১৭/০৭/২০২৪-বাংলাদেশের দুর্নিতি

সব সময় কেনো জানি মনে হয়- “কি যেনো ঠিক নাই” শুধু মনে হয় “কোথায় যেনো গড়বড় হচ্ছে”। যখনই কারো সাথে আড্ডায় গল্প করতে বসি, সবার ভিতরেই যেন এই একই অস্তিরতা। একটা অস্বস্তি কাজ করছে সবার মনের ভিতর।

আসলে মুল বিষয়-দূর্নীতি। সকালে আমার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস। পত্রিকাটা হাতে পাবার পর আমি প্রথমেই পুরু পত্রিকার সবগুলি পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নেই কোন ইন্তারেষ্টিং খবর আছে কিনা। যেই পাতাই উল্টাই, শুধু চোখে পড়ে দূর্নীতির মহাযজ্ঞ। আবার এসব যারা করছেন, তারা সবাই মুটামুটি সেসব মানুষগুলি যাদের কাজ ছিল যেন দূর্নীতি না হয় তার দেখভাল করা। অথচ তারাই ক্ষেত খেয়ে ফেলছেন। আরেকটা মজার অথবা শংকিত হবার বিষয় হচ্ছে-এরা সবাই প্রায় শুদ্ধাচারে ভূষিত।

প্রায় পুরু প্রশাসনিক ডিপার্টমেন্ট, আইন শৃঙ্খলা বাহিনি, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, এক্সিকুইটিভ ব্রাঞ্চ, ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট, পলিটিশিয়ান কোনো ডিপার্টমেন্ট বাদ পড়েনি। ঢালাওভাবে আমি কখনোই বলবো না যে, সবাই দুর্নীতি করেন, এসব ডিপার্টমেন্টে এখনো প্রচুর অফিসার, কর্মকর্তা বা কর্মচারী সৎ এবং দূর্নিতির ধারে কাছ দিয়েও হাটেন না। গুটিকতক দূর্নিতিবাজদের জন্য এসব সঠিক মানুষগুলিও কোনো না কোনো ভাবে অপমানিত কিংবা ডিপার্টমেন্টের কারনে অস্বস্তিতে ভোগেন।

পোষ্টিং বানিজ্য, ডিও বানিজ, টেন্দার বানিজ্য, অবৈধ দখলের প্রতিযোগীতা, অন্যের কোন একটা অসহায় অবস্থাকে পুজি করে বিপুল অংকের সুদ বা সম্পদ কেড়ে নেয়ার বানিজ্য যেনো আজ একেবারে ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। ভূমি রেজিষ্ট্রেশনে যাবেন? সব কিছু ঠিক থাকলেও বড় অংকের সালামী ছাড়া সম্ভব না, আপনি যোগ্য, আপনার সঠিক জায়গায় যাওয়ার কথা, সেখানেও বড় বড় অংকের খেলায় পোষ্টিং বানিজ্য, আপনি আপনার শুদ্ধ জমি নিজের প্রয়োজনে অন্যের কাছে বিক্রি করবেন? পারবেন না, সেখানেও একটা বড় ধরনের সিন্ডিকেট। আপনি সৎ থাকতে চান, সরকারকে ট্যাক্স দিবেন, সেখানেও আপনি বড় বড় অফিসারদের কাছে খুব সহজেই জিম্মি হবেন। আপনার আইডি কার্ডকেও আপনি আর বিশ্বাস করতে পারবেন না কারন কখন যে আপনি রহিম থেকে করিম হয়ে গেছেন বুঝতেই পারবেন না। সেই আইডি কারড, নকল ওয়ারিশনামা, নকল নকল ছবি দিয়ে রহিমের সম্পদ করিম গিলে খেয়ে ফেলছে। বিচার চাইতে যাবেন? কার কাছে? সবারই তো একই দশা। তাহলে মানুষ কার কাছে যাবে? বিচার ব্যবস্থায়? আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে? প্রশাসনের কাছে? পলিটিশিয়ানের কাছে? কোথাও কোনো আশ্রয় নাই। তাহলে মানুষ যাবেটা কোথায়? 

২০০২ সালে আমি তখন জর্জিয়ায় জাতিসঙ্ঘের মিশনে কাজ করছিলাম। বাংলাদেশ কয়েকবার দূর্নীতির শীর্ষে ছিলো এবং সম্ভবত সেই সালেও দুর্নীতির সুচকে পিছিয়ে ছিলো না। আমার সাথে আরো অনেক দেশের সামরীক অফিসাররা একই মিশনে কাজ করছিলো। সুইডেন তখন দূর্নীতির একেবারে নিমে অবস্থান করছিলো। একটা ক্যাফেতে আমরা সবাই মিলে চা খাচ্ছিলাম, তখন সুইডেনের এক মেজর সাহেব আমাকে প্রশ্ন করেছিলো-আচ্ছা তোমাদের দেশে দূর্নীতিটা কিভাবে হয় যে একেবারে শীর্ষে উঠে গেলা? আমি এখন তাকে কিভাবে বুঝাই আমরা কিভাবে দুর্নিতি করি।

বললাম, আচ্ছা, তুমি যখন তোমার দেশে নিজের জন্য একটা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলা, তখন কিভাবে পাসপোর্ট পেয়েছিলা?

সে বল্লো-আমি পাসপোর্ট অফিসের পোর্টালে গিয়ে অনলাইনে আবেদন করেছি, তারপর তারা আমাকে একটা ফিরতি ম্যাসেজ দিয়েছিল কবে নাগাদ আমার পাসপোর্ত দরকার, আমি তার উত্তরে একটা টেনটেটিভ তারিখ লিখে দিলাম। অতঃপর আমি সে তারিখে গিয়ে আমার পাসপোর্ট সংঘ্রহ করে নিয়ে এলাম। এইতো।

এবার আমি তাকে বললাম-

আমাদের দেশে অন লাইন পোর্তাল নাই, ফলে নিজে গিয়ে পাসপোর্ট ফর্ম আনতে হয়। যখন ফর্ম আনতে গেলাম, গিয়ে দেখবো, ফর্ম নাই। কিন্তু আমি যদি কিছু টাকা দালালকে দেই, কিছুক্ষনের মধ্যে আমি একটা ফর্ম পেয়ে যাবো। সেই ফর্ম এনে আমি যখন সব ডিটেইলস লিখে আবার পাসপোর্ত অফিসে জমা দিতে যাবো, গিয়ে দেখবো ডিলিং অফিসার সিটে নাই কিংবা আজকে আসবেন না। ফলে ফর্ম জমা দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যদি দালালকে কিছু টাকা দেই, তাহলে সেদিনই ফর্ম জমা দেয়া সম্ভব। যাক, ফর্ম জমা দিলাম। এবার পুলিশ ভেরিফিকেশনে যাবে।

পুলিশ ভেরিফিকেশন কখনই শুরু হবে না যতোক্ষন না আমি কনো দালালকে আবার কিছু টাকা না দেই। শুরু হল পুলিশ ভেরিফিকেশন। এবার পুলিশ আসবে আমার ঠিকানায়। এসে বলবে, আমার এই সমস্যা, ওই সমস্যা, খারাপ রিপোর্ট যাবার সম্ভাবনা। ফলে পুলিশকে আরো একবার কিছু টাকা না দিলে পুলিশ ভাল ভেরিকেশন রিপোর্ট দিবে না। দিলাম কিছু টাকা। এবার এই ভেরিফিকেশন পুলিশের অফিসে জমা হয়ে থাকবে দিনের পর দিন। আমাকে নিজে গিয়ে খবর নিতে হবে ভেরিফিকেশন রিপোর্টটা পাসপর্ট অফিসে পাঠান হয়েছে কিনা। শুনতে পাব, এটা যেভাবে এসেছে সেভাবেই পড়ে আছে। সেই ভেরিফিকেশন ওখান থেকে পাসপোর্ট অফিসের দিকে চলমান করার জন্য আমাকে আবার কিছু টাকা দিতে হবে। দিলাম টাকা। এবার আমার পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপর্ট চলে আসবে পাসপর্ত অফিসে। কিন্তু সেতা ডিলিং অফিসারের কাছেই থাকবে যদি না আবার তাকে কিছু টাকা না দেই। এভাবে টাকা আর ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের মাধ্যমে শেষ নাগাদ এটা পাসপর্ট প্রিন্টিং এ যাবে। সেখানেও একই অবস্থা হবে, প্রিন্টিং হবে না যদি টাকার বরাদ্ধ না হয়। যাই হোক এসে গেলো প্রিন্টেড পাসপোর্ট। কিন্তু আমার হাতে আসে নাই।

এবার আবার যেতে হবে পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে খবর নিয়ে দেখা যাবে আমার থেকেও অনেক পড়ে এপ্লিয়া করে অনেকেই আমার থেকে অনেক আগেই পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেছেন কিন্তু আমারটা পড়ে আছে। দাও টাকা, খাওয়াও কিছু মিষ্টি, অতঃপর সপ্নের পাসপোর্ট আমার হাতে।

এটা শুনে সুইডেনের সেই অফিসার কিছুক্ষন অবাক আর হতভম্ব হয়ে বল্লো- তাহলে তোমরা কিভাবে চলো? এতো টাকা দিয়ে বা খরচ করে তারপর একটা কাজ করছ, এই টাকা পাও কই?

বললাম-দূর্নিতি করে পাই।

এদেশের টপ অফিশিয়ালরা যদি দূর্নীতি না করতো, তাহলে তাদের নিম্ন স্রের ব্যক্তিরা কনোভাবেই দুর্নীতিতে প্রবেশ করার সাহস পেতো না। রাজনীতিবিদরা পোস্টিং বানিজ্যে লিপ্ত, চাদা বাজীতে লিপ্ত, কেনাবেচায় কমিশন নিতে ব্যস্ত, অফিসারেরা ভূমিতে, কর-অফিসে, মিডিয়াতে, বিচার বিভাগে একটা রায় দিতে গিয়ে কোটি কোটি টাকায় সমঝোতা, স্কুল কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাস করে ড্রাইভার থেকে শুরু করে টপ লেবেলের অফিসাররা লিপ্ত, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও তাই, মানুষ মেরে, অযথা কোনো ক্রাইমে ঢোকিয়ে অযথা হয়রানী করে মামলা, ইয়াবা কি না করছে। সাধারন মানুষের কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। অথচ প্রতিবার রাজনীতিবিদরা সেই পুরানো স্লোগান দিয়েই ভোট চাইতে আসে-জিরো টলারেন্স, দূর্নীতিমুক্ত সমাজ, আইনের শাসন, উন্নয়ন আরো কত কি। আর আমরা সাধারন মানুষ বারবার প্রতারিতই হই।

প্রতিটি অপকর্মের হোতা ক্ষমতাশীন দল গুলির ক্ষমতাবান মানুষ গুলি। তারা মুখে আর যাইই কিছু বলুক, সেটা অন্যের জন্য কিন্তু নিজের বেলায় তারা কিছুতেই তাদের সেই বলা কথাগুলি প্রযোজ্য মনে করে না। আজকাল অপকর্ম করে কেউ লজ্জাও পায় না। বরং উলটা তারা যে অপকর্ম গুলি করছে এটা যেনো বাহাদুরি একটা কাজ এবং সমাজে বুক ফুলিয়ে বলেও বেড়ায় তাদের সেসব অপকর্মের ফিরিস্তি।

অথচ দেশটা কতো সুন্দর হতে পারতো।