২১/০৯/২০২৩-আমেরিকার ন্যাশনাল ডেট বা ঋণ

ইদানিং আন্তর্জাতিক খবরগুলির মধ্যে প্রায়ই একটা খবর চাউর হচ্ছে যে, আমেরিকার জাতীয় লোন প্রায় ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার এবং এর অর্থনীতিতে এটা একটা আশনী সংকেত।

এর মানে কি? কার কাছে কিংবা কিভাবে এই লোন করলো আমেরিকা এবং এর প্রভাব কি?যে কোনো জাতীয় লোন বলতে বুঝায় যে, কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকার যখন তাঁর খরচ পোষানোর জন্য আহরীত রেভিনিউর পর ঘাটতি অর্থ অন্য কারো কাছ থেকে লোন নেয় সেটা। অর্থাৎ খরচের বাজেট যখন আহরীত রেভিনিউয়ের থেকে বেশী হয়, তখন উক্ত ঘাটতি মেটাতে সরকারকে কোথাও না কোথাও থেকে লোন নিতে হয়। সেটাই আসলে জাতীয় ঋণ নামে অভিহিত হয়।সরকার তাহলে কার কাছ থেকে এই লোনগুলি নেয়? ব্যাপারটা খুব জটিল নয়।একটা দেশে কি পরিমান মুদ্রা বা কারেন্সী ছাপানো হবে সেটা নির্ভর করে তাঁর গোল্ড রিজার্ভের উপর। গোল্ডের বিপরীতে আসল কারেন্সী ছাপিয়েও সরকার অতিরিক্ত কিছু কাগজী নোট যেমন প্রাইজবন্ড, কিংবা মার্কেটেবল সিকিউরিটিজ বন্ড, ট্রেজারীবন্ড, বিলস, ফ্লোটিং রেট নোট, ট্রেজারী ইনফ্লেশন প্রোটেক্টেড সিকিউরিটিজ ইত্যাদি ছাপায়। আর এগুলির একটা ভ্যালু নির্ধারন করে দিয়ে তা জনগনের কাছে ছেড়ে দেয়। এটা টাকা না, কিন্তু আবার টাকাও। প্রাইজবন্ড দিয়ে বাজারে গিয়ে আমি আপনি চাল ডাল কিনতে পারবো না যদিও সেটার একটা কারেন্সী ভ্যালু আছে। এই প্রাইজবন্ড, ট্রেজারী বন্ড কিংবা সিকিউরিটিজ বন্ড ইত্যাদি গোল্ডের বিপরীতে ছাপাতে হয়না। তাই এটা কারেন্সী হিসাবে কাজ করেনা। এটা দিয়ে সরকার গোল্ডবিহীন জামানত ছাড়া একটা আলাদা পরিমান মুদ্রা সরবরাহ করে মাত্র যাতে জনগন কিনে জাতীয় আসল কারেন্সী সরকারকে দিয়ে দেয়। সরকার আসলে বুদ্ধি করে এর মাধ্যমে আসল কারেন্সী বাজার থেকে তুলে নেয়, নিজে বিভিন্ন কাজে লাগায়। জনগন লাভ পায় এর উপরে। এই কাগুজী নোটগুলি সরকার কর্তৃক গ্যারান্টেড। যেহেতু আসল কারেন্সী না কিন্তু গ্যারান্টেড, ফলে জানগনের কাছে সরকার এই সমপরিমান কাগুজী নোটের পরিমানে ঋণী হয়। এই ঋণ জনগনকে আসল কারেন্সী দিয়েই পেমেন্ট করতে হয় পরবর্তীতেআরেকটু সহজ করে বলি। এটা অনেকটা ব্যাংক থেকে ক্রেডিটকার্ড, মর্টগেজ কিংবা গাড়ীবাড়ি লোনের মতো। একটি পন্য আপনি কিনলেন, সেটার মুল্য আপনি শোধ করলেন ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিংবা আপনি একটি কিছু মর্টগেজ রাখলেন, টাকা নিলেন কিন্তু পুরু টাকাটা আপনি পেমেন্ট করলেন না ব্যাংকে, মাস শেষে বা বছর শেষে আপনার নামে সুদসহ ঋণ হবে।

এটা গেলো একটা পদ্ধতি লোন নেবার। আরেকটা হলো সরকার অন্য দেশ থেকেও লং টার্ম সুদে লোন নেয়। সবই সরকারকে একটা মেয়াদে এসে লোন ব্যাক করার কথা।

যাই হোক যেটা বলছিলাম, রেভিনিউ যতো কম আসবে, সরকারকে তাঁর বিভিন্ন খরচ, যেমন আমদানী, ডেভেলপমেন্ট খরচ, মেডিক্যাল, ডিফেন্স, পাবলিক সার্ভিস, ভর্তুকী ইত্যাদি মেটাতে ঋণ নিতে হয়। আর এই ঋণ দিনে দিনে বাড়তেই থাকে যদি প্রত্যাশিত রেভিনিউ সংগ্রহ না হয়।

এবার আসি আমেরিকার বেলায়। আমেরিকা সেই ১৭৯১ সাল থেকেই ঋণের বোঝা টেনে চলছে। প্রথমে ছিলো এর পরিমান ৭৫ মিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে প্রায় আজ অবধি ৪০০০% বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এর পরিমান দাড়িয়েছে ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার।

একটি সরকার কত পরিমান লোন নিতে পারবে এটার একটা লিমিট করে দেয়া থাকে পার্লামেন্ট থেকে। একটা উদাহরন দেই, আবার সেই ক্রেডিট কার্ড। ধরুন আপনি একটা ক্রেডিট কার্ড নিলেন, আপনার লিমিট ৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ আপনি সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকার বাইরে খরচ করতে পারবেন না। এই লিমিটটা ব্যাংক করে দেয়। যতোক্ষন আপনি এই লিমিট থেকে কোনো খরচ করবেন না, ততোক্ষন আপনি ঋণীও নন। কিন্তু ধরুন আপনি যদি ২ লাখ টাকা খরচ করেন আর ন্যনতম বিল হিসাবে ১ লাখ টাকা শোধ করেন, তাহলে আপনার লিমিট থাকবে আর মাত্র ৪ লাখ টাকা। কারন ইতিমধ্যে আপনি ১ লাখ টাকা ঋণে আছেন আর ভবিষ্যতে আরো ৪ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। মোট ৫ লাখ। এভাবে যদি আপনি খরচ বাড়াতে থাকেন আর পুরু বিল শোধ না করেন, একসময় এসে আপনার ৫ লাখ টাকার লিমিট প্রায় শেষ হয়ে যাবে। আমি আপনি ইচ্ছে করলেই সেই লিমিটের বাইরে আর খরচ করতে পারবন না। যদি আবার পুরু টাকাটা আবার সুদসমেত দিয়ে দেন, আবারো আপনার লিমিট ৫ লাখই হয়ে যাবে। আপনি আপনার অব্যবহৃত লিমিট আবার ব্যবহার করতে পারবেন। যদি শোধ না করেন, একসময় এসে আপনি ঋণ খেলাপি হয়ে যাবেন।

আবার ঋণ খেলাপি হবেন না বা আপনি এই ৫ লাখ টাকার বেশিও খরচ করতে পারবেন যদি ব্যাংক আপনার এই ৫ লাখ টাকার লিমিট বাড়িয়ে ১০ লাখ করে দেয়। তখন হয়তো দেখা যাবে যে, আপনার লোন আছে ৫ লাখ আর অব্যবহৃত লিমিট আছে আরো ৫ লাখ। এভাবে যদি আবারো আপনি শুধু খরচ করতেই থাকেন, আবারো আপনার এই নতুন লিমিট ১০ লাখ শেষ হয়ে যাবে। আপনি ইচ্ছে করলেও আর কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন না এবং আপনাকে সুদসহ ১০ লাখ ফেরত দিতেই হবে ব্যাংককে।এখানে পার্লামেন্ট হচ্ছে ব্যাংক, ট্রেজারী ডিভিশন (যিনি খরচ করেন) হচ্ছে আমি, কার্ড হচ্ছে লোনের পরিমান। আমেরিকার এই লিমিট ছিলো ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার যা গত কয়েক মাস আগে তাদের পার্লামেন্ট সেটা বাড়িয়ে ৩৩ ট্রিলিয়নে উত্তীর্ন করেছিলো। এটাও এখন শেষ। এখন আবার পার্লামেন্ট এই লিমিট যদি বাড়িয়ে দেয়, তাহলে ট্রেজারী ডিভিশন আবারো তাঁর পলিসি মোতাবেক বিভিন্ন নোটস, বন্ডের মাধ্যমে জনগন তথা বিদেশীদের কাছে ছেড়ে দিয়ে আবারো টাকা /ডলার সরবরাহ বাড়াতে পারবে। কিন্তু আবারো ঋণ আরো বেড়ে যাবে।

আমেরিকা এসব ট্রেজারী নোটস, মার্কেটেবল সিকিউরিটিজ বন্ড, ট্রেজারীবন্ড, বিলস, ফ্লোটিং রেট নোট, ট্রেজারী ইনফ্লেশন প্রোটেক্টেড সিকিউরিটিজ ইত্যাদি বিক্রি করে জাপান, চীন, ইউকে, বেলজিয়াম এবং লুক্সেম্বার্গ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছে। জাপানের কাছে ১.১ ট্রিলিয়ন ট্রেজারীবন্ড আছে, চীনের কাছে আছে ৯০০ বিলিয়ন সমপরিমান ডলারের, ইউকের কাছে ৭০০ বিলিয়ন, লুক্সেম্বার্গে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমান ট্রেজারী নোট রয়েছে। এসব এক সময় না এক সময় ডলারেই পে করতে হবে সুদসমেত। আর এগুলি গ্যারান্টেড। বাকী লোনগুলি হচ্ছে ইন্ট্রা-গভর্মেন্টাল সংস্থা যেমন ব্যাংক, ইনভেষ্টরস, লোকাল সরকার, মিউচুয়াল ফান্ড, পেনশন ফান্ডস, ইন্সুরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি থেকে।

আজকে এই মুহুর্তে যদি চীন, ইউকে, জাপান, লুক্সেম্বার্গ, বেলজিয়াম, ইন্ট্রা-গভর্মেন্টাল সংস্থা তাদের বন্ডসমুহ ছেড়ে দিয়ে ক্যাশ ডলার নিয়ে নিতে চায়, তাহলে আমেরিকাকে অবশ্যই তা ক্যাশ ডলারে লাভসহ পেমেন্ট করতে হবে। আর যদি সেটা ঘটে তাহলে আমেরিকার অর্থনীতি খাড়া নীচের দিকে ধাবিত হবে।

এখন এখানে একটা বড় ধরনের প্রশ্ন জাগে, চীন, জাপান কিংবা অন্য দেশগুলি কেনো আমেরিকান সিকিউরিটিজ কিনে? এর কারন হলো, ডলার ডমিনেটেড সিউকিউরিটিজ কিনলে চীনের বা যারা কিনে তাদের দেশী মুদ্রার মানের চেয়ে ডলারের দাম বেড়ে যায়। তাতে চায়নীজ কিংবা যারা কিনে তাদের প্রোডাক্টের দাম কমে আসে এবং আমেরিকায় তাদের প্রোডাক্ট আকর্ষনীয় হয়। বিক্রি বাড়ে এবং চায়নার বা যারা কিনেছে তাদের অর্থনীতি আরো চাংগা হয়।