একটা অদ্ভুদ ঘটনা ঘটে গেলো আজ। লোকটাকে আমি চিনি না, কখনো দেখিও নাই। অথচ আজ আমার সাথে এমন একটা বৈঠক হলো তাঁর সাথে, যা আমি এতোদিন মনে মনে খুবই আশা করছিলাম। একটা ব্যবসা। আমি যেনো আজ সেটার একটা আলো দেখতে পেলাম। ব্যাপারটা কাক্তালীয়ভাবে ঘটে গেলো। মান্নান আমার ভাইতিজা। ও কিছুই করে না। অথচ সংসারটা বেশ বড়। আমাকে মান্নান গত কয়েকদিন আগে একটা ব্যাপারে ফোন করে বল্লো, কাকা, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। বললাম, তাহলে শুক্রবার দিন আসো মীরপুর যেখানে আমি বাড়ি বানাচ্ছি সেখানে। মান্নান আমার কন্সট্রাকসন সাইটে এলো দুপুর বারোটার দিকে। মান্নান যেটা বলতে এসেছিলো সেটা হলঃ
নাজিমুদ্দিন নামে আমাদের ইকুরিয়ায় একজন চেয়ারম্যান আছে যিনি বসুন্ধরা গ্রুপের সাথে জড়িত। নাজিমুদ্দিন আমাদের ওখানে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে জমি ক্রয় করেন, তারপর ওই জমি বসুন্ধরাকে লাভের উপর বিক্রি করে দেয়। তাতে প্রতি শতাংশে নাজিমুদ্দিন পাবলিককে দেয় এক লাখ টাকা, আর বসুন্ধরাকে বিক্রি করার রেট পায় সে আরো ত্রিশ হাজার টাকা বেশি। ফলে প্রতি বিঘায় সে নয় লাখ টাকার মতো লাভ করে। যেহেতু প্রতিটি লোকের কাছে নাজিমুদ্দিনের যাওয়া সম্ভব না, ফলে নাজিমুদ্দিন লোকালি কিছু এজেন্ট রেখেছে যারা প্রতি শতাংশে হাজার দশ টাকা কমিশন পায়, তারাই পাবলিকের কাছ থেকে জমি কিনে নাজিমুদ্দিনকে দেয়। তাতে নাজিমুদ্দিনের আসলে কোনো কাজই করতে হয় না কিন্তু ফাক দিয়ে প্রতি শতাংশ জমিতে বিশ হাজার টাকা লাভ পায়। বসুন্ধরা এখানে প্রায় কয়েকশত একর জমি ক্রয় করার কথা ভাবছে একটা হাউজিং করবে বলে। মান্নান চাচ্ছিল নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে এমন একটা এজেন্টগিরি যেনো পায়। মান্নানের পক্ষে এটা কিছুতেই সম্ভব না, কিন্তু আমি যদি নাজিমুদ্দিনকে বলে দেই, তাহলে এটা অনেক সহজ এবং নাজিমুদ্দিন মান্নানকে এজেন্ট করবে বলে ওর ধারনা। মান্নানের সাথে শামসুদ্দিন এবং জয়নাল নামের আরো দুজন ভদ্রলোক আছেন, যারা মান্নানের সাথে চলে আর এই বুদ্ধিটা আসলে এই দুই ভদ্রলোকই মান্নানকে দিয়েছে বলে মান্নান আমাকে জানালো। মান্নান আরো জানালো যে, সামসুদ্দিন সাহেব নাকি কোনো এক সময় আমার বড় ভাই হাবীব উল্লাহ্র সাথে ছোট বেলায় একসাথে কেএল জুবিলী স্কুলে পরাশুনাও করতো। যাই হোক, তিনি হাবীব ভাইয়ের সাথে পড়তো কিনা সেটা আমার যাচাইয়ের বিষয় নয়, আমার বিষয় হচ্ছে নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে মান্নানকে একটা এজেন্টশীপ নিয়ে দেওয়া।
আমি প্রাথমিকভাবে প্রথমে শামসুদ্দিন সাহেব এবং জয়নাল সাহেবের সাথে ব্যাপারটা বুঝার জন্য আমার বাসায় দাওয়াত করি। দেখলাম, ব্যাপারতা সত্য। তাদের কাছ থেকে এতা জানলাম যে, নাজিমুদ্দিন উক্ত এলাকায় একজন অত্যান্ত প্রতাপ্সহালী এবং পয়সাওয়ালা লোক। কিন্তু একেবারেই অশিক্ষিত। তাঁর অক্ষরজ্ঞান বলতে কিছুই নাই। আর সারাক্ষন মদ আর মেয়ের নেশায় থাকে। বিএনপি র রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাদের কাছে সব কথা শুনে আমারো নাজিমুদ্দিনের সাথে দেখা করার একতা ইচ্ছা জেগেছিলো। সেই সুবাদে আমি গত মিটিং এ এই সামসুদ্দিন এবং জয়নাল সাহেবকে বলেছিলাম, নাজিমুদ্দিন সাহেবকে আমার অফিসে দাওয়াত দেয়া যায় কিনা। তারা একতা আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং নাজিমুদ্দিন সাহেবকে আমার অফিসে নিয়ে আসবেন বলে কথাও দিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে আজ নাজিমুদ্দিন সাহেব আমার অফিসে এসেছিলেন। বিকেল তিনটায় মীরপুর এম পি গেট থেকে আমাকে এম পি ফোন দিয়ে জানালো যে, বেশ কয়েকজন গেষ্ট এম পি চেক পোষ্টে আমার কাছে আসতে চায়, তাদের একজনের নাম জনাব নাজিমুদ্দিন। আমি কাল বিলম্ব না করে বললাম, উনাদের আসতে দিন, আমারই গেস্ট।
উনারা আমার অফিসে এলেন, আমি ইউনিফর্ম পড়াই ছিলাম। ফিল্ড মেসে লুচী, মাংশ আর অন্যান্য ফলের অর্ডার দিয়ে বললাম, যতো তাড়াতাড়ি পারে যেনো সার্ভ করে। আমরা অফিসে আলাপে মগ্ন হলাম। জনাব নাজিমুদ্দিন, সামসুদ্দিন, জয়নাল সাহেব, মান্নান আর আরো একজন তাঁর সাথে ছিলো। বুঝলাম, নাজিমুদ্দিন সব সময় একতা দল নিয়ে চলে। ভীষন কালো রঙ এর চেহাড়া, বয়স প্রায় ৫০ এর উপর। লাল লাল চোখ। কিন্তু আদব কায়দা বেশ বুঝে। আমি কুশল বিনিময় করে উনার কথা শুনতে চাইলাম। কিছু বলার আগেই নাজিমুদ্দিন তাঁর কি কি আছে, কি করে, কোথায় আরো কি কি করবে লম্বা একটা ইতিহাস বলা শুরু করলেন। আমারো প্ল্যান ছিলো লোকটা সম্পর্কে জানা এবং বুঝা আসলে তাঁর কি ক্ষমতা আছে আর কি কি করতে পারে সেটা জানা। কথায় কথায় জানলাম যে, উনার অনেক ব্যবসা আছে। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা হচ্ছে বসুন্ধরার সাথে উনার পার্টনারশীপ। বসুন্ধরার যে মালিক জনাব শাহ আলম (আকবর সোবহান) তাঁর সাথে প্রায় হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট। তাঁর আরো গার্মেন্টস ব্যবসা আছে, ঢাকা টাওয়ারের মালিক উনি, শ্যামলী টাওয়ারের ও মালিক উনি। এটা আমাদের শ্যামলী তে অবস্থিত, যা এখনো আন্ডার কন্সট্রাকসন অবস্থায় আছে। এটার দেখভাল করেন বাবুল ভাই। যিনি আমার অফিসে বর্তমানে হাজির আছেন। বাবুল সাহেব আবার কেরানীগঞ্জের শাখা বিএন র সভাপতিও। এ ছাড়া উনার আরেকতা ব্যবসা আছে পাক-বাংলা সিরামিক। আছে একটা ফিল্ম স্টুডিও, যার নাম নাফিম নাদিম। সারোয়ার নামে এক ভদ্রলোক এই ফিল্ম স্টুডিওটার দেখভাল করেন। তিনিও আমার অফিসে আজ হাজির ছিলেন। গল্প করতে করতে নাজিমুদ্দিন সাহেব বললেন যে, যদিও তিনি একতা গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রিজের মালিক কিন্তু এটা এখন ভালো চলে না। প্রতিমাসেই শ্রমিকরা বেতনের জন্য আন্দোলন করে আর তাঁর বাসায় গিয়ে ঝামেলা করে। লুতফর রহমান নামে এক ভদ্রলোক ফ্যাক্টরীটা চালান কিন্তু সে ভদ্রলোক একজন জুয়ারী বলে যেমন কোনো মাল শিপমেন্ট করতেও পারেন না, আর যে সাব কন্ট্রাক্ট করেন সেই টাকা শ্রমিকদের না দিয়ে নিজেই নিয়ে নেন। কারেন্ট বিল পেন্ডিং, গ্যাস বিল পেন্ডিং, শ্রমিকদের সেলারী পেন্ডিং। বেশ লসে আছেন। তাঁর মধ্যে আবার সোসাল ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাংকে বড় একটা লোন রয়ে গেছে যেটা গার্মেন্টস চালিয়ে পরিশোধ করার কথা কিন্তু তারা কেউ এটা করছে না। তিনি চাচ্ছেন এখন এই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিটা কাউকে দিয়ে দেবার জন্য। আমি তাঁর কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম আর অন্য কিছু মনে মনে ভাবছিলামও।
বুঝলাম, নাজিমুদ্দিন সাহেব গল্প করার মানুষ, খারাপ না তবে তাঁর সাংগপাংগরা একেবারেই যে ভাল মানুষ নয় সেটা বুঝতে আমার সময় লাগে নাই। নাজিমুদ্দিন সাহেব আমার উপর একদিনেই মনে হলো খুব খুশী। কথায় কথায় বলেই ফেললেন, মিয়া ভাই, দেখেন না আপনি ফ্যাক্টরিটা চালাইতে পারেন কিনা। শুনলাম, আপনি নাকি আর চাকুরী করতে চান না, যদি মনে করেন যে, আমার এই ফ্যাক্টরিটা চালাইতে পারবেন, তাহলে নিয়াই নেন। আমিও বেচে যাই।
আমি আসলে এমন একটাই পথ খুজতেছিলাম মনে মনে। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। আমি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে বললাম, যদি আমি নেই তাহলে কিভাবে আপনি দিতে চান? নাজিম ভাই আমাকে জানালেন, আপনি একাও চালাতে পারেন আবার আপনি আমাকে রেখেও চালাতে পারেন। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে অনেক কিস্তি পেন্ডিং হয়ে আছে, সেটা রিসিডিউল করতে হবে। রিসিডিউল কি আমি সেটাই তো বুঝি না। এটা একটা ব্যাংকিং টার্ম ব্যবসার সাথে জড়িত। হয়তো ব্যাংকে গেলে এ ব্যাপারে আরো বিস্তারীত জানা যাবে। আমরা যারা আর্মিতে চাকুরী করি বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করি তারা ব্যবসার সাথে জড়িত অনেক ব্যাংকিং ফর্মালিটিজ আসলেই বুঝি না। এগুলি বুঝে তারা যারা সরাসরি ব্যবসার সাথে জড়িত।
আমি নাজিম ভাইকে বললাম, তাহলে আমি ফ্যাক্টরীটা সরে জমিনে দেখতে হবে। কি অবস্থায় আছে, কি করা দরকার, ব্যাংকিং সেক্টরে কি কি সমস্যা আছে, সব জেনে আমি জানাতে পারবো আসলে আমি চালাতে পারবো কিনা। তিনি আমাকে বললেন যে, এখন বর্তমানে জনাব লুতফর রহমান চেয়ারম্যান হিসাবে ফ্যাক্টরী চালায়, আর সেটা পুরুটাই সাব কন্ট্রাক্ট বেসিসে। কিন্তু লুতফর রহমান সাহেব নাজিম ভাইকে এ ব্যাপারে কিছুই জানায় না। ব্যাংকের লোন গুলিও পরিশোধ করে না, আবার সময় মতো শ্রমিকদের বেতন ভাতাও দেয় না। এই মিলে প্রতিমাসেই শ্রমিকরা আন্দোলন করতে করতে তাঁর বাসায় গিয়া হাজির হয়, অপারগ হয়ে শেষ পর্যন্ত নাজিম ভাইকেই তাঁর অন্য সোর্স থেকে তাদের পারিশ্রমিক দিতে হয়। ওখানে লুতফর রহমানের সাথে নাজিম ভাইয়ের একজন আত্তীয় তৌহিদ নামের একটি ছেলে প্রোডাক্সনের কাজ করে। তাঁর সাথে কথা বললে হয়তো আরো বিস্তারীত জানতে পারবেন।
আমি নাজিম ভাইকে বললাম, যে, আমার যেহেতু এই মুহুর্তে গাড়ি নাই, আগামীকাল যদি কাউকে দিয়ে আমাকে একতা গাড়ির লিফট দিয়ে ফ্যাক্টরী পরিদর্শন করানো যেতো, হয়তো আমি ব্যাপারটা নিয়ে আরো একটু সিরিয়াসলী ভাবতে পারতাম। তিনি রাজী হলেন পরেরদিন গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন বলে।
নাজিম উদ্দিন ভাইয়ের সাথে কথা বলার পর রাতে আমি তৌহিদের সাথে অনেক ক্ষন টেলিফোনে কথা বললাম, জানলাম, বুঝলাম যে, ফ্যাক্টরিতে এক সময় কারা কারা ছিলো, তখন কত লাভ হতো, অনেক ভালো একটা পজিসনে ছিলো, আর এর মধ্যে অনেক শেয়ার হোল্ডার মালিকগন ছিলেন, যারা ধীরে ধীরে সরে গেছে। বর্তমানে শুধু লুতফর রহমান আর তাঁর ভাই বাবলুর রহমান ১৫% করে মোট ৩০% শেয়ার নিয়ে চেয়ারম্যান-ডাইরেক্টর আর নাজিমউদ্দিন সাহেব ৭০% শেয়ার নিয়ে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসাবে আছেন। তৌহিদের ভাষ্য অনুযায়ী যা বুঝলাম যে, যদি আমি আগে যারা এখানে মার্কেটিং এর কাজ করতো তাদের কাউকে আনা যায়, তাহলে এই ফ্যাক্টরী পুনরায় চালু করা কোনো ব্যাপার না। তাছারা নাজিম ভাইয়ের টাকার কনো সমস্যা নাই, সে যদি থাকে তো কোনো সমস্যাই না। নাজিম ভাইয়ের দরকার শুধু ঠিক মতো ফ্যাক্টরীটা যেনো চলে। তাকে লাভ দিতে হবে এমন নয়। আর সবচেয়ে আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে যে, ফ্যাক্টরীর ভাড়া দিতে হয় না যেহেতু এটা নাজিম সাহেবের নিজস্ব বিল্ডিং। তৌহিদের সাথে কথা বলে আগামীকালের সময়টা ঠিক করলাম, কিভাবে কিভাবে আগানো যায়। একতা পরিকল্পনাও কাগজের মধ্যে লিখে নিলাম।