১৯/০৩/২০২১- তৃতীয় নয়ন

Categories

আমি একটা কাজ বহুদিন ধরে করছি। আমার জীবনের এমন একটা অধ্যায় যেটা কেউ জানে না। আর আমার বেচে থাকাকালীন কেউ জানবেও না। আর আমার মৃত্যুর পরেও কেউ জানবে না। এটা একটা রহস্য যা কেউ জানতো না, আর জানবেও না। এ রকমটাই আমি ভাবতাম কিন্তু এমনটা কি হবার ছিলো? কখনো কখনো যেটা আমরা শুনি, সেটা শুধু গল্পে হয়। বাস্তবে নয়। কখনো কখনো আমাদের চোখে যেটা দেখা যায় সেটা সবসময় সত্যি হয় না। এটাও হতে পারে সেটা সত্যি একটা প্রতিচ্ছবি।

আমি সব সময় সবার ভালো ভাবে থাকার চেষ্টা করতাম। ভালো কাজ করারও চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমি সব সময়ই একা ছিলাম। তবে আমার একটা এফেয়ার্স ছিলো। আমি চাইলেই সেটা বাস্তবে রুপ দিতে পারতাম না। কারনও আগে থেকেই ছিলো বিবাহিত। কেউ যদি এখন আমাকে প্রশ্ন করে, কেনো আমি এটা বলছি? আমি কি সজ্ঞানে আছি? না, আমি সজ্ঞানে নাই, আমি নেশার মধ্যেও নাই কিন্তু আমি ওর জন্যই একা আর নেশাগ্রস্থ। আজ ও নাই। আমি পুরু ভেংগে পড়েছি। আমি কোনো সাফাই গাইছি না এখন। না কাউকে কোনো দোষারুপ করছি।

যেদিন আমি ওকে প্রথম দেখেছিলাম, আমি জানতাম, ওর উপরে আমার নজর ছিলো, কিন্তু আমি জানতাম না যে, কোনো একদিন সেও আমাকে তার নজরে রাখবে। একদিন বুঝলাম, আমার উপরে ওর নজর আছে, ছিলো, আর ও আমার উপর থেকে কখনো নজর সরায় নাই। ও আমাকে অনেকবারই বলেছিলো, ও আমার হাত ধরেছে, যদি আমি ছাড়াতে চাই, সেটা ছিলো আমার স্বাধীনতা। আমিও ওকে ছাড়তে চাই নাই কখনো। আসলে কিছু জিনিষ আমরা শুরু করি না, শুরুটা হয়েই যায়। এটাই সত্যি যে, আমরা কাউকে কেউ আটকাতে পারি নাই। আমরা দুজনেই দুজনের প্রয়োজনীয়তা পুরুন করছিলাম। কোনো সম্পর্কই ভাংগার আমাদের ইচ্ছে ছিলো না।

আমি তো আমাকে বুঝতেই পারি নাই কখনো। কে আমি, কি আমি, কার আমি, কোথাকার আমি কিছুই না। শুধু গায়ে গতরে বেড়ে উঠেছিলাম। এই পুরু পৃথিবীতে এমন কেউ নাই, যে বা যারা সবাই সবার ব্যাপারে পুরুটা জানে। আমরা নিজেরাই নিজের ব্যাপারে সবকিছু জানি না। আমি তো আমাকে সবেমাত্র চিনতে শুরু করেছিলাম যেদিন আমি প্রথম ওর কাছে আসি। তারপর থেকে আই আমার জীবনের গন্তব্য ঠিক করে ফেলেছিলাম। আমি কোথাও আর যাচ্ছি না। অনেকেই আমাকে এই প্রশ্নটা করেছে, কেনো আমি বিয়েটা করছি না। একজন অবিবাহিত মানুষ আমি, যুবতী, সুন্দুরীও। আর আমার মর্জিটা আমার কাছেই ছিলো। বিয়ে তো করতেই পারতাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত কি করেছি, কি করছি, কি করছি না সেটাও তো আমি জানি না। আমি আমার এই সম্পর্কটা থেকে যা পাচ্ছিলাম, তার থেকে বেশী কিছু আমি নিজেও চাইতাম না। আমার জন্য সব কিছুই যথেষ্ঠই ছিলো। কোনো প্রকারের হতাশা, জটিলতা কিছুই ছিলো না আমার শুধু গোপনীয়তা ছাড়া। একে অন্যের অপরিচিতের মতো একটা অভিনয়।

ওর সাথে আমার বিবাহীতমালা কোনো সামাজিকভাবে হয়তো হয় নাই কিন্তু এটা যে সর্গীয় সেটা আমার মনে প্রানে বিশ্বাস তো সব সময়ই ছিলো। ওর সাথে আমার এই নিষ্পাপ এফেয়ার্স, অন্তত আমার তরফ থেকে নিষ্পাপ, একটা কঠোর বাস্তব। আমি ওর সাথে সংসার করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওর সংসার ভেংগে নয়। সংসার তো করছিলাম, তাহলে যে খেলনাটা একবার ভাংগে নি, সেটাকে আবার ভেংগে জোড়া লাগানোর কোনো প্রয়োজন আমি মনে করি নাই।

ও একা ছিলো। এতোটা বছর একসাথে থেকেও ও ওর পরিবারের কেউ হতে পারে নাই। সবাই ওকে ব্যবহার করতো কিন্তু ওর যে একটা ব্যক্তিগত জীবন ছিলো যেটার কেউ নাগালেই পেতো না বা নাগাল পাওয়ার চেষ্টাই করতো না। তা না হলে দিনের পর দিন যখন একটা মানুষ তার শারীরিক চাহিদার কথা ভুলে যায়, আর এটা যখন তার পরিবার মাথায় নেয় না, তাহলে তো বুঝতেই হবে এর মধ্যে বিস্তর একটা ফারাক রয়ে গেছে। ফলে ও নিজের একাকিত্তকে অন্য কোথাও সংগ দেয়ার চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা যেনো ঠিক এ রকমের যে, ডান হাতের কোনো খবর ছিলো না যে, বাম হাত কি করছে। একটা জীবনের দুটু আলাদা আলাদা অধ্যায়। এই দুটু জীবনের মধ্যে একটা জীবন যখন অতি দুক্ষকষ্টে ভরে উঠে, এটা কখনোই সম্ভব নয় যে, এর প্রভাব দিতীয় জীবনে পড়বে না। হয়তো ও অনেক ব্যালান্স করেছে বলে শেষ অবধি একটা জীবনের সাথে আরেকটি জীবনের প্রভাব পড়তে দেয় নাই, মাঝে সেইই বেশী পুড়েছে।

আর আমিও একাই ছিলাম। ও কারো সংগ চাইছিলো। আমারো ওকে দরকার ছিলো।  এই দরকারটা শুধু শরীরের নয়, দরকারটা আমার অস্তিত্তের। কোনো সম্পর্কই খেলনা নয়। তারপরেও আমরা খেলনার মতোই খেলি। আমাদের মধ্যে যা ছিলো, সেটা সব ঠিক ছিলো, শুধু আমরা সংসারটা পাতি নাই। আমি ওর ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে কখনো কৈফিয়ত চাইতে চাই নাই, না চাইতে ভালো লাগতো। কিন্তু আমি আমার জায়গা থেকে সম্পুর্ন সঠিক ছিলাম, একাগ্রচিত্তেই আমি সব মেনে নিয়েছিলাম। আমি ওকে একজন ভালো বন্ধু, ভালো স্বামী আর ভালো গার্জিয়ান হিসাবেই সব সময় মেনে নিয়েছিলাম, সেটা আজো আমার মধ্যে বিদ্যমান। আমার মাথা আর মন দুটুই পরিষ্কার ছিলো।

মানুষ যখন ভালো কাজ করে, তখন তার নাম লিখতে হয়। চিৎকার করে বলতে হয়, আর গর্ব করে বলতে পারে এই কাজটা আমি করেছি। সাইন বোর্ড দেয়, পোষ্টার লাগায়। নাম জাহির করে। কিন্তু কোনো লজ্জাজনক কাজ যদি ভুল করেও হয়ে যায়, এটা লক্ষবার লুকিয়ে রাখে, চেপে যায়, তা না হলে এটা বারুদের মতো শির শির করে ততক্ষনাত চারিদিকে জলে উঠে। ও সাহসী ছিলো, কিন্তু নিজের মান সম্মান আর পরিবারের কথার বাইরেও আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে সে এমন কোনো কাজ করে নাই যাতে আমি শেষ হয়ে যাই, আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, আমি কষ্টের মধ্যে পড়ি। ও আমার সব কিছু সবার কাছেই লুকিয়ে আমাকে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করেছে। আমার এই সামাজিক লজ্জাষ্কর কাজটা লুকানোর জন্য তো কিছু মানুষ আমারো ছিলো যারা আমাকে বুঝতো, আমাকে ভালোবাসতো, আমাকে স্নেহ করতো আর আমাকে অন্তত সামাজিকভাবে কিছুটা হলেও শান্তি দেয়ার চেষ্টা করতো। আর সেটা ছিলো আমার পরিবারের কিছু লোক।

ও একটা অনেক ভালো লোক ছিলো, সে কখনো আমাকে ঠকায় নাই। আজ আমার সাথে ওর এই এফেয়ার্সের কারনে হয়তো অনেকেই এক কথায় বলেও উঠতে পারে যে, ওর মতো আর একটাও খারাপ মানুষ নাই। কিন্তু আমি লিখে দিতে পারি, আমি চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে সবার সামনে উচু গলায় বলতে পারি, ওর মতো ভালো মানুষ আর একটাও ছিলো না। আমি মানুষকে বুঝতে শিখেছিলাম ওর মাধ্যমেই। আমি কাউকে দেবী বা ডাইনী রুপেও ভাবি না। ও শুধু আমাকে সবার অলক্ষে সবার উপরে মাথা উচু করে দারাতে শিখিয়েছিলো। আজ ও নাই, কিন্তু আমি জানি যে, ও আমার হাত এখনো ধরেই রেখেছে। আপ্নারা হয়তো শুনেছে, জীবিত মানুষ একে অপরের ভরষা কিন্তু কখনো শুনেছেন যে, মৃত মানুষ তার থেকেও অনেক বেশী ভরষার? আমার বেলায় এতাই সত্যি।

আজ ও ওর সমস্ত একাকীত্ব, আর বেদনা ওর সাথেই নিয়ে গেছে। আমি শুধু ওর স্রিতিটা ধরে রেখেছি আর রাখবো আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। কারন, আমি ওর ছিলাম, আছি, থাকবো। আমার আমিত্ত আসলে ও নিজেই।

ও শুধু আমার বন্ধু ছিলো না, ও ছিলো আমার শিক্ষক, আমার স্বামী, ও ছিলো আমার বাবা, ও ছিলো আমার মা। আমি ছিলাম ওর স্ত্রী, মেয়ে অথবা বলতে পারেন একটা আদরের বিড়ালের মতো জ্যান্ত খেলনা।