Categories
ছবি দেখিলেই যেনো বুক ধক করিয়া উঠে। অতীতের ছবি তো আরো ধকের মাত্রা বারাইয়া দেয়। অতীতে যে ছবিটা ভালো হয় নাই বলিয়া ছিড়িয়া ফেলিয়াছিলাম, আজ সেই অস্পৃশ্য, ঝাপসা স্যাতস্যাতে ছবীতা দেখিলেও ভালো লাগে। একাগ্রচিত্তে ছবিগুলি দেখিলে বারবার শুধু ইহাই মনে হয়, দিন ফুরাইয়া যাইতেছে। সময়ের ক্রমাগত টিকটিক শব্দে আমার দিনও টিকটিক করিয়াই ফুরাইয়া যাইতেছে। ইহাকে কোন বাধনেই আর থামাইয়া রাখা সম্ভব নয়, আর কেউ পারিয়াছে বলিয়াও আজ পর্যন্ত কোনো দলিল নাই, এবং আগামিতেও কেহ পারিবে ইহার স্বপক্ষে কোনো বিজ্ঞান কিংবা দর্শন আবিষ্কৃত হয় নাই। সময়ের এই টিকটিক শব্দ আমি আমার বুকের প্রতিটি ধুকধুক আওয়াজের মধ্যে, ঘুমের ঘোরে, নিশিথে কিংবা যখন একা থাকা হয় তখনো শুনিতে পাই। যখন একা থাকি, তখন “সময়” যেনো আমার কানে কানে ফিসফিস করিয়া বলিয়া যায়, পিছনে তাকাইয়া দেখিয়াছ কত বেলা পার করিয়া আসিয়াছো? তুমি তোমার জন্মেরক্ষন পাড় করিয়া আসিয়াছো, দুরন্ত শৈশব পার করিয়া আসিয়াছো, তোমার অনেক বেলা পার হইয়া গিয়াছে, এখন আর তোমার জন্য সকাল বলিয়া কোন কাল নাই, বিকালের রোদের আমেজ কি তুমি বুঝিতে পারিতেছো? যদি তুমি ইহা অনুধাবন করিতে না পারো, তাহা হইলে, আয়নার সামনে গিয়া দাঁড়াইয়া এক পলক তোমার চোখের নিচে তাকাইয়া দেখো, অথবা হাত পায়ের রক্ত প্রবাহের ধমনীগুলির দিকে তাকাইয়া দেখো। ইহারা অনেক সময় ধরিয়া অবিরাম কাজ করিতে করিতে প্রায় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। তোমাকে দেখিয়া কি রাস্তার ঐ অবুঝ বালক আর “ভাই” বলিয়া সম্বোধন করে? না করেনা। এখন তোমাকে অনেকেই “চাচা” বা আংকেল” বলিয়া ডাকিতে পছন্দ করে। আর কয়েকদিন অতিবাহিত হোক, দেখিবে, তুমি এই “চাচা” কিংবা “আংকেল” উপাধিটাও ধরিয়া রাখিতে পারিবেনা। তখন কেউ তোমাকে দাদা কিংবা নানা বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিবে। তোমার এখন পা কাপিতেছে, হাত কাপিতেছে, চোখেও খুব ভালো করিয়া সব দেখিতে পাওনা। বৃহৎ অট্টালিকায় উঠিতে এখন তোমার সাহস আর আগের মতো কাজ করেনা, সমুদ্রে ঝাপ দেওয়ারও আর মন টানেনা। তুমি আস্তে আস্তে নির্জীব পদার্থের ন্যায় হইয়া যাইতেছো। এখন একটুতেই বর্ষার পানিতে সর্দিকাশি বাধিয়া বসে, শীত আসিলেই মনে হয়, এই বুঝি রাজ্যের সব ঠাণ্ডা তোমার সারা শরীরের উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে।
ছবি দেখিতে দেখিতে মনটাই খারাপ হইয়া যায়। মনে হয়, আমি কি সত্যি সত্যি একদিন এই নীল আকাশটা আর দেখিতে পারিবো না? এই ফুলগাছ, এই রাস্তার ধার, এই নদীর ঢেউ, এই শীতের হাড়কাঁপুনি ঝাঁকুনি, কিংবা বৃষ্টির শীতল জলেরচ্ছটা কোণো কিছুই কি আমি আর উপভোগ করিতে পারিবো না? সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর রাতে বাড়ি ফিরিবার আনন্দটা কি আর পাওয়া যাইবে না? অথবা পরিবারের সঙ্গে, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে চুটিয়ে ঝগড়া কিংবা হৈচৈ করার অবকাশ কি আর কখনোই আমার হইবে না? মন বড় বিষণ্ণ হইয়া উঠে। মনে হয় এই জনমটা কেনো হাজার বছরের জন্য হইলো না? ভগবান বড় নিষ্ঠুর। কেহ হয়ত ভগবান কে বিশ্বাস করিয়া ইহাই মানি নেন, আবার কেহ ভগমান আছে ইহাই বিশ্বাস করেন না। ভগমানকে অবিশ্বাস করিয়া যদি হাজার বছরের অধিক বাচিয়া থাকা যাইতো, তা না হইলে একটা যুক্তি থাকিত, কিন্তু ভগমান আছে বানাই, এই বিশ্বাসের উপর পৃথিবীতে অধিককাল বাচিয়া থাকিবার কোনো উপায়ও নাই।
শৈশবের উচ্ছল চঞ্চলতা, যৌবনের অদম্য বন্যতা আর এখনকার বৈষয়িক ব্যস্ততার মাঝে কখনোই মনে হয় নাই যে, একদিন আমার এই সাম্রাজ্য, আমার এই আধিপত্যতা, কিংবা এই বাহাদুরী, অহংকার একদিন কোনো একটা ছোট বিন্দুর মধ্যে আটকাইয়া যাইবে যেখানে আমার শ্বাস নীরব, আমার মস্তিষ্ক নীরব, আমার হাত নীরব, আমার শরীর নিথর। আমার সবকিছুই নীরব। আমার চারিধারের কোনো কিছুরই পরিবর্তন হইবে না। তখনো ঠিক সময়েই সূর্য উঠিবে, পাখীরা ঠিক সময়েই কিচিরমিচির করিয়া ভোরের আলোকে জাগাইয়া তুলিবে, প্রাত্যাহিক কাজে সবাই যার যার কাজে ঠিক সময়েই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া আবার ঠিক সময়েই ঘরে ফিরিয়া আসিবে। ঠিক সময়েই সবাই তাহাদের প্রতিদিনের সকালে নাস্তা, দুপুরের খাবার, কিংবা পরিবার পরিজন লইয়া বিকালে শরতের কোন একসন্ধ্যায় বাহির হইয়া পড়িবে, শুধু আমি ছাড়া।
আজ হইতে শতবছর আগেও কেউ না কেউ হয়ত এইভাবেই তাহারা আজকের দিনটার কথা ভাবিয়া ভাবিয়া তাহাদের ঐ সময়ের ব্যথার কথা, এই পৃথিবী ছাড়িয়া যাওয়ার আক্ষেপের কথা, এই পৃথিবী ছাড়িয়া না যাওয়ার আকুতির কথা বলিয়াছিলেন। তাহাদের কেউ হয়ত এই পৃথিবীতে অনেক প্রতাপশালী রাজা ছিলেন, কেউ হয়ত ক্ষমতাশিল সেনাপতি ছিলেন, কেউ হয়ত কোটিপতি ধনকুবের ছিলেন, কিন্তু কেহই এই প্রস্থানের রাহু গ্রাস হইতে মুক্তি পায় নাই। আমার কোন পূর্বসুরী যেমন পায় নাই, আমিও পাইবো না আর আমার পরের কোনো উত্তরসুরীও পাইবে না। আজ যতো সুখ নিয়াই এই পৃথিবীতে বিচরন করি না কেনো, যত অভিযোগ নিয়াই বাচিয়া থাকি না কেনো, কিংবা যত কষ্ট নিয়াই দিন যাপন করিনা কেনো, যখন কেউ থাকে না, তখন তাহার প্রতি মুহূর্তের হাসি, উচ্ছ্বাস, মহব্বত, গালি কিংবা মেজাজের প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়। এই প্রতিধ্বনি কখনো কাউকে কাদাইবে, কখনো কাউকে একা একাই হাসাইবে, আবার কাউকে এমন এক জায়গায় নিয়া দাড় করাইবে যেখানে মনে হইবে, হয়ত আমার বাচিয়া থাকাটা তাহাদের জন্য খুব প্রয়োজন ছিলো। হয়ত সব রাগ, অভিমান, অভিযোগ সত্তেও মনে হইবে আমার চলিয়া যাওয়ার কারনে এই শুন্যস্থানটা কেহই পুরন করিবার মতো নয়। তখনো এই ছবিগুলিই নীরবে কথা বলিবে।
কিন্তু তাহার পরেও সবচেয়ে সত্য উপলব্ধি হইতেছে, একদিন, সবাই আমরা একে অপরের হইতে আলাদা হইয়া যাইবো। কেউ আগে আর কেউ পড়ে। আমরা সবাই একদিন একজন আরেকজনকে হারাইয়া ফেলিবো, মিস করিবো। দিন, মাস, বছর কাটিয়া যাইবে, হয়ত কাহারো সাথে আর কাহারো কোনো যোগাযোগ থাকিবে না। একদিন হয়ত আমাদের সন্তানেরা, নাতি নাতিনিরা আমাদের অতিতের সব ছবি দেখিয়া কেহ কেহ তাহাদেরই সাথী লোকেদের প্রশ্ন করিবে, “কে এটা? কে ওটা?” তখন হয়ত অনেকেই চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে অদৃশ্য কোনো এক মুচকি হাসি দিয়া বলিবে, “এরা ছিলো ওই সব লোকজন যাদের সঙ্গে আমি আমার সবচেয়ে ভালো কিছু সময় কাটিয়েছি। আজ ওরা কেউ নাই।” এরই নাম ছবি। কথা বলেনা কিন্তু সময়ের ইতিহাস হয়ে থাকে।
আমি কি কেবলই ছবি? তারা কি কেবলই ছবি যারা আজ থেকে শত বছর আগে এই পৃথিবীতে এসেছিলো এবং এখন যারা আর কোথাও নাই? কেউ কেউ তো আবার কোথাও ছবি হিসাবেও নাই? অথচ তারাও এক সময় আমার মতো এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বড় হয়েছে, তাদের মধ্যেও প্রেম এসেছিলো, মহব্বত এসেছিলো। তারাও সংসার করেছে, জীবনের প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে অন্যত্র সঞ্চালিত হয়েছে। তারাও নীল আকাশ দেখে, নদীর পানি দেখে, বসন্তের ফুল আর ফুলেল পরিবেশে কখনোকখনো কবিতাও লিখেছে। গ্ন গুন করে গান গেয়েছে। পাখির কোলাহলে তারাও কখনো কখনো আপ্লুত হয়েছে। তাদের সময়েও শীত বসন্ত, বর্ষা, সব ই এসেছে। তারাও কারো না কারো সাথে হাত হাত ধরে জীবনের অনেক পথ পড়ি দিয়েছে। এদের অনেকেই হয়ত আজিকার আমাদের থেকেও অনেক নামি দামী নামুসের মতো ছিলেন। আরো কত কি? কিন্তু ওই সব গুনীজনেরা, মানুষ গুলি আজ কোথাও নেই। কেউ হয়ত কারো কারো ড্রইং রুমে ছবি হয়ে আছে, কিন্তু তার দেহ পচতে পচতে মাটির সাথে মিশে দেহ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। যেই হাড় গুলি ছিলো, সেগুলিও এদিক সেদিক হতে হতে ও গুলো আর কোথাও খেজে পাওয়া যাবে না। যে কবরে একদিন তাদেরকে শুইয়ে হাজার হাজার লোক, আত্মীয় সজনেরা বিলাপ করেছিলো, সেই সব আত্তীয় সজনেরাও আজ কোথাওহয়ত নাই। ওই কবরেই হয়ত একে একে শুইয়ে আছেন। ওই কবরটাও কারো একচ্ছত্র নয়।
এই পরিসংখ্যানে আমি ও তাহলে নিছক একটা ছবি এবং কোনো এক সময় এই ছবি থেকেও আর কোথাও নাই। আমার ইতিহাস এই পৃথিবীর কেউ মনে রাখবে না। আমার আজকের দিনের এই রাজত্ব, আমার সাম্রাজ্য, আমার রেখে যাওয়া সব সম্পদ আর সম্পুতি হয়ত হাত বদলের মাধ্যমে আমার বংশ পরম্পরায় কারো হাতে সেটা পৌঁছেযাবে কিন্তু আমার নাম, আমার আজিকার দিনের পরিশ্রম, আমার আজিকার দিনের কোনো কিছুই তার কাছে পৌঁছে যাবে না। সে হয়ত জানবেই না, কার সিঙ্ঘাসনে বসে তিনি কার উপরে প্রতিনিধিত্ব করছেন। হয়ত তিনি জান্তেও চাইবেন না।
তাহলে কিসের জন্য? কার জন্য?
আজ যারা তোমরা আমার এই মন্তব্য গুলি পড়ছো আর ভাবছ, তাহলে কি আমরা সবাই হাত গুটিয়ে কোনো কিছুই ক্করবো না? হ্যা, করবো। শুধু নিজের জন্য আর নিজের আরামের জন্য।
তোম্রাও এক সময় আসবে, আমার মতোই চিন্তা করে আমাকে সালাম জানবেই।
চলো আমার ডায়েরীতে