হালিশহর মেস, বুধবার, সময়-১৯২৫ ঘন্টা।
আর্টিলারি সেন্টার এন্ড স্কুল, হালিশহর। …
আমি দাড়িয়েছিলাম কিছুক্ষন বারান্দায়। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো তখন। তিনতলা থেকে অনেকদূর পর্যন্ত শহরের আলো দেখা যাচ্ছিলো। বেশ দূর থেকে চট্টগ্রাম শহর থেকে ট্রেনের হুইশেলের আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো। আর্টিলারি মেস হালিশহর, প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার দুরে। তারপরেও এখান থেকেই যেনো বুঝতে পারছিলাম ট্রেন প্রায় ছাড়বে ছাড়বে। লোকজন নিশ্চয় খুব ব্যস্ত এখন, কেউ প্লাটফর্মে, কেউ কামড়ার ভিতরে। কেউ হয়ত তার প্রিয়জনকে বিদায় দিতে এসে চোখের জল মুছছে, আবার কেউ হয়ত এই শহর ছেড়ে যেতে পারলেই বাচি বলে চোখ বুজে আছে। দুনিয়া বড় আজব।
আমাদের আর্টিলারি সেন্টার এন্ড স্কুলের রাস্তা দিয়ে দুয়েকটি প্রাইভেট কার চলাফেরা করছে। আমি বারান্দায় একা, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি, আর সিগারেট টানছি। মশারা আমাকে একা পেয়ে বেশ খাবলে খাবলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। বিরক্ত হচ্ছি না। আমার মৃত্যুর কথা মনে পরলো।
এটাই মনে হলো যে, এখন যা চলছে, এইসব কিছুই তখনো চলবে। দিনের শেষে অন্ধকার হয়ে যাবে, লোকজন যার যার ঘরে ফিরে আসবে। নিত্য নৈমিত্তিকের মতো খাওয়া দাওয়া করবে, টিভি, সিনেমা সবই চলবে, গল্প করবে, হাসি তামাশা, কিংবা পাখিদের কিচির মিচির, সকালের সূর্য উঠা কিংবা এই একটু আগে যেভাবে সূর্য ডোবে গিয়ে এখন একটা ভুতুরে সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছে এই রকম করে আবারো ভুতুরে এক সন্ধ্যা তখনো নামবে। এই যে আমি আজ যেখানে দাড়িয়েছিলাম ঠিক এই জায়গাটাতে হয়ত এমনি করেই আরো একজন দাঁড়িয়ে হয়তো আমার মতোই ভাববে। কেইবা জানে, এখন থেকে অতিতে কোনো একসময় আরো একজন কেউ এমন করে ভেবেছিলো কিনা। হয়তো বা কোনোটাই সত্য নয়।
আমার আরো অনেক কিছু ভাবনা, অনেক কিছু কথা মনে আসছিলো। এই আমার মা, আমার বোন, আমার ভাই, আমার বউ, আমার মেয়ে, আমাদের নসিরন, তার সাথে বদিভাই, শিমুল, মোস্তাক ইত্যাদির মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? কেউ কারো কাছে কোনো কিছুর জন্যই বাধ্য নয়। ছোট বড় সবার জন্য এক পলিসি, তারপরেও নিজেদের টানে, নিজেদের স্বার্থের কারনে একে অপরের কাছে চলে আসে। আবার কোন এক অস্থিরতার মধ্যেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। আর এর মাঝেই মানুসজন নিজেদের কারনেই কিছু কিছু কমন নিয়ম কানুন মেনে চলে। সেগুলো নিতান্তই নিজেদের স্বার্থেই।
আজ থেকে হাজার বছর পূর্বের আমার পূর্ব পুরুসের নাম আমি যেমন জানি না, আমার প্রয়োজন নেই তাদের নাম জানার। তারা আমার জীবনে কোনো কাজে আসবেন না, আর এজন্যই আমি তাদের খোজ করি না, নাম জানি না, জানার প্রয়োজন বোধ করিনা। তাহলে আজ থেকে পরের হাজার বছর পরেও কেনো আমার বংশধরেরা আমাকে খোজে বের করবে? কোন যুক্তি আছে? নাই।
অংক একটাই। কবরের পাশে নিজের নাম খোদাই করা থাকলেও তাদের প্রয়োজনেই ওই নাম প্রতিস্থাপক হয়ে আরো নতুন নাম সেখানেই ঢোকবেই। আর একেই বলে রিপ্লেস্মেন্ট। অতএব কোথাও তোমার পদধ্বনি থাকবে বলে আশা করো না। এই পৃথিবী বর্তমানের অধীশ্বর। আমার বলতে কিছু নাই। তোমার বলতেও কিছু নাই।
-হতাত কার হাতের স্পর্শে যেনো সম্বিত ফিরে পেলাম। ঘাড় নেড়ে দেখি, আমার দোস্ত মেজর আকবর। আমরা একসাথে গানারী স্টাফ কোর্স করতে এসেছি। আকবর ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র আর আমি মির্জাপুর ক্যাডে কলেজের। আকবরের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় শহিদুল্লাহ হলের ক্যাম্পাসে।