২৩/০২/২০১৬- বগুড়ার পথে

Categories

বগুড়া যাওয়ার পথে

দুরন্ত গতিতে কখনো আমাদের গাড়ি ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত বেগে চলছে, আবার কখনো কখনো অধিক গাড়ির জটিলতায় একেবারে থেমেই যাচ্ছে। থেমে গেলেও খারাপ লাগছে না। কারন আমি রাস্তার দুই ধারে গ্রামের কি এক অপূর্ব সবুজের রাজত্ব, অনেক দূরে গ্রামের কিনারা দিয়ে বয়ে যাওয়া চিকন চিকন খালের ধারে হরেক রঙের গরু ছাগল, ভেড়া, কচি কচি ঘাস খাওয়ায় মগ্ন, ঐ খালের নোংরা জলে কিছু দুর্দান্ত বালক বালিকা কেউ কাপড় পরে আবার কেউ একেবারে দিগম্বর হয়ে খালের কিনারা থেকে লাফ দিয়ে তাদের বীরত্ব দেখানোর তাগিদে কে কত টুকু দূরে লাফিয়ে পরতে পারে তার প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইত্যাদি দৃশ্য আমার মনে এক আনন্দের জয়ার দিচ্ছে। আমি দেখছি, ঐ সব ছোট ছোট বালক বালিকাদের মধ্যে মাঝে মাঝে মধ্য বয়সী কোন অভিভাবক সন্তানের অনিষ্ট না হয় এমন লাফের পায়তারা থেকে উচ্চস্বরে ধমকও দিচ্ছেন। কিন্তু কে কার কথাই বা শুনে। এদের যে বয়স, তাতে দুরন্তপনাই হচ্ছে মূললক্ষ। আমি অনেকক্ষন ধরেই এই অভাবিত দৃশ্য গুলো দেখছি আর আমার সেই শৈশবকালের একই প্রকৃতির দুরন্তপনাগুলো মনে করছি। আহ কি সুন্দর ছিল সেই সব দিনগুলো।

আমার সঙ্গে আমার মেয়েরা আছে। ওরা আধুনিককালের প্রজন্ম। এরা এই সব দৃশ্যের আনন্দের মুহূর্তগুলো বুঝে না। ওরা গাছের সবুজের নিচের আলো বাতাসের খবর রাখে না। ওরা চৈত্রের দুপুরে হেটে হেটে স্কুল থেকে এসে পান্তা ভাতের স্বাদ বুঝে না। ওরা কালবৈশাখী ঝড়ের দিনে আধাপাকা আম কুড়ানোর মজাটা বুঝে না। কিংবা শিলা বৃষ্টির মধ্যে অযথা ছোটখাট বরফের মত শিলা কুড়ানোর মজাটা বুঝে না। ওরা সারাক্ষন ট্যাব আর মোবাইল ফোন নিয়ে রক মিউজিক নিয়ে ব্যস্ত কিংবা কম্পিউটারে গ্রাফিক্সের মাধ্যমে গ্রামের কিছু কিছু অতি সুন্দর পোট্রেট দেখেই মুগ্ধ। কিন্তু সত্যিকারের গ্রামের গা থেকে সোঁদা মাটির যে গন্ধ, পচা বাঁশ পাতার যে একটা টক টক ঘ্রান, কিংবা সন্ধ্যায় শিয়ালের যে ডাক, তারা ওগুলোর কোন স্বাদ বুঝে না। গ্রামের রাস্তা ধরে ক্ষেতের আইল ভেঙ্গে হাটার যে এক অদ্ভুদ রোমান্স, আধাকালো সন্ধ্যায় ভয় ভয় হৃদয়ে শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়ার যে অনুভূতি তার কোন কিছুই এদের ইন্দ্রিয় বুঝে না। ওরা সুকান্তকে চিনে না, ওরা রবিন্দ্রনাথকে চিনে না, ওরা নজরুলের প্রেমের কবিতা পরেনা। ওরা অনেক কিছুই জানে না। ওরা টাইটানিক দেখে অভিভুত হয় কিন্তু ওরা জ্যাকের ঐ ঐতিহাসিক কথাগুলো বুঝে না যখন সে বলে, “পার্টি? পার্টি যদি মজা করতে হয় তাহলে আস আমার সঙ্গে আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায়, দেখ কিভাবে পার্টির স্বাদ গ্রহন করতে হয়।” রোজ বুঝেছিল কিন্তু আজকের দিনের “রোজেরা” এটা বুঝে না, বুঝতেও চায় না।

যাই হোক, আমরা চলছি আর আমি দেখছি দুই প্রজন্মের মধ্যে কত ফারাক হয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবী। আমার কাছে এখনো ঢেঁকি ছাটা চাল খেতে মন উতলা হয়ে উঠে, আমার এখনো বরই গাছের নিছে এবড়ো থেবড়োভাবে পরে থাকা আধাপাকা বরই একদম একটু লবন দিয়ে আবার লবন পাওয়া না গেলে খালি খালিই খেতে মন চায়, আমার কাছে কয়েক টুকরা ধনিয়া পাতা হাত দিয়ে মুচড়ে কাচা মরিচ দিয়ে এক প্লেট পান্তা ভাতের আনন্দ এখনো পেতে ইচ্ছে করে। কি সব দিনগুলো আমি হারিয়ে ফেলেছি, ভাবতেই আমার মন যেন একেবারে ব্যথায় মুচড় দিয়ে উঠে। আমি কি বলি আমার সন্তানেরা বুঝে না, আমার সন্তানেরা কি বলে আমার বুঝতে ভাল লাগে না। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা এখন আর আজকের দিনের ছেলেমেয়েদের কাছে কোন কাব্যই মনে হয় না। রক্তকরবি দেখে ওদের মনে হয় কি সব আবোল তাবোল লেখা লিখে রবিন্দ্রনাথ এত বিখ্যাত হয়ে গেলেন? নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ যেন এক কাল্পনিক কথা, এর কোন রোমান্স আজকের দিনের প্রজন্মের কাছে কোন স্বপ্নই মনে হয় না। ম্যাক্সিম গোরকির “মা” উপন্যাশটি পরার জন্য আমি কতবার পরিক্ষার পড়ায় ছেদ দিয়েছি তার কোন ইয়ত্যা নেই, অথচ আজ যখন আমি আমি আমার প্রজন্মের কাছে এই সব উপন্যাশের কথা বলতে চাই, তারা ম্যক্সিম গরকিকে তাই জানে না।

গান বাজছে আধুনিক। কি সব কথাবার্তা, কোন ভাব গম্ভীরতা নাই, সুর আছে ড্রাম পিটানোর মত, বুকে লাগে এর প্রতিটি আছাড়। কিন্তু হৃদয় ছুয়ে যায় না। (…চলবে)