙ্গ করা মানে, শেষ তলয়ার শেষ হয়ে যাওয়া। তোমরা কি শুনতে পাও ঐ স্বামীহারা স্ত্রীর কান্না যে একা একা গত ৪০ বছর ধরে পরাধীনের মত গ্লানি টেনেছে?  তোমরা কি শুনতে পাও ঐ স্বামীহারা স্ত্রীর স্বামীহীন অসহায় জীবনের একাকীত্ব? তোমারা কি শুনতে পাও কত বিরঙ্গনার আর্তনাদ যারা তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে মরনের আগে শুধু তার সতিত্তের বিচার পাওয়ার জন্য? এরা কেউ তোমার মা, কেউ তোমার বোন, কেউ তোমার মেয়ে। ওরা কারো কাছেই কোন বিচার পাবে বলে আর আশা করে না। আর যারা ঐ ৩০ লাখ তরুন মানুষ তোমাদের ভবিষ্যৎ সুখের জন্য তাদের যৌবন ত্যাগ করেছে, বর্তমান ত্যাগ করেছে, তাদের জন্য কি সুসংবাদ দিবে তোমরা? তোমরা শুধু একটা কাজ করে যাও, তোমরা তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর বাংলাদেশ রেখে যাও যা তোমাদের পুর্বসূরিরা তাদের জীবন ত্যাগ করে তোমাদের জন্য করে গেছেন। 

আমি ৭১ দেখেছি কিন্তু ৭১ কি আমি তখন কিছুই বুঝিনি। আমি দেখেছি আমার মা শুধু রাত জেগে বসে থাকতেন কখন আমার বাবা চুপে চুপে রাতের আধারে মার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন, দিন পার হয়ে গেছে, মাস পার হয়ে গেছে, বাবা আর ফিরে আসেন নি। আমার ভাই কতই বা বয়স তার, ১৯ কি ২০ ! কি অদম্য সাহসের সাথে কোন এক রাতে মাকে না বলেই চলে গেলেন ৭১ এর যুদ্ধে। কি হয়েছিল তার? দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কই আমার ভাই কি আর ফিরে আসবে না? হয়ত বাবা আর আমার ভাই এখন এক সঙ্গেই আছেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমার বাবা কি আমাকে মিস করে? আমার ভাই কি আমাকে মিস করে? আমি তাদের খুব মিস করি। আমার মা আমাকে প্রতিদিন হাতির গল্প, ভুতের গল্প, রাজা রানীর গল্প শুনাতেন। ৭১ এর পর আমার মাকে আর কখন কোন দিন আর হাতির গল্প, ভুতের গল্প বলতে শুনিনি। আমার মাকে গল্প বলতে বল্লে শুধু একটা গল্পই বলতেন, “এক ছিল এক রাজা, রাজার ছিল রানী। রাজা-রানির ছিল এক রাজপুত্র। এক দিন রাজা যুদ্ধে মারা গেলেন, রানীও কয়েক বছর পর মারা গেলেন রাজার শোকে। বেঁচে রইল রাজপুত্র”। মা এখনেই গল্পটা শেষ করে দিতেন। আমি বলতাম, তারপর কি হল মা? মা বলতেন, “রাজপুত্র বড় হবে, সেও যুদ্ধ করবে রাজার মত কারন রাজার রক্ত যে রাজপুত্র বহন করে”। আমি বলতাম, কোথায় মা সেই রাজপুত্র? মা কিছুই বলতেন না। আমি আজ তার উত্তরটা জানি। সে এখন “প্রজন্ম চত্বরে”।  

আবার আমার শতভাগ ভুল হলেও হতে পারে। হতেও পারে, যা দেখছি, পুরুটাই ভুল। 

বাঙালি বড় অসহায়।