২১/০৪/২০১৬-নবাবের কবরে একদিন

Categories

হ্যালো নবাব, কেমন আছো তুমি?

দেখো কি অবাক করার কান্ড। কোনোদিন কি কখনো ভেবেছো কিংবা আমিই কি ভেবেছি যে, তোমার মতো একজন নবাবের সামনে আমি এভাবে দাঁড়িয়ে সম্ভাষন করবো? তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই তো ছিল না। তুমি যখন এই পৃথিবীতে জন্মেছিলে তখন আমার পূর্ব পুরুষেরাও হয়ত জন্মগ্রহন করে নাই। কি করে তাহলে তোমার সাথে আমার দেখা হতো? তারপরেও আজ আমার সঙ্গে তোমার দেখা হলো। আমি দাড়িয়ে আছি ঠিক তোমার পাশে, তুমি শুয়ে আছ একদম একা, যদিও সেটা একটা কবর। তোমাকে একা পাবো এবং তোমার মত মানুষের সাথে একা দেখা করা যায় এটা আমার কেন এই ভারতবর্ষের কোন জনগনই তো বিশ্বাস করবে না। তোমার রানী(দের) যেখানে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুমতি লাগতো সেখানে আমরা কোন ছাড়! কিন্তু দেখো, অদৃশ্য বিধাতার কি ক্ষমতা, তিনি সব পারেন।  তাও আবার প্রায় চারশত বছর পর আমার সঙ্গে তোমার দেখা। আমি জীবিত আর তুমি মৃত। জীব-মৃতের এই খেলা শুধু একজনই পারেন, আর সেটা বিধাতা। তাঁর কাছে সময় যেমন স্থবির, জীবন ও স্থবির। জীবিত আর মৃতের মাঝখানে তিনি শুধু ফারাক রাখেন অদৃশ্য কোনো এক জাল, যা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু শেষে এক জায়গাতেই মিলিত করেন।

যাক সে কথা, ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করতে চাই না, না তোমার কাছে এর কোনো উত্তর আছে। যেহেতু তোমার সঙ্গে আমার আজ দেখা হয়েই গেলো, আমার কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল তোমাকে নবাব। তোমাকে সব কিছুর উত্তর দিতে হবে এমন কোন কারন নাই, কারন তুমি নবাব, অনেক কিছু তুমি আমাদের মত সাধারন মানুষকে নাও জানাতে পার। তবুও যদি সম্ভব হয় শুনতে পারলে হয়ত ভাল লাগবে।

আমি তোমাদের আমলের সেই উপমহাদেশের রাজনীতি বুঝি না, কিভাবে দেশ চালাতে হয়, তাও আবার উপমহাদেশের মত একটি সাম্রাজ্য, তারও কোন আইডিয়া আমার নাই। তারপরেও আমি খুব অবাক হই কি করে তুমি এতবড় একটা উপমহাদেশ তুমি তোমার নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলে? তুমি কি কোন ক্যাডার বা রাজনৈতিক দলের মত দল করতে যারা তোমার এইসবে সাহাজ্য করতো? তোমার কোন বিরুধী দল ছিলো কি নবাব? তোমার সম্পদের হিসাব আমি জানি না কিন্তু শুনেছি তোমার নাকি অনেক সম্পদ ছিল। তুমি কি কোন ব্যবসা করতে নাকি নবাবীই তোমার পেশা ছিলো? তুমি কি কখনো কোন বেতন নিয়েছো? আর নিলে কত টাকা করে বেতন নিতে? আচ্ছা নবাব, তোমার কি কোন ব্যাংক একাউন্ট ছিল? সুইস ব্যাংক বা বিদেশী কোন ব্যাংক? তোমার কোনো ক্যাশ টাকা পয়সা লাগতো না? রানীরা তোমার কাছ থেকে কখনো ক্যাশ টাকা পয়সা চাইতো না? প্রজারা কি তোমাকে খুব ভালবাসতো? তোমাকে কি কেউ ঘৃণা করতো কখনো? আর কেউ যদি তোমাকে কখনো ঘৃণা করতো, তাহলে তুমি তাকে কি করতে? মেরে ফেলতে? গুম করে ফেলতে? নাকি বিরোধী মতবাদের কারনে তাকে রাজ্য ছাড়া করতে? তোমাদের সময় কি কোন টক শো হতো? সেই টক শো তে কি কেউ বিজ্ঞজনের মতো তোমাকে বা তোমার শাসন কালকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো? নাকি সভাসদ পরিষদে তুমিই শুধু একা কথা বলতে? তুমি কি কখনো ভেবেছিলে তুমি একদিন এই পৃথিবীতে থাকবে না? কখনো কি তোমার এই উপলব্দি হয়েছিল যে তোমার মরনের পর তোমাকে নিয়ে জনগন সমালোচনা করবে? কখনো কি ভেবেছিলে যে, তোমার গড়া এই অট্টালিকা, এই সাম্রাজ্য, তোমার চেয়ার, তোমার খাট, তোমার সবকিছু অন্য একজন ব্যবহার করবে আর তুমি অন্য সবার মত এই ভিজা মাটির নিচে স্যতস্যতে জায়গায় কোন এক অন্ধকার পরিবেশে শুয়ে থাকবে? কখনো কি তোমার জীবদ্দশায় এই উপলব্ধিটা হয়েছিল যে, তুমি আর কখনই এই পৃথিবীর আলো বাতাস, গাছ, ফল মুলাদি, আতর সুগন্ধি, রানী রমণী, সোনা দানা, ক্ষমতা, কোন কিছুই উপভোগ করতে পারবে না? এমন কি তুমি আর ফিরেও আসতে পারবে না? এমন কখনো কি তুমি একবারের জন্যও ভেবেছিলে?

তুমি কি এখনো আগের মত দেশি বিদেশী অনেক পানীয়, রাজ্যের সব সুন্দরীদের সমন্নয়ে বাইজীর আসর, শ্বেত পাথরের কিংবা কষ্টি পাথরে গড়া মোজাইক ফ্লোর, সোনার পালঙ্ক, অনেক মহামুল্যবান হিরের আংটি, জহরতের মালা, আর্দালি, পাইক পেয়াদা যে সব তোমার এখানে একসময় ছিল, তা পাও ওখানে নবাব? তোমার আশেপাশে কি তোমার অতি প্রিয় সেনাপতি, মন্ত্রী মহোদয়, উজির নাজির আছে যারা এক সময় তোমার অংগুলীর ইশারায় সারা দেশ কাপিয়ে দিতো? তোমার একা থাকতে এখন কষ্ট হয় না? তোমার কি আবার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে তোমার সেই রাজকীয় প্যালেসে কিংবা ঘুমাতে ইচ্ছে করে ঐ সোনার খাটে যা তুমি পারস্য রাজ্য থেকে ছিনিয়ে এনেছিলে একদিন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সব।

জানো নবাব, আমার মাঝে মাঝে তোমাকে বেশ বোকা বোকা বলে মনে হয়। তুমি এতকিছু বুঝতে পেরেছিলে, উপমহাদেশ কিভাবে চালাতে হয়, কিভাবে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য দখল করতে হয়, কেমন করে বিনা ব্যবসায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিজের করে নিতে হয়, অমর হয়ে থাকার জন্য কত বিশাল বিশাল প্যালেস বানাতে হয় কিন্তু তোমার মরনের পর তোমাকে কে দেখভাল করবে, তোমার এই সিংহাসনে যেন কেউ না বসতে পারে, শুধু তোমার আদেশই যেন আজিবন চলে, সেই ব্যবস্থাটা কেন করে যেতে পারলে না নবাব? বিধাতার দেওয়া ধর্ম পাল্টে তুমি ‘দ্বীনে এলাহি’ও করে ফেললে, কোন পরোয়া করলে না। তুমি তোমাকে তাঁর সমকক্ষ ভাবতে পারলে, অথচ তুমি তাঁরসঙ্গে আরও একটু সমঝোতা করলেই কিন্তু তুমি অনেক কিছু করতে পারতে। এটা কিন্তু তুমি বোকামী করেছো।

নবাব থাকা অবস্থায়ন ন্যায় অন্যায়, সৎ অসৎ কোনো কিছুই পরোয়া করলে না, এর মধ্যে কোন ব্যবধান করলে না, মানবাধিকার, ভদ্রতা, সৌজন্যতা, বিচার-অবিচারের মধ্যে তুমি কিছুই ফারাক করলে না, তোমার যা ইচ্ছে তাই তুমি করতে পারলে কিন্তু তুমি কি একবারো ঐ অদৃশ্য বিধাতে কিছু ঘুস দিয়ে তুমি অমরত্ব নিতে পারলে না নবাব? তোমার তো কোন কিছুরই কমতি ছিল না। কি হত যদি উপমহাদেশের কিছু জায়গা, জমি, অথবা সোনা দানা, জহরত, হিরা, সুন্দরি রমণী দিয়ে ঐ অদৃশ্য ভগবানকে বশ করতে? তাহলেই তো তুমি আজ বেচে থাকতে পারতে, তোমার সঙ্গে আজ আমার সরাসরি জীবন্ত শরীরে দেখা হতো।

আচ্ছা নবাব, তুমি তো প্রায় চারশত বছর আগে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছো। তুমি দেখতে কি এখনো আগের মত আছো? তোমার গলায়, তোমার হাতে যেসব সোনাদানা হীরা জহরত ছিল সেগুলি কি তোমার সেনাপতিরা, তোমার উপদেষ্টারা তোমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলো? তুমি কি ওগুলো এখনো হাতে গলায় মাথায় পড়ে থাকো? নাকি খুলে রেখেছো? কোথায় রেখেছো এখন এগুলো? তুমি কি আরও বৃদ্ধ হয়েছো? নাকি যেহেতু কোন টেনশন নাই, ফলে তুমি আরও সুন্দর হয়েছো? তোমার সেনাপতিরা, তোমার সুন্দুরি রমণীরা তোমার অসংখ্য ছেলেপুলেরা, নাতি নাতকুরেয়াও আজ অনেকেই এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে যাদেরকে তুমি খুব ভালবাসতে। তোমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে? শুনেছি, মানুষ মরার পরে নাকি কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর সারা শরীর পচন ধরে, পোকারা খেয়ে বিনাশ করে শরীর, তারপর ধীরে ধীরে হাড়ও মাটির সাথে মিশে যায়। মাথার খুলিটা কেউ দেখলে এটাও বুঝা যায় না, সে কি রাজা ছিলো নাকি প্রজা? নাকি মহিলা অথবা পুরুষ? তোমারো কি একই হাল হয়েছে নবাব? নাকি তুমি অনেক শক্তিশালী ছিলে বলে পোকারাও তোমাকে বিনাশ করতে পারে নাই?

জানো নবাব, আমি মাঝে মাঝে খুব অবাক হই এই ভেবে যে, তোমার অনেক বংশধরেরা কিন্তু এখনো এই পৃথিবীতে বেচে আছে। কিন্তু কে কোথায় কিভাবে বেচে আছে তাদের কোন হিসাবও আমরা জানি না। আর তারাও যে কেনো বলে বেড়ায় না যে তারা নবাবের বংশের লোক! কেনো নবাব? কি জানি হয়ত তোমার বংশের লোক বলে জানাজানি হয় গেলে না জানি আবার কি বিপদ হতে পারে এই ভেবে হয়ত বলে না। হয়ত এমনও হতে পারে, তুমি জনগনের উপর টর্চার করেছো এই অভিযোগে তারা এখন তোমার বংশের উপর খুব রাগান্বিত, হয়ত এমনো হতে পারে যে তোমার অবিচার, অন্যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, তোমার বেহিসাবি খরচের তালিকা ইত্যাদির কৈফিয়ত তারা দিতে পারবে না বলেই এখন নিসচুপ জীবন বেছে নিয়েছে। আবার এমনও হতে পারে তোমার অন্তর্ধানের পর তোমার এই বিশাল সাম্রাজ্য ধরে না রাখার কারনে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় অগোচরে থাকাই ভাল এই যুক্তিতে প্রকাশিত হয় না, আবার এমনও হতে পারে আসলেই কেউ আর বেচে নেই তারা। বড় অবাক লাগে যে, এককালের এতো প্রতাপশালী নবাবেরা এভাবেই বংশসহ হারিয়ে যায় এই পৃথিবীর বুক থেকে। ওদের শুধু ইতিহাস বেচে থাকে কিন্তু বংশ বেচে থাকে না। অথচ তোমার আশেপাশে যারা ছিল তাদের অনেকের বংশধরেরা এখন অনেক বড় লোক, কেউ আবার রাজনীতি করে, কেউ বড় বড় ব্যবসায়ী, ওদের অনেক টাকা, সুইস ব্যাংকে, বিদেশী ব্যাংকে, আরও অনেক দেশের ব্যাংকে। ওরা এক দেশের সরকারের আরেক দেশের সরকারের সঙ্গে বসে গল্প করে, তাস খেলে, মদ খায়, ফুর্তি করে, আরও কত কিছু? কিন্তু তোমার বংশের কোন লোককেই আমি চিনি না নামও জানি না আদৌ ওরা কেউ আছে না নাই।

যাক, নবাব, আমাকে এখানে অনেক সময় থাকতে দিবে না কারন তুমি নবাব, তোমার পাশে অনেক্ষন দাড়াতেও আমাকে দিবে না। আবার কখনো যদি তোমার এখানে আমার আসা হয়, তোমার সঙ্গে আমার আবার কথা হবে, যদি পারো আমাকে একটু জবাবগুলো দিও।

তুমি ভাল থাকো নবাব।