২১/০৮/২০২০-মুহুর্ত-চেইন

Categories

চারিদিকে শুধু খারাপ সংবাদ পাই। একদিকে করোনা মহামারী, অন্যদিকে সারাদেশ বন্যায় কবলিত, আবার এরই মধ্যে মেজর সিনহার পুলিশের গুলিতে নিহত হবার ঘটনায় পুরু দেশ উত্তাল। ব্যবসা বানিজ্য অনেকটাই স্থবির না হলেও বেশ জটিল। আমাদের অবস্থাটা ততোটা খারাপ নয়। ফ্যাক্টরী চলছে আগের মতোই, অফিসে যাচ্ছি প্রতিদিন, মহামারী আর বন্যা এই মুহুর্তে কোনোটাই খুব বেশী প্রভাব ফেলে নাই আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে।

আজ শুক্রবার, অফিসে যাই নাই। বন্ধের দিন। একটু আগে মোস্তাক ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে জান্নাহ আমেরিকা থেকে হটাত ফোন করে জানালো যে, ওর হাজবেন্ড ওকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে এবং সে ওখানে একেবারেই নিরাপদ নয়। ওর হাজবেন্ড নাকি ওর মুখে তোয়ালে ঢুকিয়ে ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিলো। ওর ফোন কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ওর ছোট মেয়ে এলিনা ভয়ে কান্নাকাটি করছিলো। ডিজিটাল যুগ, ফোন কেড়ে নিয়ে গেলেও রাকীব (জান্নাহর হাজবেন্ড) বুঝতে পারে নাই যে, ফোন ছাড়াও অন্যান্য ডিভাইস যেমন ল্যাপটপ বা এপ্স (হোয়াটস আপ, ভাইবার, ফেসবুক) ইত্যাদি দিয়েও সারা দুনিয়ায় কথা বলা যায়। ফলে অতিদ্রুত জান্নাহ আমাদের বাসায় ব্যাপারটা জানিয়ে দিলো ভাইবারে কল দিয়ে। আর আমরা জেনে গেলাম। ইনফর্মেশন এতো দ্রুত ট্রাভেল করে যে, আজকাল আর ডিস্ট্যান্স কোনো ব্যাপার নয়। আমরা সাথে সাথে প্রথমে জান্নাহর বাবা মোস্তাক ভাই, পরে তার ছেলে ফয়সালকে জানানোর পরেই লোকাল পুলিশ জান্নাহর বাসায় ১০ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। রাকীবকে এরেস্ট করা হয়েছে। আমেরিকা- বাংলাদেশ, আবার বাংলাদেশ-আমেরিকা, একটা ঘটনা, প্রশান চলে এলো মাত্র ১০ মিনিটে। এটাই দুনিয়া। 

রাকীবের সাথে জান্নাহর বেশ কিছুদিন যাবত দাম্পত্য জীবন নিয়ে বনিবনা হচ্ছিলো না। আমি প্রথমে রাকীবকে সাপোর্ট করলেও পরবর্তীতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, সমস্যাটা জান্নাহর সাথে নয়, সমস্যাটা রাকীবের। রাকীব অত্যান্ত হিংস্র একজন মানুষ, কিন্তু কথা বলতে পারে বেশ গুছিয়ে। ছেলেটা ডক্টরেট করেছে বটে কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতায় কচি কচুর মতো। প্রায় এক বছর আলাদা থাকার পর জান্নাহই ফিরে গিয়েছিলো রাকীবের বাসায় কিন্তু রাকীব দিতীয় বারের মতো জান্নাহকে তার সংগীনি হিসাবে গ্রহন করতে পারে নাই। এটা রাকীবের ব্যর্থতা।

আসলে আজকে আমার ডায়েরীটা জান্নাহ বা রাকীবকে নিয়ে নয়। ঘটনাটা ঘটে গেলো কিছুক্ষন আগে, তাই হয়তো লিখলাম। আমার আজকের প্রেক্ষাপট ছিলো, আমাদের জীবনের পথ চলার কাহিনী নিয়ে। “সময়ের লম্বা পথ” ধরে যখন আমরা হাটি, এই পথের প্রতিটি মুহুর্তই আসলে একে অন্যের সাথে কোনো সামঞ্জ্যস্য থাকে না। একটা মুহুর্ত আরেকটা মুহুর্তের সাথে চেইনের মতো বাধা থাকে বটে কিন্তু প্রতিটি মুহুর্ত-চেইন তার আলাদা বৈশিষ্টে ভরপুর। কিন্তু একটা জায়গায় এরা সবার মিল। প্রতিটি মুহুর্ত-চেইন যেখান থেকে সৃষ্টি হয়, পুনরায় সেই বিন্দুতে ফিরে না আসা পর্যন্ত এরা কেহই একটা পূর্নাজ্ঞ বৃত্ত তৈরী করে না বা করতে পারে না। জীবনের বেলায়ও তাই। এই মুহুর্ত-চেইন গুলিতে কখনো কেউ বিউটি কুইন আবার কখনো সেইই হয়ে যায় কিচেন কুইন। কখনো মনে হয় অতি সুবাসিত গোলাপ, আবার পরক্ষনেই মনে হবে গোলাপ নয়, এটা গোলাপের বিষাক্ত কাটা। কখনো কখনো এই মুহুর্ত-চেইগুলিকে জোরা লাগাতে গিয়ে জোড়ার বদলে জট লেগে যায়। ফলে আসচর্য হবার থেকে এই মুহুর্ত-চেইনগুলিকে মনে হয় অসম্ভব জটিল যার একদিকে যেমন মনে হয় খাদ, অন্যদিকে মনে হয় পুরুটাই ফাদ।

যখন জীবন শুরু হয়, একটা অসহায় প্রানী হয়ে এমনভাবে জন্ম নেয় যে, তাকে কেউ না খাইয়ে দিলে খেতে পারে না, কেউ তাকে পরিষ্কার না করিয়ে দিলে সে পরিষ্কার হতে পারে না, কেউ তাকে লালন পালন না করলে তার বড় হয়ে উঠা সম্ভব হয় না। শুধু তাইই নয়, জীবনের যে সময়টায় মানুষ পরিপূর্নতা লাভ করে বলে ভাবে, আসলে সেটাও তার আসল পরিপুর্নতা নয়, প্রতিটা মুহুর্ত-চেইন পরিপুর্নতার জন্য দায়ী। এই পরিপুর্নতার মধ্যে যে সব উপাদান থাকে তা কখনো শিশুকাল, কখনো কিশোরকাল, কখনো যৌবনকাল, কখনো প্রোউরকাল, ইত্যাদি। প্রতিটা মুহুর্ত-চেইন যখন তার শেষ ক্রান্তিলগ্নে এসে সেই লগ্ন বা পর্ব পেরিয়ে যায়, তখন সে একটা উপাদান হারিয়ে ফেলে কিন্ত তার ইনভেন্টরীতে এসে জমা হয় আরেকটা উপাদান। শিশুকাল ঝরে গিয়ে কিশোরকাল, কিশোরকাল ঝরে গিয়ে যৌবনকাল আর যৌবনকাল ঝরে গিয়ে আসে তার পরেরকাল। কিন্তু এই বৃত্তটা চলমান থেকে যায় আর বৃদ্ধি হতে থাকে। আর সামনে এগিয়ে যায় হারিয়ে যাওয়া উপাদানের অভিজ্ঞতা আর আস্বাদন নিয়ে। একে একে যখন সবগুলি উপাদান বিলুপ্ত হতে থাকে, তখন ব্রিত্তের আর্ক আরো বড় হয়, এগিয়ে যায় সেইস্থানে যেখান থেকে বৃত্তের প্রথম উৎপত্তি। যখন বৃত্তটা প্রায় সম্পন্ন হতে শুরু করে তখন দেখা যাবে সেই ৯০ বছরের মানুষটি পুনরায় একই আচরন করে যখন তার বয়স ছিলো মাত্র শিশু। ৯০/১০০ বছরের কোনো মানুষ আর ছোট কোনো বাচ্চার মধ্যে খুব একটা তফাত চোখে পড়ে না, একটা বিষয় ছাড়া- আর সেটা হল “অভিজ্ঞতা"। ছোট বাচ্চার কাছে “অভিজ্ঞতা” ছিলো না কিন্তু শত বছরের বাচ্চা মানুষটির ঝুলিতে ভরপুর “অভিজ্ঞতা”। সেই শত বছরের মানুষটিও কারো সাহাজ্য ছাড়া খেতে পারে না, কারো সাহাজ্য ছাড়া পরিষ্কার হতে পারে না, কেউ তাকে লালন না করলে তার চলাও হয়ে উঠে না। যেদিন বৃত্তটা পুরু হয়ে যায়, সেদিন তিনি আর আমাদের মাঝে নাই। আর এটাই জীবন। বৃত্তটা এ রকম যে, কোনো মাইল ফলকের এপিঠ আর অপিঠ যার একদিকে “শুন্য” বা “শুরু” লেখা অন্য পিঠে “শেষ” লেখা। অথচ পয়েন্টটা একটাই।

অর্থাৎ পয়েন্ট “এ” এর একপিঠে যদি পয়েন্ট “বি” পর্যন্ত যেতে লেখা থাকে “এক্স” কিলোমিটার তাহলে “বি” থেকে “এ” পর্যন্ত আসতে পয়েন্ট “এ” এর অন্য পিঠে লেখা হবে “শুন্য” কিলোমিটার। এটা সেই স্টার্টিং পয়েন্ট যা বৃত্ত সম্পন্ন করার নিমিত্তে ফিনিসিং পয়েন্টও বটে। আর এই পুরু ব্রিত্ততাই আমাদের লাইফ। যারা এই বৃত্তের বাইরে ছিটকে পড়ে যান, তাদের বেলায় আমরা বলি দূর্ঘটনা।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *