১৮/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব ৪

জ্যোৎস্না সন্ধ্যায় যখন আমি ক্যাম্পের উঠোনের ঠিক মাঝখানে বসি, তখন দেখিতে পাই আকাশের মেঘমালা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়া পাহাড়ি বাতাসের সাথে একাকার হইয়া কাধে কাধ লাগাইয়া, এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় দ্রুত স্থান পরিবর্তন করিতেছে। কখনো কখনো এই মেঘমালা চাদের কিরনকে পরিবেষ্টিত করিয়া আমার পুরু ক্যাম্পকে আবছা অন্ধকারে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে, আবার কখনো কখনো মেঘগুলি এতো নীচু দিয়া প্রবাহিত হয় যে, আমার সারা শরীর ভিজিয়া যায়, আমার হাতে থাকা সিগারেটটাও সিক্ত হইয়া আসে। আর্মিতে আসিবার পর আমি অনেক রাত একা একা নির্জন কোনো গায়ের পথ ধরিয়া মাইলের পর মাইল হাটিয়া গিয়াছি। গহীনরাতে আমি সেই মেঠোপথে পেচাদের ডাক শুনিয়াছি। কখনো কখনো আলো আধারে ঘেরা কোনো এক পুকুরের পাশে বসিয়া ব্যংগ সমুহের নাক ডাকা শব্দও শুনিয়াছি।  এই পৃথিবীর রুপ দেখিয়া আমি দিনের আলোয় জেগে উঠা পৃথিবীর রুপের কোনো মিল খুজিয়া পাই নাই। আসলে ঘুমন্ত পৃথিবীর একটা রুপ আছে। জ্যোৎস্নায় ইহার রুপ এক রকম, আবার অমাবশ্যায় ইহার রুপ অন্য রকম। জাগ্রত পৃথিবীর রুপ ঘুমন্ত পৃথিবীর রুপের মতো নয়।

এখন রাত প্রায় বারোটা। আমার ক্যাম্পের সেন্ট্রিপোষ্টের প্রহরী ছাড়া আর সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমার থেকে অনতিদূরের ঘরটায় নূর মোহাম্মাদ ওয়্যারলেস অপারেটর মৃদু হারিকেনে ঝিমাইতেছে। নূর মোহাম্মাদের পাশে থাকা ওয়্যারলেস যন্ত্রটা মাঝে মাঝে বেশ সিজিত হইয়া অন্য কোনো ষ্টেশন থেকে "হ্যালো হ্যালো" বার্তা দিয়া নীরবতা ভঙ্গ করিতেছে। আমি আকাশ থেকে ঝরে পরা নির্মল জ্যোৎস্নায় স্নান করিতেছি একা।

হটাত কারো পায়ের আওয়াজ পাইলাম। ঘাড় ঘুরাইয়া দেখিতে পাইলাম, হাবিলদার আব্দুর রহমান রুম হইতে বাহির হইলো। জিজ্ঞেস করিলাম, কোথায় কি কারনে বাহির হইলো। আমাকে একা উঠানে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আব্দুর রহমানও একটু হচকচিয়ে গেলো। এতো রাতে তো আমাকে এই উঠনে দেখার কথা নয়। সালাম দিয়া বলিল, স্যার, ঘুম আসিতেছে না? আমি রহমানকে কিছুই বলিলাম না। প্রায় মিনিট পাচেক পর আব্দুর রহমান বাথরুম করিয়া আবারো তাহার ঘরে প্রবেশ করিতে যাইবে, এমন সময় আমার মনে হইল, আব্দুর রহমানের সাথে কিছু কথা বলি। আমি তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম, -রহমান, কাল তোমার কি ডিউটি? অফ ডিউটি নাকি কোনো ডিউটি আছে?

আব্দুর রহমান সাবলিল ভংগিতে জানালো, -স্যার আগামিকাল আমার কোনো ডিউটি নাই। পরপর কয়েকদিন আমি ডিউটি করার কারনে আগামি দুইদিন আমার অফ ডিউটি। কিন্তু স্যার ক্যাম্পের মধ্যে অফ ডিউটি আর অন ডিউটির মধ্যে আসলে কোনো তফাত নাই। যেখানে থাকার ঘর তার পাশেই ডিউটির ঘর, আবার তার পাশেই রান্না ঘর তো তারই পাশে টিভি রুম। কতটুকুই বা জায়গা স্যার।

বললাম, বসো। আচ্ছা রহমান, তুমি সারাদিন জাল বুনো কেনো? এটা কি তোমার নেশা? আব্দুর রহমান পাশেই একটা ছোট কাঠের গুড়ি নিয়া আমার সামনে বসিয়া পড়িলো। আগেই একবার বলিয়াছিলাম যে, বিডিআর সৈনিকেরা আমাদের আর্মির সৈনিকের চেয়ে ঢেড় বেশী ফ্রি। তাহারা আমাদের আর্মির সৈনিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ক। আব্দুর রহমান, কাঠের গুড়িটায় বসিয়া বলিতে লাগিলো-

স্যার, জাল বুনা আমার নেশা না। এটা বলতে পারেন আমার একটা ইনকামের পথ। আমি প্রতি তিনদিনে একটা জাল বুনি। এ যাবত কাল আমার ট্রাংকের মধ্যে প্রায় ৫০ টার বেশী জাল বুনা আছে। আমি যেদিন ছুটি যাবো, আমি এই জালগুলি সাথে করে নিয়ে যাবো। প্রতিটা জালে আমি প্রায় একশত করে টাকা লাভ করতে পারবো। তাতে আমি ৫০টি জালে হাজার পাচেক টাকা লাভ করবো। আমার পরিবারের জন্য টাকাটা অনেক কাজে লাগবে। আমার বড় ছেলেটা এবার মেট্রিক দেবে। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ভাল আছি স্যার সব মিলিয়ে।

আব্দুর রহমানের কথায় আমি খুবই অবাক হইলাম। মাত্র হাজার পাচেক টাকা তো বিডিআর সৈনিকের কাছে কিছুই না। যে পরিমান অবৈধ পন্য, চোরা কারবারীর মাল ,কিংবা বর্ডার সুরক্ষার নামে যে পরিমান অবৈধ নারকোটিক্স পাচার হয়, তাতে তো কোটি টাকার খেলা। আর এই আব্দুর রহমান কিনা মাত্র ৫ হাজার টাকাতেই এতো খুসি? আব্দুর রহমান এই নিশব্দ রাতে, একাকী আমাকে যাহা যাহা বলিলো, তাহাতে আমার রহমানের প্রতি বিনম্র ভালোবাসা আর শ্রধ্যায় মাথা হেট হইয়া আসিলো।

স্যার, যেদিন আমি প্রথম এই কর্মজীবনে আসি, আমি দেখেছি, কি হরিলুট হয় আমাদের এই কর্মজিবনে। এমনো হয়েছে যে, এক রাতের ইনকাম হয় লাখ লাখ টাকা। আমি আজ পর্যন্ত কোনোদিন কখনো কোনো অবস্থাতেই একটি টাকাও অবৈধভাবে কামাই করি নাই, খাইও নাই। অনেক সময় আমার সহকর্মীরা ভাগ বাটোয়ারা করে হয়ত আমার ভাগেরটা আমার তোষকের নীচে রেখে গেছে, আমি সেটা কোনোদিন খুজেও দেখি নাই, ধরেও দেখি নাই। কেউ যদি এই অবৈধ টাকা আমার তোশকের তল থেকে চুরী করেও নিয়া যায়, বা গেছে, তাতেও আমার কোনো কিছুই যায় আসে না। টাকাটাই তো আমার না। আমি সবসময় সৎ রোজগারে বিশ্বাসী ছিলাম, এখনো আছি, আল্লাহই যথেষ্ঠ আমার শান্তি আর সুখের জন্য। নামাজ পড়ি, রোজা করি, কারো সাথে ঝামেলায় যাই না, আমি আমার কাজগুলি ঈমানের সাথে করার চেষ্টা করি। কয়দিনই বা বাচবো স্যার। তারপর কি? আমি কি আমার এই সব সম্পদ, টাকা পয়সা সাথে করে নিয়ে যেতে পারবো? স্যার আমি মরনকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। আমি দেখেছি কত বিত্তবান মানুষ অঢেল সম্পত্তির উপর শুয়ে থেকেও তার ওই সব টাকা কোনো কাজেই লাগে নাই। তাহলে কি লাভ এই পচা, অবৈধ আর দূষিত টাকা কামানো? তার থেকে আমি এই যে প্রতি তিন দিনে একটা জাল বানাই। আর যা লাভ হয়, সেটায় অনেক বেশী বরকতময় স্যার। আমার সাথে কারোই বনে না বলে ওরা আমাকে রদ্দিমাল বলেই কেউ কেউ টিটকারী করে, কেউ আবার বোকা বলে, কেউ আবার আমার কিছুই নাই বলে ফকিরন্নীও বলে। আমি তাতে কোনো কিছুই মাইন্ড করি না। আমি শুধু জানি, আমাকে সম্মানীত করার মালিক একমাত্র আমার প্রভু, আল্লাহ।

আব্দুর রহমান কথাগুলি বলিয়া চলিয়া গেলো। আর আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলো, স্যার, অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাইয়া পরেন। খোলা আকাশে এভাবে বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। পাহাড়িয়া এলাকা, কেউ অসুস্থ্য হলেও তাকে সুস্থ্য করবার লোক আশেপাশে থাকে না। আব্দুর রহমান চলিয়া গেলো।

কি অদ্ভুত দর্শন আব্দুর রহমানের। টাকাই যদি সমস্ত সুখের মূল হইতো তাহলে আজ থেকে শত বর্ষ আগে যে সব রাজ রাজারা সমস্ত ভুখন্ডের মালিক ছিলো, তারা তো আর আজীবন কাল যেমন বাচিয়া নাই, তাদের বংশ ধরেরাও হয়তো আর রাজ রাজাদের মতো বিলাশ বহুল জীবনেও নাই। আমি আরো অনেক ক্ষন সেই জোস্নাস্নাত রাতের আলোতেই ক্যাম্পের উঠোনে বসিয়া রইলাম। পাশেই কোনো এক বাদুরগোছের কোনো নিশাচর হয়তো একটা গাছ হইতে আরেকটা গাছের ডালে যাইবার জন্য কুহুকুহু শব্দের মতো শব্দ করিয়া স্থান পরিবর্তন করিলো। লোকচক্ষুর অন্তরালে, ঘুমন্ত পৃথিবীর চরনতলে, একা একা কত ঘটনা, কত ইতিহাস, কত যে, গল্প তৈরী হয়, তাহা অনেকের হয়তো জানা নাই কিন্তু জীবন্ত পৃথিবীর তুলনায় ঘুমন্ত প্রিথিবীতেই বেশির ভাগ ইতিহাসের সুত্রপাত।

আমি আকাশের দিকে চাহিয়া ভগবানকে দেখার চেষ্টা করিলাম। আসলেই কি ভগবান অই আকাশের উর্ধতলে থাকেন? নাকি তাহার বিচরন ওই আকাশের উর্ধতল থেকে শুরু করিয়া আমার ক্যাম্পের এই সেন্ত্রিপোষ্টের একটি খাম্বার পাশেও থাকেন, অথবা ওই যে বাজপাখীটা এইমাত্র স্থান পরিবর্তন করিলো ইহার মনের ভিতরেও আছেন। সারাটি পৃথিবীর মানুষ যখন ঘুমায়, ভগবানের এতো বড় দুনিয়ায় তখন হয়ত অন্য কোনো গ্রহে, অন্য কোন নক্ষত্রে কিংবা অন্য কোনো এক অপরিচিত জগতে আমার মতো হয়ত কেউ আরেকট নিউলংকার ক্যাম্পে মাঝরাতে বসিয়া সেই ভগবানের রহস্য লইয়া ভাবিতেছে। কে জানে। 

দুনিয়া বড় রহস্যময় স্থান। এর দিন আর কাল যেমন সদা পরিবর্তনশীল, জীবন ও একদিন সব কিছু পরিবর্তন করিয়া তাহার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়া স্থিত হইবে। তখন ইহার আগের ইতিহাস কেউ হয়তো আর মনেও রাখিবে না যেমন আজ থেকে হয়তো আরো ৫০ বছর কিংবা ৫ বছর পরে কেউ মনে রাখিবে না যে, আমি ঠিক এই স্থানে এক রাতে ঈশ্বরের কথা ভাবিয়া অনেকতা সময় পার করিয়াছি।