Categories
৪১ বছর আগের ঘটনা।
আজ হইতে প্রায় ৪১ বছর আগে এইদিনে আমি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার জন্য সকাল হইতেই প্রস্তুতি লইতেছিলাম। আজ আমার ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার দিন, অর্থাৎ আমি ১৯ শে জুন ১৯৭৭ সালে ক্যাডেট কলেজে পদার্পণ করিয়াছিলাম।
অজ একটা পাড়াগ্রাম। স্বাভাবিক জীবন যাত্রার জন্য একটি জনপদের যে সব মৌলিক উপাদান কোন একটি জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য সেইসব মৌলিক চাহিদা কোনো কিছুই এই অজ পাড়াগ্রামের কোথাও চোখে পড়ে না। বিদ্যুৎ নাই, রাস্তা ঘাট নাই, ভালো একটা মাধ্যমিক স্কুলও নাই। রাজধানী ঢাকা হইতে আমার গ্রাম এতো কাছের একটা জনপদ, তাহার পরেও কোনো পাকা রাস্তা নাই যাহাতে কেহ জরুরী ভিত্তিতেও রোগী লইয়া বা অন্য কোনো ইমারজেন্সি হইলে গাড়ি করিয়া সল্প সময়ে ঢাকার কোনো জায়গায় আসিতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ। মাত্র ৫/৬ বছর পার হইয়াছে ইহার স্বাধীনতার বয়স। মানুষ সবেমাত্র স্বাধীনতার স্বাদ পাইতে শুরু করিয়াছে, কিন্তু সবকিছুই নতুন। নতুন স্বাধীনতার একটা রুপ আছে। এই স্বাধীনতায় যে যেইভাবে পারে, সে সেইভাবেই তাহা উপভোগ করে। কেউ গায়ের জোরে, কেউ অস্ত্রের জোরে, কেউ সম্পত্তির জোরে, কেউ পারিবারিক প্রভাবের জোরে একজন আরেকজনের উপর, একগোত্র আরেক গোত্রের উপর কিংবা এক গ্রাম আরেক গ্রামের উপর প্রভাব খাটাইয়াই স্বাধীনতা উপভোগ করে। আর এই নব্য স্বাধীনতাই আমাদের প্রতিটি গ্রামে, গঞ্জে, আনাচে কানাচে পালিত হইতেছে। কেউ হটাত করিয়া বড়লোক হইয়া যাইতেছে, কেউ আবার সবকিছু হারাইয়া দেশান্তরী হইতেছে। মেলথাসের কোনো থিউরী, কিংবা নিউটনের ৫ম সুত্র কিংবা ডারউইনের নতুন কোনো সুত্র না হইলে যেনো আর রক্ষা নাই। কেউ নতুন সেটেলার হিসাবে নিজের পিতামহের আদি আবাসস্থল ছাড়িয়া অন্য কোনো নতুন জায়গায় তাহার আবাসস্থল গড়িয়া তোলার আপ্রান চেস্টা করিতেছে আবার কেহ কোথাও কোনো স্থান না পাইয়া এই ইহজগত হইতেই বিদায় লইতেছে। নিয়তি বলিয়া একটা কথা আছে, কেউ এটা মানুক আর নাই বা মানুক। সবাই নিয়তির দিকে তাকাইয়া সামনের দিকে চলিবার ভান করিতেছে। ঘরের পালিত পশু পাখিরাও যে কে কাহার, তাহারাও মাঝে মাঝে বিতর্কিত হইয়া কখনো এই মালিকের গোহালের থেকে অন্য মালিকের গোহালে স্থান পরিবর্তন করিতেছে। তাহারা তাহাদের মুখের ঘাস গুলিও চর্বণ করিবার সময় পাইতেছে না।
আমরা গ্রামে থাকি। গ্রামের বাড়ী যেই রকম হয়, আমাদের গ্রামের বাড়ীটিও সেই রকমের। মাটির উঠোন, চারিদিকে গাছ পালার সমারোহ, কাচা পায়খানা, পাশেই ক্ষেত, হরেক রকমের ফসলের শোভা দেখা যায়। সন্ধ্যা হইলেই বাবুই পাখী, চড়ুই পাখী এবং তাহাদের আবাসস্থলে বেড়াইতে আসা অনেক নাম না জানা অতিথি পাখিরা মিলে হরেক পদের সুরে এবং শব্দে মুখরীত করিয়া তোলে এলাকাটি। তাহারা একে অন্যকেকে লইয়া ঝগড়া ঝাটি করে না। তাহাদের স্বাধীনতা আমাদের মতো নয়। তাহারা জমি লইয়া, বাড়ি বা বাসা লইয়া ভাগ বাটোয়ারা লইয়া মারামারি করে না। উহারা শরত কালে যেমন একে অপরের বন্ধু, বৃষ্টির দিনেও একে অপরকে ছাড়িয়া চলিয়া যায় না। পাখীরা সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার বলিলে ভুল হইবে। আমাদের উপার্জনক্ষম সদস্য বলিতে একমাত্র আমার বড় ভাই যিনি সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসাবে যোগদান করিয়াছেন। প্রাচ্যের বিশ্ববিদ্যালয় এই ঢাকা ইউনিভার্সিটি। আমরা পাচ বোন আর দুই ভাই, সাথে আমার মা। সংসার ছোট নয়, কিন্তু সে তুলনায় আয়ের পরিমান আমাদের জন্য অনেক ছিলো না। এইটা তখনকার দিনের প্রায় অধিকাংশ পরিবারেরই হালচাল।
আমার বড় ভাইয়ের নিজস্ব একটা পরিকল্পনা ছিলো কিন্তু আমরা যাহারা ছোট ছোট ভাই বোন আছি, তাহাদের জন্য আমার ভাইয়ের নিজস্ব পরিকল্পনায় অনেক ব্যঘাত ঘটিতেছিলো। আর ইহার প্রধান কারন হইলো, তিনিই আমাদের মা, তিনিই আমাদের বাবা, তিনিই আমাদের দেখভাল করার জন্য একমাত্র ব্যক্তি। তাহার নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করিতে গিয়া তিনি আমাদেরকে ছাড়িয়া একা কোথাও যাইতে পারেন না। ফলে আমাদের একটা গতি না করিয়া তিনিই বা কিভাবে তাহার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করিবেন? আমি সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ি, আমার ইমিডিয়েট বড় বোন আমার সাথেই গ্রামে পড়াশুনা করে। আমার আরেক বোন আমার থেকে এক ক্লাস উপরে পড়ে আর তার বড়জন পড়ে মাত্র ক্লাস এইটে। সবার বড় দুই বোন এর মধ্যে একজন স্বামীর সাথে পৃথক হইয়া এখন আমাদের বাড়িতেই থাকেন। আমার দ্বিতীয় বড় বোনের তখনো বিয়েই হয় নাই। ফলে ধরিয়া নেওয়া যায়, পাচ বোনের কারোরই বিয়ে হয় নাই। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই সুস্থ নয়। মেয়েঘটিত অনেক প্রকারের অঘটন চারিদিকে ঘটিতেছে। আমরা আছি একটা বিপদের মধ্যে। আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নাই। দেশ স্বাধীন হইয়াছে বটে কিন্তু দেশের মানুষগুলি এখনো আতংকের মধ্যেই দিন কাটাইতেছে।
যাই হোক যাহা বলিতেছিলাম সেখানেই আসি। আমার ক্যাডেট কলেজের ভর্তির কথা।
আমার বড় ভাইয়ের নিজস্ব পরিকল্পনায় যাহা ছিলো তাহা হইলো যে, আমাকে কোনো একটা ভালো আবাসিক স্কুল কিংবা কলেজে স্থায়ীভাবে ভর্তি করাইয়া দিতে পারিলে আমার ব্যাপারে তিনি দুশ্চিন্তা মুক্ত হন, আর আমার সবগুলি বোনকে বিয়া দিতে পারিলে পুরু পরিবারকে নিয়া তিনি শংকামুক্ত হন। আর এই শংকামুক্ত হইতে পারিলেই তিনি একান্ত নিশ্চিত হইয়া তাহার পিএইচডি করিবার লক্ষে বিদেশে স্কলারশীপ লইয়া বাইরে চলিয়া গিয়া নিজের ক্যারিয়ার তৈরী করিতে পারিবেন, অন্যথায় ব্যাপারটা সফল হইবে না। অনেক কঠিন কাজ এবং এই সবগুলি কাজে একের পর এক সাফল্য আসিলেই তিনি তাহার পরিকল্পনায় সার্থক হইবেন। কোনো একটা কাজে সাফল্য না আসিলে সেখানেই তাহার মহা পরিকল্পনা ভেস্তে যাইতে পারে এবং বড় ধরনের একটা হুমকী হইয়া দাড়াইবে।
ফলে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে আমি। আমি গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করি। গ্রামের স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিলেই যে কেউ খুব মেধাবী বলিয়া প্রমানিত হয়, তাহা কিন্তু মোটেও সত্য নয়। তবে আমি নাকি বেশ মেধাবী ছিলাম ইহা আমাদের স্যারেরা বলিতেন। আর এই মেধাবীত্ব প্রমানের লক্ষে মাঝে মাঝে আমার শিক্ষকগন আমাকে দিয়া আমার থেকে ছোট ক্লাসের তাহাদের ক্লাশ গুলি নেওইয়া লইতেন। তাহাতে স্যার দের দুইতী লাভ হইতো। অনায়াসেই স্যারেরা স্কুলে না আসয়া নিজের পরিবারের জন্য বাজারের দিন বাজার করিতে পারিতেন, কিংবা বৃষ্টির দিনে বাসায় বসিয়া ভুনা খিচুড়ি খাইতে পারিতেন।
একদিন ভাইয়া গ্রামে আসিয়া আমাকে কাছে টানিয়া বলিলেন, তোকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হইতে হইবে। আমার জীবনে এমনিতেই আমি আমার গ্রামের স্কুলের নাম ছাড়া অন্য কোনো স্কুল কলেজের নাম পর্যন্ত শুনি নাই, সেখানে ক্যাডেট কলেজ কি তাহাই তো জানি না। আমি আমার এই তথাকথিত মাথার অভ্যন্তরের সবগুলি প্রকোষ্ঠ খুজিয়া কোথাও ক্যাডেট কলেজের কোনো তথ্য আমার মাথার মধ্যে সন্ধান পাইলাম না। কি করিয়া জানিবো ক্যাডেট কলেজ জিনিসটা কি? আমরা সবাই ভাইয়াকে খুব ভয় পাইতাম, কিন্তু এই ভয়ের মাঝেও আমি একটু এরোগ্যান্ট ছিলাম বলিয়া বুঝিয়াই হোক আর না বুঝিয়াই হোক, একটু আধটু ঘাউরামীও করিতাম। আমার বড় ভাই আমার এই এরোগেন্সিটাকে কখনো বেশ করিয়া উপভোগ করিতেন আবার কখনো কখনো রাগে এমন শাসন করিতেন যে, গায়ে হাত দিতে একটুও কার্পণ্য করিতেন না। যেনো আমি তাহার নিজের কোনো সম্পদ, যখন যাহা খুশী তাহাই করিতে পারেন। কিন্তু অনেক পরে আমি বুঝিয়াছি, আমি শুধু তাহার সম্পদই ছিলাম না, আমি ছিলাম তাহার অন্তর। তাহার শাসনে আমি যতোটা না ব্যথা পাইতাম, আমার ভাই তাহা হইতে অধিক আঘাত পাইতেন বলিয়া আজ মনে হয়। আমি আমার বড় ভাইয়ের এই শাসনটা আজ খুব মিস করি। ভাইয়ার ক্যাডেট কলেজের ভর্তির কথায় আজ এরোগ্যান্ট হইবার কোনো কারন আমি দেখিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, ক্যাডেট কলেজ কি জিনিস ভাইয়া?
ভাইয়া বলিলেন, সমস্ত বাংলাদেশ হইতে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য ছেলেরা পরীক্ষা দেয়। হইতে পারে এক লাখ ক্যান্ডিডেট, হইতে পারে তাহার থেকেও বেশি, কিন্তু সবগুলি ক্যাডেট কলেজ মিলাইয়া ছাত্র ভর্তি করে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জন প্রতি ক্যাডেট কলেজে। তখন দেশে মাত্র চারটি ক্যাডেট কলেজ ছিলো। মেয়েদের জন্য কোনো ক্যাডেট কলেজ ছিলো না। ৪০ বা ৫০ জন সাফল্যবান ছাত্র এক বা দুই লাখ ছাত্রের মধ্যে কত অনুপাত তাহা আমার জানা ছিলো না, কিংবা ইহা কতটা কঠিন কাজ তাহাও আমার বুদ্ধিতে নাই, ফলে ইহা লইয়া আমার কোনো মাথা ব্যথাও ছিলো না। ভাইয়ার একটা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ছিলো যে, আমি যদি ইচ্ছা করি, এবং নিজে চেস্টা করি তাহা হইলে যে কোন কাজ আমার দ্বারা সাফল্য আসিবে। আমার উপর ভাইয়ার এই আত্মবিশ্বাসটা অনেক গভীরে পোতা ছিলো যা আমি নিজেও কোনোদিন জানিতাম না। তবে এইটা বুঝিতাম যে, আমি পারবো ইনশাল্লাহ। আমার আত্মবিশ্বাস আমার থেকে আমার উপর আমার বড় ভাইয়ের বেশী ছিলো।
আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য আমাকে কি কি করিতে হইবে? ভাইয়া অতি আদরের সহিত আমার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, ভর্তি পরীক্ষা হইবে, মেরিট লিস্ট অনুযায়ী ছাত্র ভর্তি করা হয়। যারা ভালো করিবে এবং পাশ করিবে এবং এই সীমিত সংখ্যক সিটের জন্য কোয়ালিফাই করিবে তাহারাই ভর্তি হইতে পারিবে। কোনো রিকুয়েস্ট বা তদবির চলে না এই ক্যাডেট কলেজ গুলিতে ভর্তি হবার জন্য।
আমি ভাইয়াকে কি ওয়াদা করিয়াছিলাম, আমার আজো স্পষ্ট মনে আছে। বলিয়াছিলাম, ভাইয়া, যদি পরীক্ষা দিয়া ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়া যায়, তাহা হইলে আমি ভর্তি হইতে পারিবো। ভাইয়া বলিলেন, ইনশাল্লাহ বল। আমি বলিলাম, ইনশাল্লাহ। আমি ছোট, ইনশাল্লাহ বলিলে কতটুকু সাফল্য আসে, তাহা আমার জানা নাই, তবে সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসেঅনেক কাজ তিনি সহজ করিয়া দেন, ইহাই আমার গুরুজনেরা আমাকে শিখাইয়া দিয়াছেন।
আসলে আমি কি কারনে এতো জোর দিয়া সাফল্যের কথা বলিয়াছিলাম, আমি আজো জানি না কিন্তু আমার মনে হইয়াছিলো, এইটা কোনো ব্যাপারই না। ভাইয়া শুধু আমার কথাতে খুশীই হইলেন না, তিনি জানিতেন, আমি পারবো। এখন শুধু আমাকে পারার জন্য সুযোগ করিয়া দিতে হইবে।
ভাইয়া আরো বলিলেন, দেখ, ভর্তি পরীক্ষার সময় আছে আর মাত্র ৩৯ দিন। বিশাল সিলেবাস, কোথা থেকে কি আসিবে পরীক্ষায় কেউ জানে না, কিন্তু এরই মধ্যে পাশ করিতে হইবে। এখানে পাশ করিবার কোনো নম্বরের লিমিট নাই। প্রথম হইতে মাত্র ৪০/৫০ জন। মেধা তালিকার এই একটা অসুবিধা।
আমার প্রস্তুতির মধ্যে প্রথম ধাপ শুরু হইলো আমার হাতের লেখার অনুশীলন দিয়া আর তাহার সাথে ক্লাস সিক্স, সেভেন এবং এইটের সব বই পড়িয়া ফেলা দিয়া। পৃথিবীর সব দেশের রাজধানীর নাম হইতে শুরু করিয়া রাস্ট্রপ্রধানদের নাম, মুদ্রার নাম, আরো অনেক কিছু। তাহার মানে সাধারন জ্ঞ্যান বলিতে যাহা বুঝায় তাহা আয়ত্ত করা। আমি আজো বুঝি না, এই বয়সে ঘিনির রাস্ট্রপ্রধান ইয়াসিন সাহেব না হইয়া আলিম সাহেব হইলেই বা কি আর লন্ডনের মুদ্রার নাম পাউন্ড না হইয়া টাকা হইলেই বা কি? তাহাতে ক্যাডেট কলেজের মেধার সহিত কি পার্থক্য হয়? তাহা হইতে যদি বলিতো, লও একটা ফুটবল, দেখি কত জোরে লাথি মারিয়া কত দূর নিয়া যাইতে পারো, অথবা একটা গাছে উঠিয়া চড়ুই পাখীর বাসা হইতে একটা আস্ত ডিম পারিয়া কত তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিতে পারো দেখাও দেখি? সেইটাই হোক তোমার পরীক্ষা। অথবা যদি বলিতো যে, দেখি দম বন্ধ করিয়া কে কতক্ষন থাকিতে পারো? কিংবা যদি বলিতো, বৃষ্টিতে কে কতোক্ষন ভিজিয়া চুপচাপ বসিয়া থাকিতে পারো, এইটাই তোমাদের পরীক্ষা। যাই হোক, ভর্তি পরীক্ষার গুরুজনগন আমাদের থেকে বেশি মেধাবি বলিয়া তাহারা ফুটবল খেলিতে পছন্দ করেন না, তাই ফুটবল ১০০ গজ গেলেই কি আর ৫০০ গজ গেলেই কি। অথবা তারা বয়স্ক হইয়া যাওয়াতে বৃষ্টিতে ভিজার নাম শুনিলেই তাহাদের যাহার কথা প্রথমে স্মরণ হয় তিনি হচ্ছেন ডাক্তার। অহেতুক এই মেধা পরীক্ষা লইতে গিয়া ডাক্তার বাবুদের টানিয়া আনা খুব সমিচীন বলিয়া মনে হয় না। ফলে এইসব বিষয় সিলেবাসে সংযোগ করিয়া নিজেদের ক্ষতি করিবার কোনো কারন তাহারা দেখেন না। যাক, সিলেবাসের মধ্যে এখানেই শেষ নয়। ইংরেজীতে কথা বলার অনুশীলন করা, ইহার সাথে প্রতিদিন সকালে শারীরিক ব্যায়াম করা এইগুলাও নাকি আছে। এতোসব তো আর গ্রামে বসিয়া করা সম্ভব নয়। তাই আমার ট্রান্সফার হইয়া গেলো গ্রাম হইতে শহরে, খোদ ঢাকা ইউনিভার্সিটির চত্তরে, শহিদুল্লাহ হলে। আমার ভাই শহিদুল্লাহ হলে থাকিতেন, সেখানে। ভাগ্যের কি পরিহাস, ক্যাডেট কলেজে পরীক্ষা দিতে গিয়া প্রথমেই ইউনিভার্সিটিতে পদার্পন।
আমি যেইখানে ভাইয়ার সাথে থাকিতাম, সেইখানে তখন আমার ভাইয়ের সব কলিগরা থাকিতেন। সেকুল ভাই (ঢাকা ইউনিভারসিটির এপ্লাইড ফিজিক্সের লেকচারার, আমি জানি না তিনি এখন কোথায় আছেন, আবু সুফিয়ান ভাই, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ম্যাথ লেকচারার সম্ভবত, তাহার সাথেও আর কখনো যোগাযোগ হয় নাই আমার, এবং আরো অনেকে)। পাশেই ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকিতেন সেই বিখ্যাত লেখক হুমায়ুন ভাই (রসায়নের লেকচারার) গুলতেকিন ভাবি সহ। সন্ধ্যা হইলেই এই ঢাকা ইউনিভার্সিটির কিছু শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী (তাহাদের মধ্যে সুবর্ণ মুস্তফা, কেমিলিয়া মুস্তফা, আফজাল ভাই এবং আরো অনেকেই আসিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কিভাবে করিবেন তাহা আলাপ করার জন্য, আড্ডা দেওয়ার জন্য। আমিই হইলাম গিয়ে একমাত্র অসম বয়সী এক কিশোর যাহাকে সবাই খুব আদর করিয়া কেউ পিচ্চি, কেউ বালক, কেউ আবার নিজের দেওয়া যে কোনো মিস্টি নাম, কেউ আবার আমার নাম ধরিয়াই ডাকিতেন। আমাকে যে কেউ যে নামেই ডাকিতেন, আমি তাহাতেই উত্তর করিয়া সময়টাকে প্রানবন্ত করিয়া রাখিতাম।
আমার কোনো বন্ধু ছিলো না এই শহরে। আমি সকালে আলুর ভাজি দিয়া পরোটা খাই, তারপর পড়িতে বসি, আবার দুপুরের দিকে গোসল সারিয়া দুপুরের খাবার খাই, ঘুমাই, বিকালে সবার সাথে বোবা মানুষের মতো আড্ডা দেই, সন্ধ্যা হইলেই আবার পড়িতে বসি। এর মধ্যে বেগমের মা ই একমাত্র মহিলা যিনি সব লেকচারারদের জন্য তিন বেলা রান্না করিয়া দেয় আর আমার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়। ঢাকা শহরের একমাত্র মহিলা যাহাকে আমি গ্রামের মানুষদের মতো করিয়া পাইয়াছিলাম। আরেকজন ছিলো মুন্সি নামে একজন পুরুষ যিনি চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী হইয়াও রাজনীতির অনেক খবর রাখিতেন এবং খুব ভালোভাবেই অংশ গ্রহন করিতেন। আজ এই মানুসগুলি কোথায় আছে আমার জানা নাই, কিন্তু মিস করি।
শহিদুল্লাহ হলে আমার পড়াশুনা খুব ভালোভাবে চলিতেছে। কিন্তু গ্রামের জন্য আমার খুব মন খারাপ হয়। বিছানায় শুইলেই আমি আমার সেই গ্রামের পথ দেখি, মায়ের জন্য মন খারাপ হয়, আমার বন্ধুদের জন্য মন খারাপ হয়, আর মনে হয় কাউকে না জানাইয়া গ্রামে পালাইয়া যাই। কিন্তু আমি এই শহরের কোনো রাস্তাঘাট আমি চিনি না, কাউকে চিনি না, হাতে কোনো টাকা তো দুরের কথা পয়সাও নাই। আর থাকিলেও কিভাবে কাকে কি বলিয়া আমাদের গ্রামে যাওয়া যায়, তাহার কোনো পথ লিঙ্ক আমার জানা নাই।
দিন যায়, রাত যায়, আমার আমার সব কাজ ঠিক ঠাক মতো চলছে। বিশেষ করে পড়াশুনা। শুধু পড়াশুনাই ভালোভাবে চলিতেছে বলিলে ভুল হইবে, পড়াশুনার পাশাপাশি সকাল হইলেই আমার বড় ভাই আমাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির জিমে পাঠাইয়া দেন। সেখানে সব সিনিয়র সিনিয়র ভাইয়েরা শরিরচর্চা করেন। আমিই একমাত্র সবচেয়ে কনিষ্ঠ অনুশীলনকারি যে এই ঢাকা ইউনিভার্সিটির জিমে আসি। কেউ কিছু বলে না, মাঝে মাঝে কেউ কেউ আমার গালে হাত দিয়া আদর করিয়া দেয়। আবার কেউ কেউ খুব খুশি হয় এই ভাবিয়া যে, এই অল্প বয়সেও আমি এতো সাস্থ সচেতন!! যখন জানিতে পারে আমি ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য চেস্টা করিতেছি, আর এই জিমে আসার পিছনে আমার সাস্থ সচেতনার থেকে সিলেবাস পুরা করাই মুখ্য, তখন অনেকেই আরো মিস্টি মিস্টি করিয়া আমার পড়াশুনার কতটুকু হইতেছে তাহা জানিতে আগ্রহী হয়। কয়েকদিনের মধ্যে অনেকের সাথে আমার অসম বয়সী বন্ধত্ত হইয়া উঠে। এখন আর খারাপ লাগে না। অনেকেই আমার পরিচিত।
দিন ঘনাইয়া আসে পরীক্ষার। আমার মধ্যে যতোটা না টেনসন তাহার থেকে বেশী টেনসন দেখিতে পাই আমি আমার বড় ভাইয়ের চোখেমুখে। একটা সময় আসে, আমার সব সিলেবাস শেষ হইয়া যায়, সবকটি রচনা বইয়ের যে কয়টি রচনা লেখা রহিয়াছে তাহা তোতা পাখির মতো মুখস্ত হইয়া যায়, তিন ক্লাস মিলিয়া যতো অংক আছে তাহা আমার নখ দর্পণে। সুত্র আমি ভালো বুঝি, নিজে নিজেই অনেক সুত্র যেন আবিস্কার করিয়া ফেলিতে পারি এমন একটা অবস্থা। পৃথিবীর সব দেশের রাজধানীর নাম আমার জানা। কোনো এক দেশের কোনো ছোট বালক হয়ত তাহার দেশের রাজধানীর নাম বলিতে না পারিলেও আমি তাহার দেশের রাজধানীর নাম অনায়াসেই বলিয়া দিতে পারি। সুরিনামের রাজধানী প্যারামারিবো এইটা হয়তো আজো অনেকেই জানে না। আর এই প্যারা দিয়া কেনো রাজধানীর নামকরন হইলো সেইটা লইয়া আমার কোনো কৈফিয়তও নাই। সুরিনামের রাজধানী “প্যারামারিবো” বা “পারা মারিবো” না হইয়া যদি “গুতা মারিবো” কিংবা “ঘুসি মারিবো”ও হইতো তাহাতেও আমার কোনো অসুবিধা হইতো না, আমি সেইটাও মুখস্ত করিতাম।
দিন যায়, পরীক্ষার তারিখ ঘনাইয়া আসে, আর আমার সিলেবাস শেষ হইতে থাকে। একদিন ভাইয়াকে বলিলাম, ভাইয়া, আমার তো সব পড়া শেষ। আর কোনো রচনাও বাকী নাই কোন বইয়ের। তাহা হইলে আমি এখন কি করিবো? ভাইয়া বলিলেন, তাহা হইলে এক কাজ কর, প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর পরে যে স্বপ্ন দেখিস, সেইটা সকালে উঠিয়া রচনা আকারে লিখিয়া ফেল। এইটাই তোর সিলেবাস। কি ভয়ংকর কথা। ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচারদের মাথায় এতো বুদ্ধি? এখন আবার স্বপ্ন মনে রাখিতে হইবে? কিন্তু আমি তো শুধু একটাই সপ্ন দেখি, আর তাহা হইতেছে ওই যে, গ্রামের মেঠো পথ, ডাংগুলি খেলা, আমার বন্ধুদের লইয়া হইচই করিয়া মাঠে ফুটবল খেলা, সারাদিন চরকির মতো ঘুরিয়া বেড়ানো। কিন্তু তাহাতেও আমার রচনা শেষ হয় না। কখনো আমি আমার মাকে দেখি, দেখি আমাদের উঠোনে বাড়িয়া উঠা বরই গাছে ছোট ছোট বরই এর কলি আসিয়াছে, দেখি আকাশের শেষ প্রান্তে লাল সূর্য এক সময় সন্ধ্যা নামাইয়া সারা গ্রামকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করিয়া দিতাছে। আর ইহার সাথে রাতের তারা আর গোলাকার চাক্টির মতো চাদনী রাত উপহার দিতাছে। আমার রচনায় আমার মন খারাপের একটা পরিস্কার আভাস ফুটিয়া উঠিতেছে বুঝিয়া আমার ভাই মাঝে মাঝে আমাকে লইয়া পাশেই দোকানের গরম জিলাপি খাওয়ানোর চেস্টা করেন। মিস্টি জিলাপী খাওয়ার সাথে মন ভালো হইবার একটা যোগ সুত্র নিশ্চয়ই আছে। তাহা না হইলে, অন্তত ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন মেধাবী লেকচারার এই কাজটি করিতেন না।
সপ্ন হইতে রচনা লিখতে গেলে যেহেতু আমার মন খারাপের একটা আভাস তিনি পাইতেছিলেন, তাই এইবার আমার বড় ভাইয়ের মাথায় আরেক নতুন ফন্দি এলো। বিকালে যে সব বড় ভাইয়েরা আড্ডা দিতে আসেন, তাহাদের মধ্যে হুমায়ুন ভাই একজন উঠতি লেখক হিসাবে পরিচিত হইতেছিলেন। তিনি নন্দিত নরকের মতো একটা উপন্যাস ইতিমধ্যে লিখিয়া নাম করিয়া ফেলিয়াছেন। শঙ্খ নীল কারাগারও ইতিমধ্যে নাম করা হয়ে উঠিতেছে। ইহা আবার টিভিতে প্রচারিতও হইয়াছে। হুমায়ুন ভাই তাহার উপন্যাশের মুল কাহিনী লিখার আগে বা পরে তিনি তাহার লেখাগুলি এই আড্ডায় শেয়ার করিতেছেন। আমি ছোট একজন মানুষ এইসব বড় বড় মানুষদের কাছে বসিয়া শুধু হাই তুলিতেছি। আমি কি তাহাদের এই উপন্যাশের চরিত্রের বৈশিষ্ট খন্ডন করিয়া রচনা আকারে লিখিতে পারি? তাই, শহিদুল্লাহ হলের ডাইনিং হলের উপরের তালায় এক মাত্র সাদা কালো টিভির নাটক আর বিদেশি কিছু ইংরেজী সিরিয়াল দেখার অনুমতি আমার মিলিয়া গেলো। কিন্তু অসুবিধা হইলো আরেক জায়গায়। এতো ছাত্র এবং ছাত্রীরা এই সাদা কালো টিভির দর্শক ছিলেন, যে, তাহাদের গল্পের ডায়ালগ শুনিতে শুনিতে টিভির কোনো ডায়ালগই আমার কানে আসিত না।
এখানে আরো একটা কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। আমার হাতের লেখা অনুশীলন করিতে করিতে আমার হাতের লেখা মুক্তার মতো ঝকঝকে হইয়া গেলো। একেবারে কার্বন কপি আমার বড় ভাইয়ের হাতের লেখার সাথে। শুধু তাই নয়, আমি যে কোনো স্টাইলে হোক সেটা সোজা করিয়া, বাকা করিয়া, তেরা করিয়া, সব স্টাইলেই আমার হাতের লেখা এ ওয়ান।
অবশেষ ক্যাডেট কলেজের পরীক্ষা আগামিকাল। সিট পড়েছে ঢাকা কলেজে। কি বিশাল সেই কলেজ। আমার জীবনেও এতো বড় কলেজ দেখি নাই। কতগুলি বিল্ডিং, কতগুলি রাস্তা, মাথা খারাপ হয়ে যায়। পরীক্ষার উত্তর প্রশ্নপত্রেই লিখিতে হইবে, ফলে খুব সাবধানে না লিখিলে উত্তরের জন্য অতিরিক্ত কাগজ লইবার কোনো অপশন নাই। আমার অবশ্য তাহাতে কোনো সমস্যা নাই কারন আমি অতি ছোট অক্ষরেও অলপ বিস্তর জায়গায় অতি সুন্দর করিয়া কাটাকাটি না করিয়া অনেক বেশী কিছু বেশ লিখিতে পারি।
প্রশ্নপত্র হাতে পেলাম। প্রথমেই কি রচনা আসিয়াছে সেইতা খোজ করিতে গিয়া আমার এতো হাসি পাইয়াছিলো যে, আজো আমার ঠোট হাসে। এত রচনা পড়িলাম, এতো রচনা স্বপ্ন দেখিয়া দেখিয়া নিজে রচনা তৈরী করিলাম, এতো বড় বড় সাহিত্যিকদের সাথে নাটক উপন্যাসের চরিত্র ব্যাখ্যা করিয়া আমি নিজেও একজন সেমি সাহিত্যিক হইয়া যাইবার উপক্রম হইলো, আর সেখানে কিনা রচনা আসিয়াছে “আমার জুতার ফিতা”, আর “আমার কলমের নিপ”? তাও আবার দশ লাইন। ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রকারীরা আসলে অন্য গ্রহে বাস করিতেন বলিয়া আমার বোধগম্য হইল, অথবা তাহার রচনা নির্বাচন করিবার জন্য হয়তো কিছু দুই বা তিন বছরের বাচ্চাদের লইয়া একটা বোর্ড গঠন করিয়াছিলেন, যাহারা জুতার ফিতা আর কলমের নিপ ছাড়া আর কিছুই তাহাদের জ্ঞ্যানে ছিলো না। যাক, আমি “কলমের নিপ” রচনাটাই লিখিলাম। আমিও কম চালাক নই। দশ লাইন লিখিতে হইবে, আমি দশ লাইন ই লিখিবো। লিখিলাম।
আমার একটি কলম আছে যাহার আগায় একটা নিপ আছে।
নিপটি শক্ত।
মনে হয় টিনের তৈরী।
নিপটি খোলা যায়।
আবার লাগানোও যায়।
মাঝে মাঝে নিপটি খুলিয়া ধুইতে হয়।
নিপ ভেংগে গেলে নতুন নিপ লাগানো যায়। ।
নিপের জন্য একটা ক্যাপও আছে।
নিপ কলমের মাথার মতো।
আমি নিপটিকে খুব ভালোবাসি।
আমি কখনো নিপটিকে এমন করিয়া ভালোবাসিয়াছি কিনা আজো জানি না। কিন্তু লিখিয়া তো দিয়াছি যে, আমি নিপটিকে ভালোবাসি। আসলে ভালোবাসার জন্য শুধু প্রান থাকিতে হইবে এমন বস্তুই নয়, প্রান নাই এমন সব বস্তুকেও আমরা অনেক ভালোবাসি। হয়ত এই নিপের জন্য কেউ এমন করিয়া এমন ভালোবাসা প্রদর্শন করিলো।
পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি একে একে সবগুলির উত্তর দিতে থাকিলাম। অংক, ইংরেজী আর সাধারন জ্ঞ্যান এর পরীক্ষা। বাংলা কি ছিলো কিনা এখন আর মনে করিতে পারিতেছি না। মনে হয় ছিলো না। আমি যখন পরীক্ষা দিতেছিলাম, লক্ষ্য করিলাম, একজন মোটা টিচার প্রায়ই আমার পাশে আসিয়া দারাইতেন। আর বলিতেন, তোমার হাতের লেখা তো খুব সুন্দর!! মাত্র এক ঘন্টার পরীক্ষা। এই এক ঘন্টায় নির্ধারিত হইয়া যাইবে কে বা কাহারা এইসব ক্যাডেট কলেজ গুলিতে ভর্তি হইবে। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ক্যাডেট কলেজের ছেলেগুলি কি ভাগ্যবান নাকি ছেলেগুলি ক্যাডেট কলেজকে ভাগ্যবান করিয়াছে? হয়ত দুইটুই সত্য।
পরীক্ষা সেসের ঘন্টা বাজিয়া গেলো। আমার পরীক্ষা খুব ভালো হইয়াছে। জানামতে কোন ভুল করি নাই। আমি তৃপ্ত পরীক্ষা দিয়া। খাতা লইয়া যাইতেছেন টিচাররা। আমার খাতা নিতে আসিলেন ওই মোটা টিচার। আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, পরীক্ষা কেমন হইয়াছে? আমি স্যারকে বলিলাম, স্যার যদি একজন চান্স পায়, তাহা হইলে আমি পাবো। এবার আর ইনশাল্লাহ বলিতে ভুল করি নাই। স্যার নিজেও সম্ভবত আমার উত্তরগুলি লিখার সময় পড়িয়াছিলেন। তাই হয়তো বুঝিয়াছিলেন, আমার কথায় একটা সত্যতা আছে। তিনি আমার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, ভাইভা পরীক্ষাটা ভালো করিয়া দিবা, দেখা হইবে কলেজে। পরে আমি কলেজে গিয়া এই স্যারের নাম জানিয়াছিলাম, মোহশীন স্যার, আমাদের বাইওলোজির টিচার।
লিখিত পরীক্ষা তো শেষ। এখন যাহারা লিখিত পরীক্ষায় পাশ করিবে তাহাদের মধ্য হইতে আবার ভাইভা নেওয়া হইবে। ভাইবায় যাহারা মেধাবী হিসাবে প্রমান করিতে পারিবে, তাহারাই সেই গুটিকতক ভাগ্যবান যারা সপ্নের ক্যাডেট কলেজে পড়িতে যাইবে। বয়স মাত্র ১২, যেই সব পরীক্ষা দিতেছি, আমেরিকার প্রেসিডেন্টরাও মনে হয় এই বয়সে এমন পরীক্ষা দেয় নাই। এদিক হইতে আমরা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হইতেও উত্তম।
পরীক্ষার পর যেনো আমার আর কোনো কাজ রহিলো না। কিন্তু আমার না হয় কাজ নাই, কিন্তু যিনি কাজ জোগাড় করিয়া দেওয়ার লোক আমার সেই ইউনিভার্সিটির ভাই, তাহার হাতে তো আমার জন্য অনেক কাজ জমা হইয়াই ছিলো। ভাইয়া ভাবলেন, কি জানি যদি ক্যাডেট কলেজে না চান্স পাই তাহাহলে কি হবে? ফলে বিকল্প হিসাবে তিনি আরো একটি কলেজের জন্য আমাকে প্রস্তুতি নিতে বলিলেন। আর সেইটা হইতেছে ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল। ক্যাডেট কলেজের প্রস্তুতি আমার এমন ছিলো যে, ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের জন্য ইহাই ছিলো ঢের। ফলে খুব অনায়াসেই আমি ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের ভরতি পরীক্ষায় টিকে গেলাম।
দিন যায় মাস যায়, ভাইয়া আমার ক্যাডেট কলেজের পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় থাকেন আর আমি অপেক্ষায় থাকি কবে গ্রামে যাবো, আবার বৃষ্টিতে ভিজবো, গ্রামের বন্ধুদের লইয়া আমি কবে আবার সেই আগের দিনের মতো হই হুল্লুর করিবো।
আমি রীতিমতো ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে ক্লাস শুরু করিয়া দিয়াছি। নতুন নতুন কিছু বন্ধু জুটিলো। ভালো লাগিতে শুরু করিলো আমার শহরের জীবন। আমি শহিদুল্লাহ হল হইতে হাটিয়া হাটিয়া সেই আজীম্পুর ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে যাই ক্লাস করিতে। ফিরিতে ফিরিতে বাজিয়া যায় প্রায় পাচটা।
হটাত একদিন সকাল বেলায় আমাকে আমার ভাই কাছে ডাকিলেন, পাশে বসাইলেন, আর আমার মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, ‘তুই জানিস না তুই কি করেছিস। তুই ক্যাডেট কলেজের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছিস। কত যে আমি খুশী হয়েছি তোকে বুঝাতে পারবো না’। আমি পাশ করেছি এই উপল্বধিটা আমার মধ্যে কোনো কিছুই পরিবর্তন করিলো না কিন্তু ভাইয়ার খুশী দেখিয়া আমার অনেক আনন্দ হইয়াছিলো। আমাকে ভাইয়া ওইদিন সন্ধ্যায় কোথায় যেনো লইয়া বেশ মজার মজার খাবার খাওইয়াছিলেন। ঢাকা শহর ঘুরাইয়া ছিলেন। আমি ভাইয়ার হাত ধরে এক রিক্সায় বেড়াইয়াছি। খাওয়া দাওয়ার পর ভাইয়া হুমায়ুন স্যারের বাসায় এই সুখবরটা দিতে আমাকে লইয়া গেলেন। রাতে হুমায়ুন স্যারের বাসায়ই খাওয়া দাওয়া করিলাম। গুলতেকিন ভাবি খুব ভালো মহিলা ছিলেন, আমাকে আদর করিয়া বলিলেন, এই যে মেধাবী ছেলে, আসো তোমাকে মিস্টি খাইয়ে দেই। এই বলে তিনি আমাকে এক বাটি পুডিং ধরিয়ে দিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি পুডিং খুবই অপছন্দ করি। বলিলাম, পেটে একটু জায়গাও নাই যে খাই। তারপরেও খাইলাম। ভালোবাসায় যে যাই কিছুই দিক, তাহাতে ভালোবাসার সাথে যাহা থাকে তাহা হচ্ছে স্নেহ আর মায়া। এই মায়ার কারনেই কেউ এই পৃথিবীকে ছাড়িতে চাহে না।
কিছুদিন পরই ভাইভার তারিখ পড়িয়া গেলো। আমি এই ভাইভাটাকে এতো ভয় পাই যে, মাঝে মাঝে আমি তোতলাতে থাকি যদি উত্তর না পারি। তারপরেও তো ভাইভা দিতে হইবে। আমার যেইদিন ভাইভা পরীক্ষা সেইদিন আমার সিরিয়াল পড়িলো একবারে শেষ ছাত্র হিসাবে। শেষ ছাত্রের ভাইভা দেওয়ার বিরম্বনার আর শেষ নাই। যেই পরীক্ষা দিয়া বের হয়, অমনি আমরা হুম্রী খাইয়া তাহাকে ঘিরিয়া প্রশ্ন করিতে থাকি, তাহাকে কি জিজ্ঞাসা করিয়াছে, আর সেইটার উত্তর কি দিয়াছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের প্রাননাশ। আর টেনসন তো আছেই। আমরা যাহারা তখনো পরীক্ষার সিরিয়ালে বসিয়া আছি, তাহারা ফাকে ফাকে অনেক প্রশ্ন নিয়ে আলাপ আলোচনাও আবার করিতেছি। একসময় (নাম বল্বো না আমার এক বন্ধু যে পরে আমার সাথেই ক্যাডেট কলেজে পড়েছে) এক ছাত্র আরেক ছাত্রকে প্রশ্ন করিলো, জানো, গাড়ি চলার সময় কয় চাক্কা সাম্নের দিকে ঘুরে? আমিও মনোযোগ সহকারে প্রশ্নটি শুনিলাম, কিন্তু যেহেতু কোনোদিন আমার পরিবার গাড়ির মালিক ছিলেন না, তাই আমি নিজেও জানি না আসলে কোন কোন চাক্কা গাড়ি চলার সময় সামনে যায় আর কোন চাক্কা পিছনের দিকে যায়। আমার প্রশ্নকারী বন্ধু খুব গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো, গাড়ির সামনে চলার সময় তিন চাক্কা নাকি সামনে ঘুরে আর এক চাক্কা নাকি পিছনের দিকে ঘুরে। আমি বিশ্বাসও করিয়াছিলাম। হইতেও পারে, কারন ওরা তো গাড়িতেই ঘুড়াঘুড়ি করে। আমি এরপর অনেকবার পরিক্ষা করে দেখার চেস্টা করিয়াছি, আসলে কোন চাক্কাটা পিছনের দিকে ঘুরে? এইটা খুজিতে গিয়া বারবার আমার মাথাই খালি চক্কর দিয়াছে কিন্তু কোন চাক্কা পিছনে চক্কর দেয় সেটা আজো বুঝি নাই।
অবশেষে ভাইভার জন্য আমার ডাক পড়িলো। তখন প্রায় সন্ধ্যা। শেষ ছাত্রের ভাইভার যেমন সারাদিন টেনসনের জন্য মাথা খারাপ থাকে, আবার শেষ ছাত্র হইলে একটু লাভও আছে। টিচাররা তখন বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির থাকেন, মোটামুটি প্রশ্ন করিয়াই ছাড়িয়া দেন। বাড়ী যাওয়ার তাড়া। আমার বেলায়ও তাহাই হইলো।
চল্লিশোর্ধ্ব বিজ্ঞ পাচ ছয়জন ব্যক্তিবর্গ মাত্র বারো বছরের বালকের মেধা যাচাই করিবার লক্ষে চারিদিকে এমন করিয়া বসিয়া আছেন যেনো গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ হইতেছে। একজন আমাকে প্রশ্ন করিলেন, তুমি কেনো ক্যাডেট কলেজে ভরতি হইতে চাও? আমি বললাম, আমি পাশ করিয়াছি বলিয়া ক্যাডেট কলেজে ভরতি হইতে চাই স্যার। সবাই আমার এই উত্তরে কেমন জানি যেনো হচকচিয়া গেলেন। একি কথা !! আরেকজন বলিলেন, তুমি কি আর্মি হইতে চাও? আমি বললাম, স্যার আর্মি কি? এবার আরো অবাক স্যারেরা। কি জানি কি বলাবলি শুরু করিলো ওনারা। আমি ভয় পাইয়া গেলাম। এইবার একজন আইনস্টাইনের মতো বুড়োলোক আমাকে একটা সাদা পাতা হাতে দিয়া একটা অংক করিতে বলিলেন। সময় দিলেন দুই মিনিট। আমি কয়েকবার অংকটা করে দেখিলাম। এক্স এর মান নির্ণয় করিতে হইবে। ইহা আমার জন্য পান্তা ভাতের মতো। কিন্তু বারবার অংক তা করিবার পরও দেখিলাম, ব্যাপারটা মিলিতেছে না। আমি খুব ভয়ে ভয়ে বলিলাম, স্যার অংকটা মিলছে না, এক্স এর মান কি ভুল আছে?
এইবার তাহারা আর অবাক হইলেন না। একেবারে আমার পিঠে একজন চাপড় মারিয়া বলিলেন, হ্যারে বাবা, এইটাই তো উত্তর!! যাও, তোমার পরীক্ষা শেষ। আমি তো অবাক। অংক স্যারের ভুল দিয়াছেন, আমি নাকি সঠিক উত্তর দিয়াছি। ক্যাডেট কলেজের স্যারেরা সব মনে হয় পাগল। মেধাবী ছেলেদের পড়াইতে পড়াইতে স্যারেরাও আধা মেধাবী থেকে পুরুটাই পাগল হইয়া যাইতেছেন। শুনেছি, বড় বড় বৈজ্ঞানিকেরা নাকি পাগল হয়।
ভাইয়াকে সব আদোপান্ত বলিলাম। ভাইয়া আমার কথাগুলি দাড়ি কমা সহকারের গলদ করন করিতেছিলেন। যেনো আমি কোনো ভুতুরে গল্প বলিতেছি। সব শুনিবার পর ভাইয়া একটু কেমন জানি করিলেন। বাতাশ ভর্তি বেলুন হতাত করিয়া মুখ খুলিলে যেমন নিমিসের মধ্যেই তাহা আর পেট ফোলা মাছের মতো মনে হয় না, তেমনি আমার ভাইয়ার চোখ মুখ দেখিয়া আমার বড় ভয় হইতে লাগিলো। অনেক্ষন পর এক্তা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়া বলিলেন, বোকার মতো কেনো বলিতে গিয়াছিস যে, আর্মি কি তা জানিস না বা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করেছি বলে ক্যাডেট কলেজে পড়তে চাই। বুদ্ধি করে অন্য কিছু বলতে পারলি না? বুঝলাম, আমি আসলে বোকাই।
যাই হোক, ভাইভা বোর্ডের সদস্যগন হয়ত আমাকে বোকা মনে করেন নাই, তাহারা হয়ত আমাকে বোকা না ভাবিয়া সহজ সরল ভাবিয়াছিলেন, তাই ফেল করাইয়া দেন নাই। আমি পাশ করিয়াছিলাম। সেই ৪১ বছর আগে সমস্ত পরীক্ষায় পাশ করার কারনে আজ ১৯ শে জুন এই দিনে কিছু অজানা মেধাবী ছেলেদের সাথে পড়াশুনা করিতে যাইতেছি আমি ক্যাডেট কলেজে। ঢাকা থেকে বহুদুর। সেই টাঙ্গাইল। ঢাকাই আমার কাছে সাত সমুদ্র তের নদীর পথ মনে হইতো আমার গ্রাম থেকে, আর আজ যাচ্ছি চৌদ্দ সমুদ্র ছাব্বিস নদীর দুরুত্তে।
সকাল সকাল ভাইয়া আমাকে কালো প্যান্ট আর সাদা ফুল শার্ট পড়াইয়া কোরবানীর গরুকে যেমন আদর করিয়া বাজারে দামী খদ্দেরের কাছে হাতছাড়া করিয়া দেন, ভাইয়াও আমাকে তেমনি সুদুর প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়া মির্জাপুরের কোনো এক বনবাসে ক্যাডেট কলেজ নামক বহুল আলোচিত এবং সপ্নের জগতে রাখিয়া আসিলেন। হাসের বাচ্চাদের মতো আমরা ৫৪ জন সমবয়সী কিশোর পিতামাতাহীন হইয়া মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে থাকিয়া গেলাম। প্রথম দিন একটা জেল খানা বলিয়া মনে হইল। আরো মনে হইলো যে, এতো কষ্ট করিয়া শেষ পর্যন্ত জেলে আসার জন্য ব্যতিব্যস্ত হইয়া ছিলাম?
মন খারাপ হইতেছিলো। এমন সময় পিছন হইতে কে জানি খুব আলতো করিয়া আমার ঘাড়ে হাত রাখিলো। তাকাইয়া দেখিলাম, ওই মোটা স্যার। খুব আপনজন মনে হইলো। আমার চোখ ছল ছল করিয়া উঠিলো। স্যার আমার চোখে চোখ রাখিয়া বলিলেন, মন খারাপ হইতেছে? আমরা আছি তো।
আজ এতো বছর পর মনে হইতেছে, হ্যা স্যার, আপ্নারা তো ছিলেন। আমার সেই প্রিয় ক্যাডেট কলেজ, বড় সুন্দর একটি স্থান আমার অন্তরে। আর সেই সব স্যার যাদেরকে আমি মিস করি নিঃশ্বাসের প্রতিটি ক্ষনে কারন তারা আমাদের শুধু স্যার ছিলেন না, ছিলেন কখনো ভাই, কখনো গুরুজন, কখনো পিতামাত আবার কখনো একেবারেই বন্ধু। আজো স্যার দের কে আমার পায়ে স্পর্শ করিয়া গলা ফাটাইয়া বলিতে ইচ্ছা করে, স্যার আমি আপনাদেরকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আপ্নারা যে যেখানেই থাকুন, আমরা আপনাদের দোয়ায় বাচিয়া থাকিতে চাই।