গ্লোবাল অর্ডার চোখের সামনে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অথবা অন্য অর্থে যদি বলি- এটা পরিবর্তন হবারই কথা ছিলো। কিন্তু সে সময়টা কখন এবং কবে সংঘটিত হবার কথা ছিলো সেটা নির্ধারিত ছিলো না। বড় বড় ঘটনা হটাত করেই সংঘটিত হয়, আর হটাত করেই বিষ্ফোরন ঘটে।
যে কোনো বড় পরিবর্তনে সকল পক্ষেই কিছু হট, কোল্ড, চালাক এবং নির্বুদ্ধিওয়ালা নেতা থাকে। অথবা এসব গুনাবলীওয়ালা নেতাদের আবির্ভাব হয়। আর এটা হতে হয় একই সময়ে। সবাই চালাক হলে কিংবা সবাই নির্বুদ্ধিওয়ালা হলে বড় বড় ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। ১ম মহাযুদ্ধের কথা বাদই দিলাম, ২য় মহাযুদ্ধ যদি আমরা বিশ্বনেতাদের পরিচয় দেখি, তাতে দেখবো, মুসুলিনি (ইতালী), হিটলার (জার্মান), চার্চিল (ইউকে), স্ট্যালিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন), রুজভেল্ট (আমেরিকা), তোজো (জাপান), চার্লস ডি গুয়ালে (ফ্রান্স) এদের জন্ম হয়েছিলো। এদের একপক্ষ ছিলো সামরিক খাতে শক্তিশালী কিন্তু হট হেডেড। অন্য দিকে আরেক পক্ষ তাদেরও সামরিক খাত যৌথভাবে শক্তিশালী ছিলো কিন্তু সেসব নেতারা অন্য পক্ষের মতো এতো হট হেডেড ছিলো না। এক্সিস পাওয়রে ছিলো হিটলার, মুসুলিনি এবং তোজো। অন্যদিকে এলাইড পাওয়ারে ছিলো বাকী সব।
অসম্ভব ক্ষমতাধারী হট হেডেড হিটলারকে নিঃশর্ত সাপোর্ট করেছে মুসুলিনি এবং তোজো, কখনো বুঝে, কখনো না বুঝে। তারা এটাই মনে করেছে যে, হিটলার যা বলবে সেটাই ঠিক। তাই হিটলারের পরিকল্পনায় কেউ কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নাই বরং নিসশর্তভাবে সাপোর্ট দিয়ে হিটলারকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছিলো। আর এর কারনও ছিলো- তারা প্রাথমিকভাবে সব সমরক্ষেত্রে সাফল্যও পাচ্ছিলো। কিন্তু এই সাফল্য কতটুকু টেকসই ছিলো সেটা তারা ভাবতে ভুল করেছিলো। অন্যদিকে এলাইড পাওয়ারের মধ্যে ছিলো বেশ কিছু বুদ্ধিমান নেতা যারা কখন কোথায় কতটুকু ফোর্স নিয়ে কিভাবে কাকে আক্রমন করতে হবে এবং কার কতটুকু দায়িত্ব সেটা খাতা কলমে বেশ পরিকল্পনা মাফিক ছকে আকা ছিলো। ফলে, কিছুটা সময় পরে যুদ্ধের মোড় পুরুই ঘুরে গিয়েছিলো।
তখন যুদ্ধটা ছিলো শুধুই সামরিক অস্ত্র আর দক্ষ সৈন্যবলের কেরামতি। কিন্তু এবারে প্রক্সিওয়ার সে রকমের নয়। এখানে সবাই জড়িত, কেউ সরাসরি, কেউ পরোক্ষভাবে আবার কেউ নীতিগতভাবে। এখানে শুধু সামরিক অস্ত্র আর দক্ষ সৈন্যবলই শেষ কথা নয়। এখানে জড়িয়ে আছে প্রতিটি দেশের অর্থনইতিক কর্মকান্ড, জিওপলিটিক্যাল ইনফ্লোয়েন্স, ইউনিপোলারিটি ভার্সেস মাল্টিপোলারিটির মতো হিসাব কিতাব আর আছে কলোনিয়ালিজমের বা দখলদারিত্তের মতো কিছু মোগলগিড়ির বিপক্ষে একটা ক্ষোভ। স্পেশাল অপারেশনটা যদি এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যেত, তাহলে এতো কিছুর হিসাব কিতাব হয়তো আসতো না। কোনো না কোনো কারনে এই স্পেশাল অপারেশনটা ইচ্ছে করেই যেনো কেউ দীর্ঘায়িত করছে। আর এর ফলে অনেক হিসাব সবার কাছে বেরিয়ে আসছে, কার কি ইন্টারেষ্ট। থলে যে এতো বিড়াল ছিলো আমরা সেটা এই যুদ্ধ শুরুর আগে বুঝতেও পারিনি। কোনোটা বুনু বিড়াল, কোনোটা বাঘা বিড়াল, কোনোটা মিচকে বিড়াল, কোনোটা আবার চাপাহুয়া বিড়াল।
২য় মহাযুদ্ধের বিভীষিকা যুদ্ধের সময় সাধারন জনগন যতোটা না উপলব্ধি করেছে, তার থেকে বেশী উপলব্ধি করেছে যখন নুরেনবার্গ ট্রায়াল শুরু হয়। মানুষ এর গভীর ক্ষতের কথা, মানুষের সাফারিংস এর কথা, যুদ্ধের আসল মোটিভের কথা ইত্যাদি সাধারন মানুষ জানতে পেরেছিলো সেই নুরেনবার্গ ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে। আর এখন ইউক্রেনের এই স্পেশাল অপারেশনের সময়কাল দীর্ঘায়িত হবার কারনে আমরা আমজনতা ধীরে ধীরে এটা বুঝতে পারছি কে কার বিপক্ষে কি নিয়ে কথা বলছে আর সেভাবে কে কার সাথে জোট পাকাচ্ছে।
আফ্রিকা (যার কাছে আছে ৫৪টি ভোট ইউএন পরিষদে) এখন সবার মাথা ব্যথা হয়ে দাড়িয়েছে। কে আফ্রিকাকে কন্ট্রোল করবে, কতটুকু কন্ট্রোল করবে, আর কিভাবে কন্ট্রোল করবে। অথচ এই আফ্রিকাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, যুগের পর যুগ না খেয়ে মরতে হয়েছে, তাদের রিসোর্স চুরি হয়েছে, তাদেরকে অগ্রসর হবার কোনো পথই কেউ দেখায় নাই। সব কলোনিয়াল মোড়লেরা সব সময় একে ব্যবহার করেছে তাদের রিসোর্স লুন্ঠন করে করে। একসময় এই সেন্টার অফ ফোকাস ছিলো মধ্যপ্রাচ্য। সেই মধ্যপ্রাচ্য এখন সবার হাতের বাইরে। তারাও কলোনিয়ালিজমের গন্ডি থেকে বেরিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ভারতবর্ষ একসময় ইতিহাসের নির্মম শিকার হয়েছে, তার বুকচিড়ে পাশ্চাত্যরা যা পেরেছে লুন্ঠন করেছে, প্রায় ২০০ বছর নাগাদ নিজের দেশেই তারা ক্রীতদাসের মতো জীবন যাপন করেছে। সেই ভারতবর্ষ এবার যেনো তাদের ইতিহাসের প্রতিশোধ নিতে চায়। রুখে দাড়িয়েছে। সোভিয়েট সবসময়ই পাশ্চাত্যের দুষমন ছিলো, সেটা এখনো আছে। সোভিয়েট ভেংগে ১৫টি দেশে রুপান্তরীত হয়েছে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই। কষ্ট নাই এমন হতে পারেনা। চীন সবসময়ই চালাক ছিলো। তারা পারতপক্ষে কারো সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না। তারা মনে করে, যুদ্ধে যে পরিমান অর্থ আর মানুষের ক্ষতি হয় সেটার বদলে সেই অর্থ আর জনবল দিয়ে অন্য দেশকে কন্ট্রোল করা সহজ। আর সেটা স্থায়ী। ফলে চীন একাধারে আফ্রিকা, দক্ষিন এশিয়া, ভারতবর্ষ, এবং রাশিয়ার সাথে কোলাবরেটর হিসাবে অন্যত্র সহযোগী হয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে লিপ্ত। এখন চীন সবার জন্যই একটা মাথাব্যথার কারন।
যাক যেটা বলছিলাম, একই সময়ে কিছু কিছু নেতাদের আবির্ভাব ঘটে যেখানে একপক্ষ আরেক পক্ষ থেকে কম বুদ্ধিমান অথবা একদল হট হেডেড আর আরেক দল কোল্ড হেডেড। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা একেবারেই দৃশ্যমান। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অধিকাংশ নেতারা কোথায় যেনো কোনো এক পরাশক্তির কাছে সারেন্ডার করে আছে নিসশর্তভাবে যেমন করেছিলো তোজো, কিংবা মুসুলিনি হিটলারের কাছে। ফলে ক্রমাগত বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারনে যে শক্তির উপর আজকে এই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দাঁড়িয়ে সেটা যেনো ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। পেট্রোডলার মার খেয়ে যাচ্ছে, এনার্জি রিসোরসের ঘাটতির কারনে ইউরোপ প্রায় ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের মধ্যে পড়ে গেছে। অন্যদিকে ইউরোপের বাইরে প্রতিটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষোভের কারনে তারা এবার একসাথে এমন করে জোট পাকিয়ে যাচ্ছে যে, যারা এতোদিন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এদের সবাইকে ভয়ের মধ্যে রেখেছিলো তারাই সেই সব দেশের একীভুত হবার কারনে নিজেরা যেনো একা হয়ে যাচ্ছে, আর নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলিই এখন বড় সংঘটনে রুপ নিচ্ছে। এককালের ক্ষমতাধর দেশ ব্রিটেন নিজেই যেনো এখন ছোট একটা দ্বীপে রুপান্তরীত হচ্ছে, ইউরোপ শরনার্থির চাপে এবং উচ্চ ইনফ্লেশনের মুখে তথা এনার্জি ক্রাইসিসে ডি-ইন্ডাস্ট্রিলাইজেশনের মুখে বড় বড় বিলিওনারেরা দেউলিয়ার দিকে এগুচ্ছে। একচেটিয়া রিজার্ভ ধারনকারী দেশসমুহ তাদের ক্রেডিবিলিটি হারিয়ে এখন মাল্টি কারেন্সির স্রোতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে। আর এর মধ্যে একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্তে যেনো আরো গভীর সমস্যায় পতিত হবার লক্ষন দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়- যারা নিজের সম্পদকে রক্ষার জন্য এসব দেশে জমা করতো তাদের সেই সব সম্পদ এখন পুরুটাই অনিশ্চয়তার পথে। ফলে ভবিষ্যতে আর কেউ অধীক নিশ্চয়তার লক্ষে কখনো তাদের সম্পত্তি এসব দেশে রাখবে কিনা সে ব্যাপারে শতভাগ সন্দেহ আছে।
আজকে ছোট ছোট দেশ যারা অন্য বিগ পাওয়ারের উপর নির্ভরশীল, তারা হয়তো মুখ সেটে বসে আছে, কিছু বলছে না কিন্তু ক্ষোভ তো ভিতরেই জমা হয়ে আছে। নিজের দুক্ষের কথা কাউকে বলতে পারছে না মানে এই নয় যে, তাদের কষ্ট নাই। তাদের এই কষ্টের কথা যারাই শুনবে, তাদের দলেই একদিন এরা ভিড়ে যাবে খুব গোপনে। তখন এদেরকেও আর পাশে পাওয়া যাবে না। কেউ তো আছে এদের কথা শুনবে।
আজকের দিনের এই ইতিহাস যেদিন মানুষেরা উপলব্ধি করবে, সেদিন হয়তো প্রিথিবী শান্ত হয়ে যাবে আর আমরা গবেষনাগারে বসে বসে এটাই বিশ্লেষন করবো কখন কে কোথায় কি ভুল করেছিলো। আর এভাবেই “সময়” নামক অপরিবর্তনশীল ফ্যাক্টরটি তার রাজত্ব চালিয়ে যায় যেখানে এক সময় রোম, এক সময় জার্মান, এক সময় ফ্রান্স, এক সময় ব্রিটিশ, কিংবা আমেরিকাকে লিডার হিসাবে বসিয়েছিলো। আর সবাইকে সেই লিডারকে মানতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু সেই “সময়” নামক ফ্যাক্টরটি যে সব সময় সবার সাথে থাকে না, এটাই আমরা হট এবং কোল্ড হেডেড মানুষেরা বুঝতে অক্ষম। পচা সামুকে পা কাটে এটা আমরা অনেক পরে বুঝি যখন পা কেটে যায়।
সম্ভবত এখন “সময়” তার নিজের অভিযান চালিয়ে আবার পুনরায় বিশ্বকে ঢেলে সাজাচ্ছে। কে এখন পরবর্তী পথ প্রদর্ষক সেটা দেখার বিষয়।