২২/০৯/১৯৯১-রাংগামাটিতে গমন

Categories

ছবির বামে ক্যাঃ জামাল, পরের জন ক্যাঃ মাহফুজ, ক্যাঃ ডাক্তার এবং আমি। মারিষ্যা জোনে এসেই রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা ২১ রাইফেল ব্যাটালিয়ানের অফিসার মেসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমার হাতে একটা ওয়ান ব্যান্ডের রেডিও। বিডি আর এর সাথে সনযুক্ত থাকবো আমি প্রায় ৬ মাসের অধিক। মানসিকভাবে তৈরী হয়েই এসেছিলাম ফলে এক প্রকার আনন্দেই ছিলাম যে, ইউনিটের কোনো প্যারা নাই, ক্যাম্পে শান্তি বাহিনীর শান্তি ভাংগা ছাড়া আর কোনো অশ্যান্তি হয়তো নাই।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই রেডি হলাম। ২১ রাইফেল ব্যটালিয়ানের কোত থেকে একটা এস এম জি (সাব মেশিন গান) আমার নামে বরাদ্ধ করা হলো। এটা বিডিআর এর সাথে সংযুক্তি থাকা অবস্থায় আমার জিম্মায় থাকবে। সাথে এক বান্ডেল পোচ এমুনিশন। রাংগামাটিতে যেতে হলে একটা সিংগেল গাড়ি যাওয়ার নিয়ম নাই কারন এলাকাটা ঝুকিপুর্ন। তাই অন্তত দুটু গাড়ির একটি বহর নিয়ে যেতে হয়। সপ্তাহে দুইদিন ওই ঝুকিপুর্ন এলাকায় রুট প্রোটেকশনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর লোকজন চলাচল করে। এই রুট প্রোটেকশনের ব্যাপারটা আমার আগে জানা ছিলো না। রুট প্রোটেক্সন হচ্ছে, যখন কোনো কনভয় হিলে ঝুকিপুর্ন জায়গায় যায় বা আসে, তখন রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় আর্মি, বিডিআর এবং আনসার সম্বলিত প্রায় তিনজন করে একেকটা পয়েন্টে কিছু ভিজিবল রাস্তা বা একটা দায়িত্তপুর্ন এলাকা প্রোটেকশন দেয়া, যাতে শান্তিবাহিনী কোনো অপারেশন করলে দ্রুততম সময় এই বাড়তি লোকজন সামাল দিতে পারে অথবা দায়িত্তপুর্ন এলাকাটি নিরাপদ আছে সেটা নিশ্চিত করা।

রাংগামাটি যেতে রাংগামাটি আর চিটাগাং এর মাঝামাঝি একটা জায়গা আছে যার নাম, আমতলি। এখানে সবাই নেমে আর্মস লোড করে, একটা ব্রিফিং হয় এবং এই আমতলী থেকেই ঝুকিপুর্ন এলাকা বলে এয়ারমার্ক করা। আমতলি পর্যন্ত হিল আসলে বুঝা যায় না। প্রায় সমতলের মতো। এখান থেকেই বড় বড় পাহারের উতপত্তি। আমরা সবাই আর্মস লোড করে নিলাম। পিকআপ গাড়িতে একটা এলএমজি (লং মেশিন গান) ফিট করা, আর পিকআপের দুই ধারে সৈনিকরা এমনভাবে বসে, যাতে সবাই বাইরের দিকে তাদের আর্মস তাক করা থাকতে পারে। আকাবাকা রাস্তা। দুইধারে বিশাল বিশাল পাহাড়। কখনো গাড়ি নীচে নামছে, কখনো গাড়ী আবার পাহাড়ের কোল ঘেষে একেবারে চুড়ায় উঠে যাচ্ছে। ঈশ্বর তার সৃষ্টি এমন করে চোখের আড়ালে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন, দেখলেই মন ভরে যায়। কখনো কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দুরের আকাশ দেখা যায়। একটু ভয়ও লাগে। আবার এই ভয়কে উপচিয়ে প্রকৃতির সউন্দর্য এমনভাবে মনকে পুলকিত করে যা আমার হৃদয়ে কি যেনো পরম অনুভুতি জাগিয়ে দেয়। আমি ভয়বিসন্ন অন্তর নিয়ে একট মিশ্রিত ভালো লাগার অনুভুতিতে পুরু রাস্তাটা পার করলাম। যেহেতু শান্তিবাহিনী কখনো চোখে দেখি নাই, তাদের তান্ডবলীলাও আমার জানা নাই ফলে শান্তিবাহিনীর ধংসাত্তক কার্যকলাপের চিহ্ন আমার মনের মধ্যে ভেসে উঠে নাই বরং বর্তমান সময়ে প্রকৃতির রুপটাই আমাকে বেশী বিমোহিত করেছিল। কখনো কখনো মনে হয়েছিলো, একবার গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের এই অদ্ভুদ রুপকে প্রানভরে দেখি, কিন্তু রুট প্রোটেকশনের নীতিমালা অনুযায়ী এটা করার কোনো নিয়ম না থাকায় দ্রুত গতিতেই একটার পর একটা দৃশ্য যেনো সিনেমার পর্দার মতো চোখের পলকে হারিয়ে যাচ্ছে।

দূরে কোথাও মেঘের ভেলা দেখা যাচ্ছে, আবার পরক্ষনেই সেই মেঘের ভেলা যেনো একেবারে আমাদের গাড়ির নিকটবর্তী হয়ে একটা উড়ন্ত বকের ঝাকের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। পাহাড়ের আকৃতির কারনে রাস্তাগুলিও একবার উত্তর থেকে দক্ষিনে, আবার কখনো কখনো পুর্ব থেকে পশ্চিমে লম্বা সারি হয়ে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো সূর্য ঠিক মাথার উপর, আবার কখনো সূর্য আমাদের পিছনে চলে যাচ্ছে। দূর পাহাড়ের কোল ঘেষে ঝর্না দেখা যায়, ভারতের পাহাড়গুলি আর আমাদের দেশের পাহাড়্গুলির মধ্যে একটা যোগসুত্র আছে। এদেশের পাহাড় যেখানে শেষ, হয়তো ভারতের পাহাড়গুলি সেখানেই শুরু। এই পাহাড়দের মধ্যে কোনো আঞ্চলিক বিরোধ নাই। তাদের একটা দেহের কিছু অংশ এদেশে থাকলেই কি আর ভারতে থাকলেই কি, এরা একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যারা টেরিটরিয়াল বাউন্ডারি করে এদের পরিচয়ে বাধা দিয়ে বলি এটা আমাদের আর ওটা ওদের, তাদের এই পাহাড়দের কিছুই যায় আসে না। কোনো পাহাড় টেরিটরিয়াল আইন মানে না। তারা অনবরত একটা অবিচ্ছেদ্য অংশই হয়ে থাকে আজীবন।

প্রায় দুই ঘন্টা হাইস্পীডে গাড়ি চালিয়ে শেষ অবধি আমরা পাহাড়ের চুড়া থেকে নেমে রাংগামাটির প্লেন ল্যান্ডে চলে এলাম। এই রাংগামাটি শহরটা কি কখনো আগে পাহাড়ের মতো ছিলো কিনা আমি জানি না, কিন্তু দেখলে বুঝা যায় যে, এরাও তাদের পুর্বসত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে মানুষের ক্ষুরধার কোনো বুল্ডজার বা সাবলের আঘাতে। এখন সে একটা সমতল ভুমি। অনেক পিচঢালা রাস্তা, বিল্ডিং এ ছড়াছড়ি। অনেক নিয়ন লাইট আর হরেক রকমের বিজ্ঞাপনে ভর্তি এই শহর। মানুষের মধ্যে কোনো আতংক নাই, কেউ বাজার করছে, বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, কেউ আবার স্কুল থেকে ফিরে যাচ্ছে। দোকানীরা তাদের পন্য বেচাকেনায় মগ্ন। আশেপাশে কয়েকটা বিডিআর কিংবা আর্মির গাড়ি অলসভাবে টহল দিচ্ছে। আমরা রাংগামাটির বুকে এখন। প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। আমরা বিডিআর রেষ্ট হাউজে চলে এলাম। ভীষন সুন্দর একটা রেষ্ট হাউজ। ক্যাপ্টেন আখতার (১১ লং কোর্ষের), তিনি আমাদের রিসিভ করলেন। বিডিআর রেষ্ট হাউজটা একটা লেকের পাশে, আবার লেকের ঠিক পরেই পাহাড়। রেলিং দেয়া চারিদিকে। রেলিং এ দাড়ালে মনে হয় পানির উপরে দাঁড়িয়ে আছি। অদ্ভুদ সুন্দর রেষ্ট হাউজটা। আমরা খাবারের জন্য তৈরী হলাম। আগে থেকেই সম্ভবত আমাদের খাবারের কথা বলা হয়েছিলো। খেতে গিয়ে দেখলাম, বড় বর মাছের খন্ড। জিজ্ঞেস করতেই মেস ওয়েটার জানালো যে, এই মাছ কাপ্তাই লেকের থেকে আনা। এখানে জ্যান্ত মাছ পাওয়া যায় আর সেটা বেশ সস্তাই। অনেক ক্ষুধা লেগেছিলো। ভয়ের একটা গুন আছে। পেটে যতোই ক্ষুধা থাকুক, ভয় যখন ভর করে তখন পেটও তার ক্ষুধার কথা জানান দেয় না। যেই ভয় দূর হয়ে যায়, তখন পেটের ভিতর যতো ক্ষুধা এতোক্ষন চুপ করেছিলো, তা একঝাকে জেগে উঠে। মারাত্তক উগলে উঠে পেট খাবারের জন্য। আমাদেরও তাই হল। এতোক্ষন ক্ষুধাটা বুঝি নাই। এখন মনে হচ্ছে, রাজ্যের ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। আমরা বেশ আনন্দের সাথেই দুপুরের খাবার খেলাম। 

আমাদের খাবারের পর ক্যাপ্টেন সাফিন (জিএসও-৩ অপারেশন) আমাদেরকে জানালো যে, রাত আটটায় কমান্ডারের ব্রিফিং হবে। সবাইকে ব্রিগেড অফিসে রাত আটটার মধ্যে থাকতে হবে। অনেক সময় হাতে। ভাবলাম, রাংগামাটি শহরটা ঘুরে দেখা যেতে পারে। আমাদের অনুরোধ রাখা হলো। আমরা দলবেধে ঘন্টাখানেক পর একটা স্কর্ট আর একটা পিকআপ নিয়ে রাংগামাটির বেশ কিছু জায়গা দেখলাম। ঝুলন্ত ব্রিজ, পরিত্যাক্ত পাহাড়ের কিছু অংশ, লেক, হাইড্রোলিক পাম্প, এবং জলবিদ্যুৎ এরিয়া সবগুলিই আমাদেরকে দেখানো হলো।

পানির যে কি শক্তি এই হাইড্রোলিক পাম্প এবং জলবিদ্যুত কেন্দ্র না দেখলে বুঝা যাবে না। অফুরন্ত পানির প্রবাহের একটা শব্দ আছে, অনবরত এই শব্দ মানুষকে বিমোহিত করে। হাজার হাজার টন পানি যখন একসাথে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রতিযোগীতা করে তখন তার সামনে কি আছে আর কি নাই এটা কোনো ব্যাপার না। জলোচ্ছাস কি, তার কি তান্ডব, আর্টিফিশিয়ালভাবে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কিছু আভাষ পাওয়া যায়। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, দেশের সিংহভাগ বিদ্যুৎ এই কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ হয়। কোনো কারনে যদি এই জলাধার আর না থাকে, বা শুকিয়ে যায় বা কোনো আকস্মিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে দেশের অন্যান্য সব অঞ্চল অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। এটা ভাবতেই মাথা ঘুরে যায়। দেশের এই মুল্যবান সপদ এমন এক জায়গায় যেখানে সারা বছর ঝুকিপুর্ন। রাংগামাটি শহর দেখা হল। মন ভরলো না। আবার কবে আসি জানি না কিন্তু এর বিস্ময়কর স্মৃতি আমার মাথায় পুরে থাকল।

রাত আটটায় আমরা ব্রিগেড অফিসে গেলাম। কমান্ডার আসেন নাই। কিন্তু অপারেশন অফিসার মেজর লিয়াকত আমাদেরকে প্রায় এক ঘন্টা কিভাবে কি অপারেশন করতে হবে, কিভাবে পেট্রোল করতে হবে, শান্তিবাহিনির ট্রেন্ড কি, তারা কিভাবে কিভাবে অপারেশন করে, কোন কোন দল এখানে কাজ করে, তাদের কমান্ডাদের নাম এবং সংঘটন সম্পর্কে একটা ধারনা দিলেন। সন্টু লার্মা যিনি এই শান্তিবাহিনীর কমান্ডার তার সম্পর্কেও অনেক কথা জানলাম। কিছু নোট করলাম, কিছু মাথায় নিলাম, আবার অনেক কিছুই মাথার উপরে দিয়ে গেলো বলে মনে হল। ক্যাপ্টেন নিজাম স্যার কেনো এম্বুসে মারা গেলেন এই উদাহরন বারবার টানা হলো। ক্যাপ্টেন নিজামের কাহিনীটা কোনো এক সময়ে বিস্তারীত লিখবো। চলে এলাম রেষ্ট হাউজে। তখন রাত প্রায় ১১ টা। আমি যে রুমে আছি, সে রুমেই থাকে ক্যাপ্টেন আখতার। অনেক রাত অবধি স্যারের সাথে গল্প হলো। স্যার নতুন বিয়ে করেছেন, ভাবীর কথা অনেক আলাপ করলেন। তার মনের কষ্টের কথা, তার ভালো লাগার কথা, তার একাকিত্তের কথা অনেক বললেন। পাহাড়িয়া এলাকায় সব অফিসারের একটা আলাদা জগত আছে। এই জগতের কথা সবাই জানে না। এটা নিতান্তই নিজের আর গোপন। যাই হোক, আগামীকাল আমরা বরকলে অবস্থিত ৪৪ ইষ্ট বেংগলে ওরিয়েন্টেশনের জন্য রওয়ানা হবো। এই কয়দিনে আমি যেনো যাযাবরের মতো আজ এখানে, কাল ওখানে দিনকাল কাটাচ্ছি। কোনো স্থানের অভিজ্ঞতাই যেনো এক নয়।

প্রায় দেড়টার দিকে ঘুমিয়ে গেলাম।