Categories
দূর্নীতি কোনো একজনের কাজ নয়। দূর্নীতি আসলে একটি গোষ্টীর কাজ। আর নীচের লেবেলের মানুষগুলিই এর স্বীকার। অথচ এদের থেকে আবার আকাশ ছোয়ার আশা করা হয়। এরা যে টাকা পায়, তা অনেক ফিল্টার হয়ে নীচে নামে। আর দূর্নীতির মূল ঐ ছাকনীতেই থাকে। ছাকনীই যদি খারাপ হয়, দেশ থেকে কখনোই দূর্নীতি নির্মুল করা সম্ভব না। পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ সবাইকে সমান করে ভাগ করে দিলেও দেখা যাবে, দূর্নীতির কারনে হয়তো কারো না কারো কাছে আরেকজনের থেকে বেশী সম্পদ পাওয়া যাবে।
অনেকে হয়তো বলতে পারেন যে, করাপশন কোনো গুন্ডামী নয় যে কারো গলায় ছুড়ি ধরে, দূর্নীতি কোনো শত্রুর নাম নয় যাকে আমরা হারাতে পারি, করাপশন আমাদের কাছে একটা ভয়ংকর রোগ, যতোদিন মানুষ থাকবে ততোদিন করাপশন থাকবে। কিন্তু আমি এই থিউরীর সাথে একমত হতে পারি না। ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, মানুষ কত ঔষধ বের করেছে, বড় বড় রোগকে হারিয়েছে, করাপশন যদি একটা রোগ হয়, তাহলে কোনো না কোনো রকমের চিকিৎসাও থাকবে। হ্যা, হয়তো কোনো এমুনিশন বা ইঞ্জেকশন তৈরী হবে না কিন্তু একটা সিস্টেম তো তৈরী হবে যে দূর্নীতি হতেই দেবে না।
আমরা যখন আমাদের সন্তানদের জন্য স্কুল খুজি, তখন একটা জিনিষ খুবই গুরুত্ত পায়, আর সেটা হলো সংস্কার, ভ্যালু। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে চাই সৎ শিক্ষা পাক, নীতির মধ্যে থাকুক, দূর্নীতির বাইরে থাকুক। কিন্তু বড় হবার পর এই সংস্কার, ভ্যালুজ, সততা, নীতিগুলি কি আর ব্যবহার করা হয়? ছাত্রজীবন শেষ করার পর যখন মানুষ কর্মিজীবনে প্রবেশ করে, তখন এই সংস্কারের অগ্নি পরীক্ষা হয়ে থাকে। সোজা রাস্তা বানানো আর সোজা রাস্তায় চলা দুটুর পার্থক্য আছে। যদি সততা নিজের কাছে মুল্যবান হয়, তাহলে এই দুইটার মধ্যে পার্থক্য নিজেই বুঝে যায়। সোজা রাস্তায় অনেক কাটা, ক্ষতবিক্ষত হতে হয়, অনেক রক্তপাত হয়।
একজন তরুন শিক্ষিত ছেলে বা মেয়ে অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় না শিক্ষিত হয়েও অনেক মানুষ ভালো সপ্ন দেখেন, সুস্থ্য সমাজের সপ্ন দেখেন, তারাও তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটা ভালো পরিবেশ উপহার দিতে চান যাতে আজকের প্রজন্মের পরবর্তী সময়ে তাদের রেখে যাওয়া আদরের প্রজন্ম নিরাপদ থাকে, ভালো থাকে। কিন্তু এমন একটা প্রিথিবী যেখানে সর্বদাই তার নৈতিক মুল্যগুলুকে কেউ না কেউ পিষে ফেলে দিচ্ছে। আর তারা অনেক উচু ক্লাশের মানুষ। তারপরেও অনেক মানুষ সপ্ন দেখে। সপ্ন পুরন করা খুব সহজ নয়, না কখনো সহজ ছিলো। আর ভবিষ্যতেও সহজ হবে না। আসলে ভালো সপ্ন দেখাই তো কঠিন। অথচ এই সপ্নই আমাদেরকে জোড়া লাগিয়ে রাখে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে, আমরা এই সপ্ন নিয়েই বাচি। নিজের সপ্নকে কখনো ভাংতে নাই।
সুস্থ্য সমাজ গড়ে তোলতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুস্থ মানসিকতা, দূর্নীতিমুক্ত চিন্তা এবং চেতনা, সাথে এর কঠিন প্রয়োগ। আর এই প্রয়োগকারী হিসাবে প্রথম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ত রাষ্ট্রের নেতার, দেশের কর্নধার, প্রশাসনের। আর এদের মৌলিক ইউনিট হচ্ছে সেসব মানুষগুলি যারা করাপশন করেন না, এবং করাপশনকারীকে তারা নিজেদের প্রানের বিনিময়ে হলেও পাকড়াও করেন। যারা করাপশন করে না, তাদের কাছে টাকা আর সম্পদের কোনো মুল্য থাকে না। তারা শুধু বেচে থাকতে চান মানুষের উপকার করার জন্য। কিন্তু তাদের জন্য প্রতিনিয়ত রয়েছে মৃত্যুফাদ আর হুমকি। যখন কোনো নেতা, বা কোনো বড় মানুষকে প্রানে মেরে ফেলার হুমকী দেয়া হয়, তখন তাকে পুলিশের সুরক্ষা দেয়া হয়। ভালো রাষ্ট্র তা দেয়।
কেনো?
কারন তারা দেশের সেবক। যে একনিষ্ঠ এবং সৎ মানুষটি দূর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ে, তাকে করাপ্টেড লোকেরা প্রানে মেরে ফেলার হুমকী সব সময়ই দিয়ে থাকে। তাই, এইসব ভালো মানুষগুলিকেও পুলিশের সুরক্ষা দেয়া উচিত। তারা দেশের সম্পদ। তাদের প্রান বাচানো দেশেরই উচিত। দেশের জন্য তারা অনেক মুল্যবান সম্পদ। যখন এইসব জ্ঞানী, গুনী, সৎ মানুষগুলির প্রান চলে যায় আর সমস্ত আনাচে কানাচের প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দায়সারা গোছের একটা তথাকথিত ইনভেষ্টিগেশনের নাটক সাজিয়ে গোলেমেলে একটা সমাধান দিয়ে দেয় এবং আসল সত্যকে অনুসন্ধানে বিরত রাখে, তখন এইটা বুঝতে আর কোনো অসুবিধা হয় না যে, রাষ্ট্রের অনেক উচু স্তরে এর জন্ম। তারাই কোনো না কোনোভাবে করাপশনের নিমিত্তে ঘটিত কেস ডিসমিস করে দেন নিজের মুখোশ আড়াল করার জন্য। কিন্তু আসলেই কি কেস ডিসমিস হয়ে গেলো বলে মনে হয় তখন? সর্বোচ্চ মহল যখন এই কথিত ইনভেষ্টিগেশনে খুসী হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন, তখন কারোই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইনভেষ্টিগেশনে বানানো স্টোরি আসলে কি।
আর এভাবেই দেশের সম্পত্তি লুট আর তার বিরোধিতা করা মানুষের খুন কোনোটাই এদেশে শেষ হয় না। পত্রিকা খুলুন, টিভিতে নিউজ দেখুন, বড় বড় হেড লাইনসে রোজ একটা নতুন স্ক্যাম। কিন্তু ভিতরের পাতায় রোজ একজন সাধারন মানুষের, দিন মুজুরের খুনের নিউজ অতিশয়ই কিঞ্চিত। সাধারন জনতা, আপনি, আমি আজ থার্ড ক্লাস রোডের জন্য টোল ট্যাক্স দিয়ে থাকি। ওইসব রাস্তায় সফর করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে থাকি। এই রাস্তাগুলি হয়তো কখনোই ভালো হবে না। হয়তো কোনো স্ক্যামে অভিযুক্ত কোনো ঠিকাদারেরও আজীবন সাজা ভোগের কোনো নথি নাই, উদাহরনও নাই। হয়তো বিদেশী ব্যাংকে গচ্ছিত কালো টাকাও কখনো এদেশে ফেরত আসবে না, আসেও না। তাহলে উপায়? উপায় একটাই। আমাদের সবাইকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
করাপশন দূরারোগ্য ব্যাধি নয়। করাপশনের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রথম হাতিয়ার হিসাবে আমাদের উচিত, করাপশনের বিরুদ্ধে লড়াই করা নিহত বা মৃত বীর মানুষগুলির কাহিনী শুধু কাগজ আর ইন্টারনেটে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং বাচ্চাদের টেক্সট বুকে জায়গা দেয়া, তাদের বুনিয়াদ তৈরী করা। আমাদের এটা দায়িত্ত যে, আমরা যেনো আগামী প্রজন্মকে করাপশন সম্পর্কে অবগত করি যেটা আমাদের মজবুত আর উন্নত দেশ বানাতে বাধা দেয়। দিতীয় ধাপের হাতিয়ার যদি বলি সেটা হচ্ছে-সমাজকে সর্বোচ্চ স্তর থেকে ভয় দূর করা, সুশাসন দেয়া। যদি সেটা না হয়, তাহলে করাপশন কোনোদিনই দূর তো হবেই না, ধীরে ধীরে এর প্রভাব এতোটাই বিস্তার হবে যার ফলে প্রতিটি মানুষ একে একে এর নেতিবাচক দিক পাবেন, হোক সেটা অনেক পয়সাওয়ালা বা দরিদ্র। বর্তমান পরিস্থিতি কোনোভাবেই এই ব্যাধি থেকে পরিত্রানের অবস্থানে নাই আমরা, না দেশ। ছোট একটা গল্প দিয়ে শেষ করি লেখাটা-
একজন রাজা ছিলো। খুবই শয়তান আর নিষ্টুর রাজা। সে নিজের সভাসদ আর প্রজাদের খুব ভয় দেখিয়ে রাখতো। একবার সেই রাজা তার নিজের দর্জিকে বল্লো, আমাকে এমন একটা পোষাক বানিয়ে দাও যেটা কারোর কাছে নেই। আর সাথে এটাও বল্লো, যদি আমি জানতে পারি, এ রকমের পোষাক অন্য কারো কাছে আছে, তাহলে তোমার গলা কেটে দেবো। দর্জি খুব ভয় পেয়ে গেলো, বাড়ি ফিরে দুসচিন্তার মধ্যে পড়লো কিভাবে একটা উপায় বের করা যায়। সকালে উঠে সে রাজার জন্য একটা স্যুট তৈরী করে ফেল্লো, “হাওয়ার স্যুট”। দর্জি ঐ ‘হাওয়ার স্যুট’ রাজার উলংগ শরীরে পড়িয়ে দেয়। রাজা খুব খুশী হলো। সভাসদরাও খুব বাহবা দিলো। ঐ ‘হাওয়ার স্যুট’ পড়ে উলংগ রাজা নিজের প্রজাদের মাঝে যায়, তাদের মতামত জানার জন্য। প্রজারাও সবাই খুব বাহবা দিলো। কারোর এটা বলার সাহস হলো না যে, রাজামশাই, আপনি নিজের তামাশা নিজেই বানাচ্ছেন। সারাদিন উলংগ রাজা তার নগরে ঘুরে বেড়ালো। তারপর একটা ভবঘুরে বাচ্চা এগিয়ে এলো। আর জোরে জোরে হেসে বল্লো, “রাজা তো উলঙ্গ!!”
আমরা এই গল্পের শেষটুকু এখনো জানি না। কিন্তু নিশ্চয় ঐ ভবঘুরে বাচ্চাটা বাচেনি হয়তো।
এখন প্রশ্ন এটাই, করাপশনের বিরুদ্ধে গিয়ে ঐ জ্ঞানী সৎ মানুষগুলি কতদিনই বাচে যদি এই উলংগ অত্যাচারী রাজার মতো হয়? কারন তারা উলংগ রাজাকে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ওরা উলংগ। তাই তাদের মরাই জরুরী।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, আমায় মনে রেখো না, বা আমার কাজকেও মনে রেখো না। শুধু এইটুকু আশা রাখি যে, শুধু বার্তাটা মনে রেখো।