১৯/১০/২০২১-হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া

আমি মর্মাহত, আমি আহত, আমি অসুস্থ্য। আমার কোনো ভাষা নাই কোনো মন্তব্য করার। শুধু মন খারাপ হচ্ছে, আর কষ্টে ভোগছি।  

গতকাল পেপারে দেখলাম, রংপুর পীরগঞ্জে হিন্দুদের একটি গ্রাম রাতের অন্ধকারে কে বা কারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাই না যে, কে বা কারা এটা করেছে। সাম্প্রদায়িক হামলা কখনোই হটাত করে সংঘটিত হয়না। এরও একটা মাষ্টারমাইন্ড থাকে, একটা মাষ্টার প্ল্যান থাকে যা দিনের পর দিন কারো না কারো ছত্রছায়ায় সঠিক দিন তারিখ ধার্য করেই তার বাস্তবায়ন করা হয়। আমরা কি এতোটাই পিশাচ হয়ে গেছি যে, একই গ্রামে, একই এলাকায় পাশাপাশি হিন্দু মুসলিম যুগের পর যুগ একত্রে বসবাস করার পরেও শুধুমাত্র ভিন্ন মতালম্বি ধর্মের কারনে আমার সেই চেনা বন্ধু, আমার সন্তানের সেই চেনা খেলার সাথী, কিংবা যে ঠাকুরমা আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে তার ঈশ্বরের কাছে আমার মংগলের জন্য দোয়া করেছেন, তাকে অতর্কিত হামলায় এক নিঃশ্বাসে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে পারি? একবারও অন্তরে দাগ কাটে না যে, এটা ধর্মের উপর নয়, এটা মানবতার উপর চরম আঘাত? এটা কিছু নীরিহ এবং অসহায় মানুষের উপর অত্যাচার?  

একবার ভাবুন তো, যে বাড়িগুলিতে আগুন দেয়া হয়েছে, সেখানেও আমার ছেলে-মেয়েদের মতো ছেলে-মেয়েরা রয়েছে, তাদের শখের অনেক কিছু সাজানো ছিলো, দিনের পর দিন সে তার জীবনকে সুন্দর করার জন্য কতই না সময় ব্যয় করেছে, তার স্বপ্ন বিছানো আছে সেখানে পড়তে পড়তে। ঐ বাড়িতে আমার বৃদ্ধ মায়ের মতো কিংবা আমার দাদার নানার মতো একজন মা কিংবা বাবা অথবা ঠাকুরমা রয়েছেন। কি দোষ করেছেন তারা? তারা শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মালম্বি বলেই কি অপরাধী? তাহলে প্যালেষ্টাইন পুড়ছে, সেটা দেখে আমাদের খারাপ লাগে কেনো? নিউজিল্যান্ডে বোমার আঘাতে মুসল্মান মরছে, সেটা দেখলে আমাদের খারাপ লাগে কেনো? তারাও তো একই অপরাধ করে যাচ্ছে। নীরিহ এবং অসহায় মুসলমানদের উপর অত্যাচার করছে। একবার ভাবুন তো, যদি ঐ বাড়িটা যারা আগুন দিয়েছে তাদের হতো, তাদের কেমন লাগতো? তার প্রিয় আদরের মেয়ে, বা ছেলে ভয়ে ধান ক্ষেতে সারারাত পালিয়ে দেখছে তাদের ঘর পুড়ছে, তাদের বই খাতা পুড়ছে, তাদের সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে, আর তার সাথে সেও দেখছে যে বাড়িতে আগুন লাগার ধংসাত্তক পরিস্থিতি? একবারও কি তারা এসব ভেবেছে? কি নির্মম।

আমার ৫৫ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এদেশের হিন্দুরা রোজার দিনেও প্রকাশ্যে আমাদের রোজাকে সম্মান দেখিয়ে দিনের বেলায় কোনো খাবার খেতে চায় না। এদেশের হিন্দুরা অন্য দেশের হিন্দুদের মতো নয়। আমার অনেক অনেক হিন্দু বন্ধু আছে, খ্রিষ্টান বন্ধু আছে, আমার তো কখনো এটা মনে হয়নি যে, ওদের প্লেটে আমার খেতে খারাপ লাগে, না ওরা কখনো এটা ভেবেছে। আমার বাসার কোনো পারিবারিক দাওয়াতে তো কিছু মানুষ হলেও হিন্দুরা থাকেন যেমন আমি থাকি তাদের অনুষ্ঠানে। কখনো তো আমি এর কোনো ডিসক্রিমিনেশনে ভোগি নাই? আমার দূর যাত্রায় যখন কোনো হিন্দু বন্ধু বা ভাই সাথে থাকেন, আমি তো তাকেই দাড় করিয়ে কোথাও নামাজে রত হই কিংবা সেও কোনো এক মন্দিরে আমাকে পাশে দাড় করিয়ে একটু প্রনাম করে আসে। কখনো এটা আমার কাছে কোনো প্রশ্নের উদয় হয় নাই। সব ধর্মের মধ্যেই কেউ না কেউ উগ্র থাকে কিন্তু সেটা তো সামগ্রিক জনগোষ্ঠি দায়ী নয়।

আমার প্রানপ্রিয় সন্তান যখন কোথাও অসহায় অবস্থানে পড়ে যায়, আর সেই অপরিচিত স্থানে যখন সে তার পরিচিত কোনো হিন্দু মানুষের দেখা পায়, সে তো তার কাছেই ছুটে যাবে কোনো না কোনো সাহাজ্যের জন্য। সেখানে তো কোনো ধর্ম কাজ করে না? তাহলে আজ আমরা কি দেখছি? কারা তারা যারা আমারই সন্তানতুল্য বাচ্চাদের, ঠাকুরমার বয়সি মুরুব্বিদেরকে এবং তাদের আবাসস্থলে এভাবে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিলো। আর কি অপরাধে তাদের এই শাস্তি? কেউ যদি আমাকে আমার কোরআন ধরে শপথ করিয়েও এটা বিশ্বাস করাইতে চায় যে, শারদিয় পুজায় হিন্দুরা আমাদের পবিত্রগ্রন্থ কোরআনকে কোনো এক দেবীর পায়ের নীচে পদদলিল করেছে, আমি কস্মিঙ্কালেও এটা বিশ্বাস করতে চাই না। তারা এমন নয়। তারাও আমার পবিত্রগ্রন্থকে সম্মান করে। এসব একটা উগ্র মানুষের কাজ, আর সে কাজে অবশ্যই কেউ না কেউ মদদ দিয়েছিলো।

আমরা সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু নিয়ে কথা বলি। এটাও একটা ভেদাভেদের মতো। এদেশ যেমন আমার, এদেশ তাদেরও। তারা সংখ্যায় কম এটা কোনো অপরাধ নয়। এই অপবাদ মারাত্তক অন্যায়ের যোগান দেয়। আমি অসুস্থ্য হলে তাহলে কেনো হিন্দু- মুসলমান ভেদাভেদে ডাক্তার বিবেচনা করি না? আমি স্কুল কলেজে শিক্ষা নেয়ার সময় তো হিন্দূ শিক্ষক আর মুসলমান শিক্ষকের কোনো ভেদাভেদ করি না? আমি আকাশ পথে ভ্রমনের সময় কেনো হিন্দু মুসলিম পাইলটের বিবেচনা করি না? আমি ব্যবসা করার সময় হিন্দু মুসলিম কেনো বিবেচনা করি না? আমি যখন যুদ্ধে যাই, তখন আমার পাশের হিন্দু সৈনিকের ব্যাপারে কেনো অপবাদ দেই না? আমি যখন একই নদীতে গোসলে যাই, তখন সেই নদীতে হিন্দু মুসলিমের গোসলে কেনো কোনো প্রকার অসস্থি বোধ করি না? অথচ যেই না ধর্মের কথা উঠলো, তারা সনাতন কিংবা আমার ধর্মের না, তাই তারা আমার বিপক্ষের মানুষ। এটা কোনো সুস্থ্য মানুষের চিন্তাধারা?

আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আর সমবেদনা জানাই আমার সেসব ভাইদেরকে যাদের আমরা অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। তাদের এই অপুরনীয় ক্ষতি এবং ক্ষত আমরা কিছুতেই পুরন করতে পারবো না জানি, তবে আমার অনুরোধ যে, কেউ তাদের জন্য একটা তহবিল একাউন্ট খুলুন। সরকার যা পারবেন তাদেরকে সহায়তা করবেন জানি, এর সাথে আমরা যারা তাদের জন্য ক্ষত বিক্ষত হচ্ছি, আমরাও কিছুটা শরীক হতে চাই। কেউ এই উদ্যোগটা নিন আর সোস্যাল মিডিয়ায় জানান। আমরা অনেকেই আপনাদের পাশে আছি। উক্ত তহবিল দিয়ে আমরা আবার আপনাদের জীবনকে কিছুটা হলেও ক্ষত্মুক্ত করতে চাই। জানি পারবো না, তারপরেও একটা উদ্যোগ নিন কেউ।

পরিশেষে আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর একটি হাদিস উল্লেখ করতে চাই- “সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকায় সংখ্যালঘু অমুসলিমরা আমানতের মত। যারা তাদের কষ্ট দিবে, কেয়ামতের দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে নালিশ করবো (আবু দাউদঃ ৩০৫২)।“