২১/০৬/২০২১- মৃত্যু

মৃত্যুকে মানুষ আধারের সাথে তুলনা করে থাকে। কিন্তু এই আধার কোনো কালো রাত কিংবা অমাবশ্যার নিশি বা দিনের আলোর অভাবে নয়। যা চোখে দেখা যায় না, যার ব্যাপারে আমাদের মন এবং মস্তিষ্ক কোনো ধারনা করতে পারে না, আমাদের কাছে সেটাই একটা আধারের মতো। এই আধার কিন্তু অন্ধকার নয়, এটা এমন একটা আধার যার কোনো রং নাই, যার কোনো বর্ননা আজো কেউ দিতে পারে নাই। মানুষের হাজারো শখ থাকে। বেচে থাকার শখ, সম্পদশালী হবার শখ, অনেক ক্ষমতাধর হবার শখ, কিন্তু আজো পর্যন্ত কেউ এটা শখ করে নাই যে, সে মরতে চায়। যারা আত্তহত্যা করে, তারা ইমোশনাল, তারা শখের বশে মরনকে বরন করে না। মৃত্যু কোনো ইচ্ছে নয় যে, পুরন হবে কি হবে না, মৃত্যু তো একটা সত্য, একটা লক্ষ্য যেখানে সবাইকে যে কোনো মুল্যেই পৌছাতে হবে। আর ওখানকার সমন, গাড়ি অথবা বাহক কখন আসবে, সেটা তো কেহই বলতে পারে না। এই মৃত্যু অনেক সম্পর্ক ছেদ করে আবার এই মৃত্যুই অনেক নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। কখনো কখনো মৃত্যুটাই যেনো অনেক সমস্যার সমাধান নিয়ে আসে। যদিও যার বেলায় ঘটে সে সমস্যা ছিলো না।

মৃত্যুর কারনে এমনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যেখানে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় অথবা মেনে নিতে শিখতে হয়। হোক সেটা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। যখন কোনো মানুষ কিছুই না বলে সে তার পরিবার থেকে হটাত করে উধাও হয়ে যায়, তখন ব্যাপারটা অনেক দুসচিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায়। এটা আরো বেশী করে দুশ্চিন্তায় ভোগায় যখন এটা জানা যায় যে, যে মানুষটি চলে গেছে সে সব দিক থেকে অশান্তিতেই ছিলো।

কিন্তু কোনো মানুষ যখন কাউকে না বলে চিরতরে আমাদের জীবন থেকে চোখের সামনে মৃত্যুর থাবায় হারিয়ে যায়, আর আমরা তাকে চোখের জলে ভিজিয়ে বিদায় জ্ঞাপন করি, তখন হয়তো তার দ্বারা কোনো ভুল পদক্ষেপের দুশ্চিন্তা আমাদের গ্রাস করে না, কিন্তু তার চলে যাওয়ায় যারা বেচে থাকেন তাদের জীবনে আমুল পরিবর্তন নেমে আসে বলে মাঝে মাঝে মনে হয় রাস্তাটা অন্ধকার, জীবনটা ভয়ংকর এবং আমরা সর্বত্রই একা। তখন একটা দিনও যেনো আমাদের ঠিকঠাক কাটতে চায় না। এমন কি একটা রাতও না। এই সময়ে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে শিখতে হয়। অন্যদিকে দিনের আলোতে এই পার্থিব জগতে বসে মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে কোনো ধারনাই করা সম্ভব হয় না আমাদের অথচ মৃত ব্যক্তির যাত্রার শুরু থেকে শেষ অবধি রাস্তাটা তার কাছে হয়তো আমাদের থেকেও ভয়ংকর আর বিভীষিকাময়আরো অন্ধকার। এটা যেনো তার কাছে ঠিক একটা অন্ধকার টানেল, যেখানে মাঝে মাঝে আলো আসে হয়তো কিন্তু সে আলোয় কোনো কাজ হয় কিনা জানা যায় নাই।

এমন অনেক মিথ্যে মৃত্যু আসে কারো কারো জীবনে যেখানে তারা এই পার্থিব জীবনের সাথে সাময়িক সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আরেক কোনো এক অচেনা জগতে বিচরন করতে থাকে। তখন তার আশেপাশে কি হচ্ছে, কারা কি করছে, কিছুই আর তার কাছে পৌছায় না অথচ তার দেহ, তার শরীর পুরুটাই রয়েছে এই পার্থিব জগতে। এই প্রকারের মৃত্যু থেকে ফিরে আসাকে হয়তো বলা যায় কোনো মতে বাচা, হয়তো বা বলা যেতে পারে জীবনের কাছে নিশ্চিত মৃত্যুর পরাজয়, অথবা বলা যেতে পারে যে, জীবনের বেচে থাকার সময়টা এখনো শেষ হয় নাই। যখন এমনটা হয় তখন আমরা কি বলতে পারি যে, সাক্ষাত ম্রতুকে আমরা দেখতে পেয়েছি? এমন অনেক প্রশ্ন থাকতেই পারে কিন্তু আসল মৃত্যু আর মিথ্যা মৃত্যুর মধ্যে নিশ্চয় এমন কোনো ব্যতিক্রম আছে যা প্রকারান্তে একটা মায়াজালের কিংবা মেঘলা আকাশের পিছনে আবছা নীল আকাসের মতো। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারে, যদি অন্তরের দৃষ্টি খুলে যায় তখন জীবিত অবস্থায় মৃত্যুকে দেখা যায়। এটা অনেক বড় স্তরের একটা ধ্যান কিংবা আরাধনা। যারা এটাকে লালন করতে পারেন, তারা স্বাভাবিক মানুষ নন। জীবনটা কিভাবে বাচবে সেটা আমাদের হাতে, আমরা জীবনটাকে দেখতে পাই, কিন্তু এটা কিভাবে দেখবো যে, মৃত্যু কখন আর কিভাবে আসবে? সেটা আজ অবধি কেউ বলতে পারে নাই।

অফিসে যাওয়ার সময় যে মানুষটার উপর নির্ভর করে আমার সকাল হতো, রাতে ঘুমানোর আগে যে মানুষগুলির উপর ভরষা করে আমার ভালো ঘুম হতো। কারনে অকারনে যখন তখন আমাদের মেজাজ কখনো ক্ষিপ্ত কিংবা বিক্ষিপ্ত অথবা উদবেলিত হতো, যখন সে আর কাছে থাকে না, তখন অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ে। অনেক মায়া লাগে। মনে হয়, সব কিছু থাকা সত্তেও যেনো কোনো কিছুই নাই। এই মায়া, এই ভরষা কিংবা এই বিক্ষিপ্ত চঞ্চলতার আর কোনো মুক্যই থাকে না সেই ব্যক্তির কাছে যে এই মাত্র সবার গোচরেই উধাও হয়ে গেলো চিরতরে। এই পরিবর্তনশীল সময়ে, অনেকেই হয়তো কথায় কথা বলে তারা ভালো আছেন, আমরা ভালো আছি কিন্তু তারা কিংবা আমরা জানিই না যে, আমাদের সময়টাই যে খারাপ যাচ্ছে। খুব মায়া হয় তখন। কিন্তু কেনো মায়া হয়, তার উত্তর আজো জানি না। যা হাতের মুঠোয় নাই, যা চিরতরে হারিয়ে যায়, অথচ একদিন হাতের কাছেই ছিলো, সেটার জন্য কেনো মায়া হয়, কেনো কষ্ট হয়, কেনো আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে হয়, তার ব্যাখ্যা নাই আমাদের কাছে। এর কিছু ব্যাখ্যা হয়তো দাড় করানো যায় যে, হয়তো পুরানো অভ্যাসে বন্দি মন বারবার আবার সেই পুরানো খাচায়ই ফিরে আসতে চায়।  অথবা এমনো হতে পারে যে, কেউ যখন আর কাছে থাকে না, তখন হয়তো এটা পরিষ্কার বুঝা যায় নিজের কতগুলি স্বকীয়তা, অভ্যাস আর পছন্দ কতো নিঃশব্দে সেই চলে যাওয়া মানুষটি নিয়ে অন্তর্ধান হয়ে গেলো, সাথে নিয়ে গেলো তার থেকে ধারে নিয়ে বেচে থাকার আমাদের অনেক পরনির্ভরশীলতার অভ্যাসগুলিও। আর সেটা যখন পরিষ্কার হয় তখন অভাবগুলির সংকট দেখা দেয়। আমরা বিচলিত হই, ভয় পাই, কষ্টে থাকি আর তখনই তার অভাবে আমরা তার উপর মায়ায় চোখ ভিজিয়ে দেই।

তবে আজীবন একটা সত্য বচন এই যে, জীবন মানেই যাত্রা, আর এই যাত্রার শেষ প্রান্তেই থাকে মৃত্যু। অর্থাৎ জীবনের অবসানেই মৃত্যুর যাত্রা শুরু। এই নতুন পর্বের যাত্রা কখন কার কোন সময় শুরু হবে, এটা কোনো বিজ্ঞান, কোনো ডাক্তার, কোনো ধর্ম পুস্তক কিংবা কোনো ধ্যান কখনোই বলতে পারে না।