Categories
বগুড়া যাওয়ার পথে (২য় পর্ব)
বগুড়া শহরে এই আমার প্রথম আসা নয়। কর্মস্থল হিসাবে আমি এই অঞ্চলে প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়েছি। গ্রামের অধিকাংশ অলি গলি, আনাচে কানাচে ঘুরেছি, কখনো দায়িত্ব পালনের জন্য রাত অবধি জেগে থেকেছি। কখনো আবার নিছক মনের তাগিদে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য আহরণের জন্য দিকবিদিক ঘুরেছি। কখনো আমি গভির রাতে, কখনো রাতের শেষ প্রহর জেগে থেকে শুক্ল পক্ষের চাঁদ দেখেছি। কখনো আমি দেখেছি অমাবশ্যায় আকাশ তার কি রূপে পৃথিবীর কাছে প্রেম নিবেদন করে। কখনো আবার ঘোর বৃষ্টির রাতে যখন সব মানুসেরা তাদের নিজ নিজ আস্তানায় ফিরে গভির ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, যখন পাখীরাও আর কিচির মিচির করে না, আমি তখনও চাঁদহীন মেঘলা আকাশের মুসলধারে বৃষ্টির চ্ছটায় বারান্দায় বসে দেখেছি গাছগুলো কিভাবে বৃষ্টির জলে একা একা খেলা করে, কিভাবে হেলেদুলে একে অপরের আরও কাছে চলে আসে। কোন কথা নাই, নিঃশব্দে নিরবে অবিরত বৃষ্টি এই ঘুমন্ত ধরাকে কিভাবে স্নিগ্ধ চুম্বনে আলিঙ্গন করে। আকাশ মাটি আর বৃষ্টির এই প্রেমের লীলা এক অদ্ভুত রহস্য ঈশ্বরের। শরৎচন্দ্রের সেই বিখ্যাত শ্রীকান্ত উপন্যাসের কিছু অভিব্যাক্তি আমার মনে পরে। ……”অন্ধকারেরও রূপ আছে” । আসলেই আছে। মানুষ দিনের আলোয় যা দেখে না, অন্ধকারে সে টা উপলব্ধি করে, মানুষ দিনের আলোয় যা বিশ্বাস করে না, অন্ধকারের ঘোর নিশানায় সে সেটা বিশ্বাস করে। এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গাড়ির আলোতে আমি সামনের রাস্তা দেখছি কিন্তু পাশে ফেলে যাওয়া অনেক কিছুই এখন আর আমার নজরে পরছে না অথচ এই ফেলে যাওয়া রাস্তার ধারেও কতই না সৌন্দর্য পরে আছে। মাঝে মাঝে লাইট পোস্টের কিছু আলোতে কিছু কিছু লোকালয়ের বস্তি চোখে পরে। ওখানেও অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের অনেক কাহিনি লুকিয়ে আছে যার ইতি বৃত্ত আমাদের অনেকেরই জানা নাই।
অনেক দূর চলে এসছি আমরা। বগুড়া শহর আর বেশি দূরে নাই। গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেছে প্রায়, তেল নিতে একটি তেল পাম্পে ঢোকতেই হচ্ছে। ইচ্ছা না থাকা সত্তেও গাড়ি থামাতে হল। আমি নেমেই একটা সিগারেট ধরালাম। একটি ৬-৭ বছরের বাচ্চা সহ একজন মহিলা আমার কাছে এসে বল্ল, স্যার আমার এই ছেলেটার একটা চোখ অন্ধ, আর একটা হাত অবশ। দিন না আমাকে কিছু। বড় মায়া হল। মা তার অন্ধ এবং পঙ্গু ছেলের জন্য কোথায় না ঘুরছে? আমার মায়ের কথা মনে পড়ল। মনে হল কতকাল আমার মা আমাকে আর আদর করে না, কতকাল আমার মা আমাকে আর খোকা বলে ডাকে না। আমাকে আর শাসনও করে না। অথচ আমি জানি আমার মা আমার কাছে আছেন, আমাকে দেখছেন। আজ আমি বাবা, আমার মেয়েরা আস্তে আস্তে তাদের আরেক জীবনে প্রবেশ করছে। হয়তবা আমিও আর ওদেরকে আর আগের মত শাসন করতে পারবনা, আমি আর আগের মত বুকে জরিয়ে ধরে বলতে পারব না, মা তোমার কি মন খারাপ? হয়ত বা তার সত্যি মন খারাপ, হয়তবা সেও কোথাও বসে কোন এক অমাবস্যার রাতে বৃষ্টির ঘন চ্ছটায় আমাদের কথা মনে করছে, অথচ আমি তার পাশে নাই। তাই মাঝে মাঝে অদেরকে মিস করব বলে আজ এই দিনে অনেক অগোছালো আব্দার আমি মেনেই নিচ্ছি।
যাই হোক, ছেলেটার জন্য প্রচন্ড মায়া হল। মায়ের জন্য আমার বুকটা কোথায় যেন একটু ব্যাথা অনুভব করলাম। বললাম, এটা কি তোমার একমাত্র সন্তান? মা সময় অপচয় না করে বিনা দ্বিধায় উত্তর দিল, “হ্যা গো স্যার, হামাক একটাই পোলা, হামাক বড় আদরের পোলা গো স্যার।” একটা মা, জাস্ট একজন মা। তার পরিচয়, মা। মাকে নিয়ে অনেক কবিতা পড়েছি, মাকে নিয়ে অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। মাকে নিয়ে ধর্মগ্রন্থেও অনেক বানি রয়েছে। আমি নিজেও মাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছি যদিও আমি কবি নই। আমার কবিতা কোথাও ছাপা হোক সেটাও আমি চাইনি। তারপরেও মনের আবেগে আমি মাকে নিয়ে অনেক কবিতাও লিখেছি। আজ মনে হচ্ছে মাকে খুব মিস করছি। কোন এক সময় মাকে মিস করে একটা কবিতাও লিখেছিলাম…
আমি এক দস্যুরানীর প্রেমিক
কি এক অদ্ভুদ তার চাহনি, কখন মায়াবতী
কখন বা কঠোর স্পাত কঠিন ভিতি
কি অবাক এক জীবনীযোগে
অতন্দ্র ঘোর অন্ধকারে আমার পানে চাহিয়া সে আলেয়ারে খোঁজে
আবার কখনো টকটকে রৌদ্র স্নানে
কোন এক অজানা ভয়ে কম্পিত হয় শিহরনে
কখনো ভালবাসায় আমাকে ছুরে দেয় অসীম আকাশের দিকে
আবার যদি হারিয়ে যাই এই ভয়ে ঢেকে রাখে তার শারির আচলে
কি অদ্ভুদ সে।
কখনো গাল ভরে চুমু
আবার কখনো ইশা খার মত করা শাসনের ঝুমু
সকাল সন্ধ্যা দিন রাত আমার কোন স্বাধীনতা নাই
আবার আমার কোন কাজে তার কোন বাধাও নাই
মাঝে মাঝে আমার বড় রাগ হয়
আর সে খিলখিলিয়ে হাসে,
আমি যখন হাসি, সে তখন অপরূপ দৃষ্টিতে অশ্রু নয়নে ভাসে
আর বলে, আমি নাকি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর।
অথচ আমার একটা চোখ নাই, আমি দেখতেও ফর্সা নই।
একদিন অনেক রাতে সেই অমাবশ্যার অন্ধকারে চুপি চুপি আমি তারে প্রশ্ন করেছিলাম
কে গো তুমি আসলে?
সিক্ত নয়নে আমার কাধে হাত রেখে বলেছিল
“তুমি যখন এই পৃথিবীতে প্রথম আস
তখন আমার নতুন পরিচয় হয়েছিল
আমার নতুন নাম হয়েছিল, “মা”
(…… হয়ত চলবে)