২৩/০৪/২০২৩-দুই ফ্রন্টে আমেরিকার যুদ্ধ কি সঠিক?

বর্তমানে ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সাথে এবং তাইওয়ান ঘিরে চীনের সাথে আমেরিকা ভালো রকমের একটা কোন্দলে জড়িয়ে গেছে। চীন, রাশিয়া এবং আমেরিকা তিনটেই সুপার পাওয়ার এবং তিনটেই ভেটো ক্ষমতার অধিকারি, তিনটেই নিউক্লিয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ। রাশিয়া ইউরোপের জোনে, চীন এশিয়া প্যাসিফিক জোনে। আলাদা আলাদা জোন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-একই সময়ে, একই সাথে দুইটি ভিন্ন জোনে দুইটি সুপার পাওয়ারের সাথে আমেরিকার কি দুইটা ফ্রন্ট খোলা উচিত?
আমার মতে, দুই ফ্রন্টে আমেরিকা হয়তো একই সাথে রাশিয়া এবং চীনকে কন্টেইন করবে না, কিন্তু পরিস্থিতির কারনে এটা আবার ফেলেও দেয়া যায় না। স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে একচ্ছত্র ইউনিপোলারিটির কারনে আমেরিকা তার সাথে ইউকে এবং কানাডা সহযোগী হিসাবে মনে করে বিশ্বের তাবত দেশের গনতন্ত্র, সাইবার ক্যাপাবিলিটি, আন্তর্জাতিক সমুদ্র, আকাশ কিংবা মহাকাশ এমন কি প্রতিটি দেশের সার্বোভৌমত্ব রক্ষা তাদের দায়িত্ব। আর এ জন্য সে “রুলস বেজড অর্ডার” এর প্রচলন করেছে অর্থাৎ আমেরিকা পরিস্থিতি বিবেচনা করে রুলস দিয়ে দেবে আর অন্য সবাই সেই রুলস অনুসরন করে তাদের দেশের পলিসিসমুহ এডজাষ্ট করে ইন্টারনাল ফরেন পলিসি করে দেশের শাসনভার পরিচালনা করবে। সেই রুলস বেজড অর্ডারের কেউ বাইরে গেলে হয় সে আমেরিকার শত্রু অথবা সেখানে গনতন্ত্র অনুসরন করছে না এই কারনে আমেরিকা তাকে যা খুশি যেমন নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ, এমন কি আক্রমন পর্যন্ত করতে পারে। এটাই ছিলো এ যাবত কালের কৃষ্টি। আমেরিকার নিজস্ব রুলসের মাধ্যমে অন্য দেশসমুহকে এভাবেই তারা নিয়ন্ত্রন করেছে এবং করছে বলে বর্তমান বিভিন্ন দেশসমুহ বিবেচনা করছে।
যাই হোক যেটা বলছিলাম, দুই ফ্রন্টে দুই পরাশক্তিকে কন্টেইন করা। আমার মতে এটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এখানে আসলে বাহ্যিক দৃষ্টিতে দুটু ফ্রন্ট দেখা গেলেও এটা শুধু দুইটা ফ্রন্ট না, এখানে রাশিয়া এবং চীন সরাসরি দুইটা ফ্রন্ট দেখা যায়, আরো অনেক অদৃশ্য ফ্রন্ট রয়েছে, যেমন আফ্রিকান ফ্রন্ট, মিডল ইষ্ট ফ্রন্ট, নর্থ কোরিয়া, ইরান কিংবা ইন্ডিয়ান ফ্রন্ট। এই অদৃশ্য ফ্রন্টগুলি হয়তো সামরিক নয়, কিন্তু সেগুলি অবশ্যই ইকোনোমিক, বাই-লেটারেল এবং ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে মারাত্মক ভূমিকা রাখে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা সামষ্টিকভাবে আমেরিকার জন্য বিপদজনক হতে পারে।
সামরিক শক্তির বিন্যাস যদি আমরা একটু দেখি, তাহলে দেখবো যে,
আমেরিকার সামরিক শক্তি যেভাবে তারা বিন্যাস করেছে তাতে বিশ্বমোড়ল গিড়ির জন্য একচ্ছত্র সামরিক পেশী সে নয়। ন্যাটো দিয়ে হয়তো কিছুটা আম্ব্রেলা করা গেছে বটে কিন্তু গত ২০ বছরে আমেরিকা যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপের অন্যান্য দেশ কিংবা আফ্রিকান দেশসমুহে তাদের ফোর্সকে ব্যবহার করেছে, তাতে আমেরিকার সামরিক শক্তি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যেখানে রাশিয়া এবং চীন বিগত কয়েক দশকে তাদের বাজেটের একটা বেশ বড় অংশ ডিফেন্স বাজেটে ক্রমাগত যুক্ত তো করেছেই উপরন্ত তারা কোথাও নতুন কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তারা তাদের সামরিক সক্ষমতাকে লস করে নাই। আর এসব তারা প্রিজার্ভ করেছে শুধুমাত্র আমেরিকাকে মোকাবেলা করার জন্যই। এটা আমেরিকার জন্য বিরাট ভয়ের ব্যাপার।
চীন শীপ বিল্ডিং প্রোগ্রাম এমনভাবে চলমান রেখেছে যে, আমেরিকার নেভী শীপ থেকে চীনের সংখ্যা অনেক অনেক বেশী। চীনের হার্ডপাওয়ারের পরিসংখ্যানে আগামী দিনগুলিতে চীন মিলিটারী গ্লোবাল ব্যালেন্স শিফটিং এ লিড করতে পারে এমন ভাবেই সে তার ডিফেন্স ক্যাপাবিলিটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
যদি রাশিয়ার কথা বলি, আমেরিকার অনেক অস্ত্র রাশিয়ার অস্ত্রের থেকে বেশী কার্যকর বলে ধারনা করা হয়। কিন্তু রাশিয়ার অনেক কিছুতেই সিলেক্টিভ এডভান্টেজ রয়েছে আমেরিকার উপর। যেমন, আমেরিকার ৬০০০ ট্যাংক আছে কিন্তু রাশিয়ার আছে ১২০০০। রাশিয়ার ট্যাক্টিক্যাল নিউক্লিয়ার ক্যাপাবিলিটি আমেরিকার থেকে প্রায় কয়েকগুন বেশী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্রের কার্যকর ক্ষমতার এডভান্টেজ থাকলেও এদের সংখ্যাতাত্তিক ইনভেন্টরি এতোই কম যে, আমেরিকার পক্ষে কোনোভাবেই মাল্টিফ্রন্টে নিজেদেরকে এনগেজ করা সম্ভব না।
একটা উদাহরন দেই-আমেরিকাকে যদি রাশিয়াকে কন্টেইন করতে হয়, তাহলে ইষ্টার্ন ইউরোপিয়ান ফ্রন্টে তার মিলিটারী ইউকুইপমেন্ট এবং জনবল মোতায়েন করতে হবে। আর এটা করতে হলে আমেরিকাকে অন্য রিজিয়ন থেকে (যেমন ওয়েষ্ট প্যাসিফিক) এসব ফোর্সকে তুলে আনতে হবে। আর যদি ওয়েষ্ট প্যাসিফিক থেকে অস্ত্রশস্ত্র এবং জনবল অন্যত্র শিফট করতে হয় তাহলে চীনকে আর কন্টেইন করা সম্ভব না। যদি আমেরিকাকে আসলেই ২টা ফ্রন্টে একসাথে ২টা পরাশক্তিকে কন্টেইন করতে হয়, তাহলে বিমান বাহিনীর পাশাপাশি-
(ক) কমপক্ষে ৫০টি ব্রিগেড কম্বেট টিম লাগবে যা বর্তমানে ওদের আছে ৩১টি ব্রিগেড কম্বেট টিম।
(খ) অন্তত ৪০০ টি নেভী ব্যাটল শীপ দরকার যা বর্তমানে আছে ২৯৭ টি
(গ) এ ছাড়া অন্যান্য সুবিধাবাদী শত্রুদেরকেও আমেরিকাকে কন্টেইন করতে হবে-যেমন ইরান, নর্থ কোরিয়া ইত্যাদি। এর জন্যেও আলাদা করে আরো সামরিক শক্তি রিজার্ভ এবং মোতায়েন রাখতে হবে।
উপরের সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, খুব দ্রুতই আমেরিকার পক্ষে একের অধিক দুইটা ফ্রন্টে একই সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্ভব না বা উচিত না। মাল্টিফ্রন্টে যেতে হলে প্রতি বছর আমেরিকাকে তার বাজেটের ৪০% বাজেট আলাদা করে ডিফেন্স ফোর্সকে বন্টন আবশ্যিক। কিন্তু ৪০% বাজেট ডিফেন্স ফোর্সকে দিতে হলে যে পরিমান ট্যাক্স রেভিনিউ সংগ্রহের প্রয়োজন, তাতে সাধারন নাগরকদের উপর বাড়তি চাপ পড়বে, নিত্য নৈমিত্তিক পন্যের দাম বেড়ে যাবে, লিভিং কষ্ট বাড়বে। তাতে জনসাধারনের ক্ষোপ বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। একদিকে যুদ্ধের খরচ, অন্যদিকে যুদ্ধের জন্য উপযোগী হতে বাড়তি খরচ, সাথে জনসাধারনের বিরুপ প্রতিক্রিয়ায় দেশে নইরাজ্যকর একটা পরিস্থিতি বিরাজ করার সম্ভাবনা। এদিকে আরেকটা খারাপ সংবাদ হচ্ছে- ডি-ডলারাইজেশন। তাতে আমেরিকা মূল চালিকা শক্তিতে একটা ভাটা পড়বেই।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে- ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ না হতেই যদি চীন তাইওয়ানকে কোনো প্রকার আক্রমন করে বসে (সম্ভাবনা যদিও খুব কম, কিন্তু চীনকে বিশ্বাস করা কঠিন), তাহলে আমেরিকাকে সম্ভবত একাই দুটু ফ্রন্টে লিপ্ত হতে পারে। যদি চীন তাইওয়ানকে আক্রমন করেই বসে, তাহলে বুঝতে হবে যে, রাশিয়ার সাথে চীনের একটা বিশাল বোঝাপড়া হয়ে গেছে। এই ফ্রন্টে লিপ্ত হলে সম্ভবত ইউরোপ, জাপান কিংবা ইন্ডিয়া আমেরিকার পাশে থাকার কথা নয়। জাপান এবং ইন্ডিয়ারও নিজেদের এজেন্ডা রয়েছে এই জোনে। আর ইউরোপ মনে করে তাইওয়ান তাদের কোনো মাথা ব্যথার কারন হতে পারেনা। সেক্ষেত্রে চীনকে সমানে সমান কন্টেইন করতে গেলেই ইউক্রেনের উপর আমেরিকার নজর অনেকটাই থিতে হয়ে আসবে। আর এই থিতে হয়ে আসা মানেই রাশিয়া এগিয়ে যাবে।
সময়টা খুব খারাপ আসছে মনে হচ্ছে আগামীতে। কোনো কিছুই সঠিক প্রেডিক্ট করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে।