গত শনিবার ইউ এন হেড কোয়ার্টারে গিয়েছিলাম আই ডি কার্ড করার জন্য। বিকাল তখন প্রায় চারটা। ফাকা অফিস। মাত্র দুইজন বিদেশী স্তাফ হাজির ছিলো। আমি যেতেই ওরা আমার ডিটেইলস নিয়ে নিলো। ফিঙ্গার প্রিন্ট, ছবি এবং ব্লাড গ্রুপ জেনে নিলো। আমার জন্ম সনদের বিপরীতে পাসপোর্ট দিতেই প্রায় সব গুলি কাজ যেনো এক সাথে ওরা পেয়ে গেলো। সবই আছে এর মধ্যে। যে মেয়েটা এইসব করছিলো সে সম্ভবত লোকাল এই হেসিয়ান। ভালো ইংরেজী বলতে পারে না। আমার সাথে দোভাষী ছিলো তাই কাজটা সহজেই করা গেলো। আই ডি কার্ড করতে গিয়ে একটা ঘটনা ঘটে গেলো যা সেদিনই লিখার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সময়ের অভাবে লিখা হয়ে উঠে নাই।
ঘটনাটা তাহলে বলিঃ
আমি যখন প্রায় সব কাজ শেষ করে ফেলেছি, এমন সময় একটা ২২/২৩ বছরের একটি সুন্দর মেয়ে আমার কাছে এসে খুব সুন্দর করে ভারতীয় স্টাইলে দুই হাত নমস্কারের আদলে কূর্নিশ করলো। মেয়েটিকে দেখতে কিছুতেই ভারতীয় মনে হলো না কিন্তু তাঁর চেহাড়ায় একটা বাঙ্গালি বাঙ্গালী ভাব ছিলো। আমার সামনে এসে সে চমতকাত ইংরেজীতে বল্লো, আপনি কি ইন্ডিয়ান?
কেউ আমাকে ইন্ডিয়ান বললে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি ইন্ডিয়ান নই, আমি বাংলাদেশী। ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ এক নয়। তারপরেও বাংলাদেশ এখনো যেহেতু বিশ্ব দরবারে অতোটা পরিচিত হয়ে উঠে নাই, সবাই মনে করে বাংলাদেশ মানেই ইন্ডিয়া।
যাক, মেজাজ খারাপ না করেই বললাম, 'না, আমি ইন্ডিয়ান নই, আমি বাংলাদেশী।'
মেয়েটি ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশের পার্থক্যটা বুঝে দেখলাম। বল্লো, ও আচ্ছা, আপ্নারা ঢাকার লোক। ঢাকা তো বাংলাদেশের রাজধানী।
বললাম, হ্যা। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী।
মেয়েটি আর কোনো কথা বাড়াতে চাইলো না। কিন্তু আমার আগ্রহটা একটু বেড়ে গেলো।
আমি বললাম, আপনি কি কোনো ইন্ডিয়ানকে খুজছেন?
সে বল্লো, হ্যা, আমি নতুন কোনো ইন্ডিয়ান এলেই তাকে জিজ্ঞেস করি সে ইন্ডিয়ান কিনা।
বললাম, কেনো আপনি কোনো ইন্ডিয়ানকে খুজছেন?
মেয়েটি পাশেই কফি শপের দিকে ইংগিত করে আমি কফি খাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমি যেহেতু পেট্রোলিং এর কাজে বের হয়েছি, আমার কোনো তারাহুরা নাই। হয়ত, এই মেয়েটার কোনো সমস্যাও আমার পেট্রোলিং এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
মেয়েতী একোতা গোলাপি গেঞ্জি পড়া। মাথার চুলগুলি ছোট, বব কাটিং এর মতো। ভালো স্বাস্থ্য, ইন্ডিয়ান গায়ের রঙ, বেশ স্মার্ট। জিন্সের প্যান্ট পরা।
কফি খেতে খেতে সে আমাকে জানালো, সে ইউ এন এর সিভিল ডিপার্টমেন্টে পার্ট টাইম কাজ করে। সে আসলে থাকে পোর্টোরিকুতে। পাশেই আইল্যান্ডটা। ওখানে ওর মা আছে। তাঁর আর কোনো ভাই বোন নাই।
বাবা কি করেন, জিজ্ঞেস করতেই সে যেটা বল্লো, তা হলো, সে তাঁর বাবাকেই খুজছে। সে তাঁর বাবাকে কখনোই দেখে নাই। কোনো এক ইন্ডিয়ানের সাথে তাঁর মায়ের প্রেম ছিলো। তাঁর মা ছিলো মূলাট্টো। মানে না নিগ্রো না শ্বেতাঙ্গ। মুলাট্টো হচ্ছে নিগ্রো আর শ্বেতাঙ্গ টাইপের একটা মিক্সড ব্লাড। ইন্ডিয়ানরা শ্বেতাঙ্গ বলা যাবে না কিন্তু অনেক ইন্ডিয়ান আছে যারা বেশ ফর্সা। হতে পারে তাঁর মা আর ঐ ইন্ডিয়ানের ফলে মেয়েটির চেহাড়া অনেকটা মুলাট্টো ধরনের কিন্তু তাঁর মধ্যে মুলাট্টোর যা যা গুন বা আচরন, তাঁর থেকে অনেক আলাদা। বেশীর ভাগ আচরন আমার কাছে আমাদের সাব কন্টিনেন্ট এর মতোই মনে হলো।
মেয়েটির ভাষ্য যে, আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে কোনো এক ইন্ডিয়ান অই পোর্টোরিকুতে এসেছিলেন। তখন তাঁর মায়ের সাথে অই ইন্ডিয়ান লোকটির প্রেম হয়। প্রেম থেকে তারা একত্রে থাকতে থাকেন। বিয়ের মতো এইরকম কোনো ফর্মালিটিজ আসলে হয় নাই। যাকে আমরা লীভিং টুগেদার হিসাবে বলতে পারি।
বছর কয়েক পর এভাবে থাকার পর, এই মেয়েটির জন্ম হয়। মেয়েটির জন্মের মাত্র কয়েক মাস পরেই সেই ইন্ডিয়ান বাবা তাঁর স্বদেশের কোনো কাজে ইন্ডিয়ায় চলে যান। কথা ছিলো তিনি কাজ সেরেই আবার এই পোর্টোরিকুতে সন্তান-স্ত্রীর কাছে ব্যাক করবেন।
এই যে তিনি গেলেন আজ অবধি তিনি আর ফিরেন নাই। তাদের কাছে থাকার মধ্যে আছে শুধু কয়েকটি ছবি আর পুরানো একটা ঠিকানা। যেহেতু তাঁর মা কখনো পোর্টোরিকুর বাইরে যান নাই, বা তিনি জানেন না কিভাবে ইন্ডিয়া গিয়ে বাবাকে খুজতে হবে, ফলে সেই ২৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য আজো তাঁর মা অপেক্ষাকরেন, তিনি ফিরে আসবেন।
মায়ের এই কষ্টে, এবং বিশ্বাসে মেয়ে এতো বছর পর নীরবে তাঁর বাবাকে খুজেন। এর মধ্যে সে দুইবার ইন্ডিয়াও গিয়েছিলো, কিন্তু তাঁর বাবার পোর্টোরিকুতে আসার কোনো রেকড়ড়দ তাদের ডাটাবেজে নাই, এমনকি যেই স্টেটের কথা তাঁর মা জানে সেই স্টেটে গিয়েও মেয়েটি তাঁর বাবার কোনো হদিস মিলাতে পারেন নাই।
বাবাকে পাওয়া না পাওয়ার জন্য তাঁর আফসোস নাই। না পেলেও তাঁর মনে যে অনেক কষ্ট তাও না। কিন্তু যখনই সে তাঁর মায়ের দিকে তাকায়, সে বুঝে, ভালোবাসায় কিভাবে মানুষ এক জনের জন্য সারাটা জীবন একা থাকতে পারে। তাঁর শুধু এইটুকু জানার দরকার যে, তাঁর বাবা কি আজো বেচে আছেন? নাকি এই পৃথিবীতেই নাই। যদি বেচে থাকেন, তাহলে কি অপরাধে তাঁর বাবা তাকে কিংবা তাঁর মাকে আর একবারের জন্য ও দেখা দিলেন না? যদি তাঁর বাবার আর কোনো ভালোবাসাই আর তাদের উপর না থাকে, সেটাও তারা মেনে নিতে মানষিকভাবে প্রস্তুত, কিন্তু সেতাও তো জানা দরকার।
কথা বলতে বলতে দেখলাম, কয়েকবার মেয়েটির গলা বুজে আসছিলো, হয়ত ইমোশনাল হয় গেছে। কফির কাপে চুমু দিয়ে একটু টাইম নিয়ে আবার বলতে থাকলো যে, আমার জন্ম নিয়ে আমি অতোটা উদাসীন নই কিংবা কোথাও কোনো কাজে আমার বাধা নেই। কিন্তু আমারো খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমার বাবা কোথায়, কি করেন তিনি। তাঁর কি কখনো আমার কথা মনে পড়ে না? আমার মায়ের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমার কথাও কি তাঁর মনে পড়ে না? কষ্ট হয় মাঝে মাঝে। আমার মা ইন্ডিয়ান রীতি অনুযায়ী প্রদিন সকালে বিকালে আমাদের ঘরে ধুপ জ্বালায়। তিনি নিজেকে ইন্ডিয়ান বউ মনে করেন আজো। এখন তাঁর বয়স হয়ে গেছে। আমি মাঝে মাঝে মাকে বলি, মা , তিনি হয়ত আর বেচে নেই। তা না হলে কারো না কারো নাড়ীর টানে তিনি একবার হলেও আসতেন। যে ব্যক্তিটা প্রথিবীতেই নাই, তাঁর জন্য কেনো তুমি এতো কষ্ট করছো?
মা মানতে রাজী নন।
জিজ্ঞেস করলা, এইখানে তো একটা ইন্ডিয়ান ব্যাটালিয়ান আছে, তুমি কি সেখানে গিয়ে খোজ করেছো কারো কাছে? বা কারো কাছে কি এতা নিয়ে আলাপ করেছো?
মেয়েটি বল্লো যে, হ্যা সে এই ব্যাপারে ইন্ডিয়ান কন্টিনজেন্টে একবার কোনো এক অফিসারের সাথে আলাপ করেছিলেন। সে ঠিকানা টা ধরে প্রায় তিন মাস পরে জানিয়েছিলো যে, যেই ঠিকানাটা আমার মা জানতেন, সেই ঠিকানায় এখন কোনো বসতি নাই। সেটা এখন নাকি কোনো এক শিল্প নগরী হয়ে সেখানে অনেক কলকারখানার রাজ্য হয়ে গেছে। আর সেই ২৫ বছর আগের কোনো ডাটা তারা দিত অপারগ।
অনেক্ষন কথা বললাম মেয়েটার সাথে। খারাপ লাগলো। কিন্তু আমারই বা কি করনীয়? আমি মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করলাম, সে হেসে দিয়ে বল্লো, মা তাকে ডাকে অরুনিমা হিসাবে, আর সে সবাইকে অফিশিয়াল নাম জানায় তামান্না হিসাবে।
তামান্নাই হোক আর অরুনিমাই হোক, বিকালটা আমাকে খুব ব্যথিত করে দিলো। পেট্রোলিং করার সময় বারবার অরুনিমার মুখখানা আমার চোখে ভেসে আসছিল আর ভাবছিলাম, গরীব নয় সে, তাঁর বাবার টাকার কোনো দরকার নাই। সে শিক্ষিত, তাঁর একটা গতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, ইন্ডিয়ান বাবার কোনো সম্পত্তির জন্য তাঁর কোন তাড়া নাই, না আছে কোনো পারিবারিক ঐতিহ্যের চাওয়া পাওয়া। সে শুধু একটাই জানতে চায়, তাঁর বাবা কে, কোথায় আছে কিভাবে আছে। আর কিছুই না। একটা পরিচয়।
এই পৃথিবীতে কত রকমের কষ্টে মানুষ বসবাস করে তাঁর কোনো ইয়াত্তা নাই। কেউ টাকার কাংগাল, কেউ সম্পদের কাংগাল, কেউ ভালোবাসার কাঙ্গাল, আবার কেউ শুধু আমি কে, কি আমার পরিচয়, সেইটা পেলেই তাঁর সব সুখ।