২১/০৬/২০২৩- কোকোকে ছেড়ে দিতে হবে

অনেক শখ করে একটা জার্মান শেফার্ড এনেছিলাম। ওর বয়স যখন ৩ মাস, তখন থেকে কোকো আমার বাসায়। বাচ্চা বয়সে যা খেতে দিয়েছি, সেটাই খেয়েছে, বিশেষ করে নরম ভাত আর মুরগীর মাংশ। সাথে পেট ফুডস থাকতো, একটু দই দিলে মনে হতো অমৃত খাচ্ছে। নাক ডুবিয়ে খেতো।

মিটুলের কারনে বাসায় কোকোর প্রবেশ নিষেধ, তাই ওকে আমার মতো করে কোনো ট্রেনিংই  দিতে পারিনি। কেয়ারটেকার শাহনুরের কাছেই সারাক্ষন থাকে, ফলে আমার থেকে শাহনুরের প্রতিই ওর আনুগত্য বেশী। কিন্তু যখনই অফিসে যাই কিংবা অফিস থেকে আসি, উচ্ছল ঢেউয়ের মতো আমার গাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে করতে অপেক্ষা করে কখন আমি গাড়ি থেকে বের হবো। যেই না গাড়ি থেকে বের হয়েছি, মনে হয় ছোট বাচ্চার মতো আমার কোলে, পিঠে আছড়ে পড়ে। কি শার্ট পড়েছি, কি জামা পড়েছি সেটা তো ওর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, ওরা কাপড় নোংরা করে বটে কিন্তু আনুগত্যের চরম শিখরে ওদের ভালোবাসা। যারা কুকুর পালে না, তারা হয়তো বুঝবেই না কুকুরের আনুগত্য কি জিনিষ। কোকোকে খাওয়ানোর জন্য আমার কোনো বাজেট নাই। তারপরেও ওর পিছনে মাসে প্রায় হাজার দশেক খরচ তো পরেই।

তাহলে কোকোকে কেনো ছাড়তে হচ্ছে?

মাঝে মাঝে কোকো এখন সব খাবার খেতে চায় না, মাংশ দিলেও খেতে চায় না, মুরগী কিংবা গরুর গোস্ত যেনো তার এখন আর ভালো লাগে না। নরম ভাত, কিংবা পেট ফুডস। একেবারেই খেতে চায় না। আবার সব খাবার খায়ও না। ফলে আমার চিন্তা হয় প্রানীটাকে কোনো কষ্ট দিছি কিনা। ওরা কথা বলতে পারেনা, কিন্তু ক্ষুধার সময় অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে যেনো কি বলতে চায়। প্রচুর দৌড়াতে পারে, কিন্তু আমার সময় হয় না কোকোকে নিয়ে বের হবার। হয়তো এটাও একটা ব্যাপার ওর না খাওয়ার পিছনে।

ওর এই না খাওয়ার কারনে ইদানিং কোকো একটু কাহিল হয়ে গেছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। কোনো অসুবিধা পান নাই। তারপরেও কয়েকটা ভিটামিন দিয়েছে। খাইয়েছি। কিন্তু খুব একটা লাভ হয় নাই। খাবারের প্রতি ওর অরুচিটা রয়েই গেছে মনে হয়। তাই ওর অসুবিধার কথা চিন্তা করে আমার বন্ধু মহলে, ফেসবুকে একটা সংবাদ দিয়েছি যে, কোকোকে যারা নিজের হাতে আদর করে সময় দিয়ে ভালোভাবে রাখতে পারবে, আমি তাদেরকে দত্তক দিয়ে দেবো। অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছে, অনেকেই পারেনা আজই নিয়ে যায় এমন। কিন্তু আমি জানি জার্মান শেফার্ড পালা খুব সহজ কাজ না। তারপরেও হয়তো অনেকে পালতেও পারেন। যাকেই দেবো, তার বাড়িঘর, আর্থিক সামর্থ দেখেই আমি কোকোকে দত্তক দেবো এটা সিউর। আর যদি দেখি, ওর আরো কষ্ট হবে, তাহলে হয়তো দেবোই না। অন্তত আমি তো ওকে কিছুটা হলেও সময় দিতে পারবো।

আমি কিংবা মিটুল যখন আমাদের ঘরে ক্যাচিগেট খুলি আর যদি কোকো গ্যারেজে ছাড়া থাকে, দুই লাফে গ্যারেজ থেকে আমাদের ঘরের দরজার সামনে এসে হাজির। কিংবা কাউকে আমি বা মিটুল নাম ধরে জোরে ডাকতে গেলে কোকো আমাদের কণ্ঠস্বর চিনে, যদি ছাড়া থাকে এসে যাবে, আর যদি ওর ঘরে বন্দি থাকে, উচ্চস্বরে ডাকাডাকি শুরু করবে।

আমি জানি যদি কোকোকে দিয়েই দিতে হয়, কোকো হয়তো অন্য মালিকের অধীনে গিয়ে আমাদের মিস করবে। হয়তো খুজবে আমাকে সেই হাচির মতো যে কিনা তার মনিবের জন্য গোটা ১০ বছর জাপানের সেই রেলওয়ের প্লাটফর্মে অপেক্ষা করেছে কখন তার মনিব আবার ফিরে আসবে। অবশেষে হাচি ১০ বছর পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। জাপান সরকার সেই হাচির স্মরণে তাকে সম্মান জানিয়ে সেই প্লাটফর্মেই একটা মনুমেন্ট তৈরী করেছে। হাচি নাই, কিন্তু আছে সবার মাঝে। এটাই কুকুর ভক্তি।

আমি নিশ্চিত দিয়ে বলতে পারি, একদিন কোকো নিজেও আমাকে মিস করবে। আমি তো মিস করবোই। এখন যে স্ত্রী কোকোকে রাখতে দিলো না, এক সময় হয়তো সেইই কোকোর মতো একটা জারমান শেফার্ড থাকলে হয়তো ভালো হতো এর অভাব সে বুঝবে।

পরিবারে আমি অশান্তি চাই না, তাই কোকোকে ছেড়ে দিলাম। বা দিচ্ছি।

কোকো ভালো থাকুক আমি চাই, কিন্তু সে কতটা ভালো থাকবে সেটা আমি জানি না। কোকো আমার বাগান মিস করবে, কোকো তার ঘর মিস করবে, কোকো তার পরিচিত পরিবেশ মিস করবে। কোকো শাহ্নুরকে মিস করবে।

কোকো হয়তো জানেই না যে, তাকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি। একটা সন্তান ছেড়ে দেয়ার মতো একটা কষ্ট।