২৩/০৯/১৯৯১- বরকল আগমন

Categories

মানুষ যখন একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তখন প্রথমে বিদ্রোহ হয় তাকে মন থেকে গ্রহনের বর্জনতায়। তারপর এটা সংক্রমিত হয় একজন থেকে আরেকজনে। এভাবেই কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী যখন একটা দল হয়ে উঠে, তারা তখন তাদের ইথিক্যাল ভ্যালুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সেই এলাকার অন্যান্য মানুষের মনেও বিষ্ক্রিয়া চালাতে থাকে। বিষের মাত্রা যখন প্রায় সহনীয় পর্যায়ের থেকে বেশী মাত্রায় চলে যায়, তখন কমিউনিটি সংক্রমন হতে বাধ্য। আর যখনই কমিউনিটি সংক্রমন বাড়তে থাকে, তখন দেশের প্রচলিত নিয়মে এসব দলকে শায়েস্তা করার জন্য সরকার একের পর এক আইন বানাতে থাকে। আবার এই আইনের বার্তায় বিদ্রোহীরাও নতুন নতুন কৌশল স্রিষ্টি করে সরকার বাহাদুরকেও তাক লাগানর বাহাদুরি বা আস্পরা দেখাতে আহলাদি হয়ে উঠে। আর এই আহলাদির নাম- যুদ্ধ।

হিলে এখন সেই যুদ্ধ চলছে। শান্তিবাহিনীর স্বাধিকার আন্দোলনের চেয়ে যেনো মনে হয় ব্যাপারটা এখন গুটিকতক উপজাতীর নিজস্ব দেমাগে পরিনত হয়েছে। কেনো বললাম বা কেনো আমার কাছে এটা মনে হয়েছে সেটা বলি। আজই দুপুরের দিকে আমি বরকল পৌঁছেছি। চট্টগ্রাম থেকে আসা অবধি যতো ব্রিফিং শুনেছি, তার সবগুলি ব্রিফিং প্রায় একই রকম। কিন্তু এই বরকলে এসে ব্যাপারটা আমার কাছে অন্যরকম একটা ধারনা দিল। এখানে সবাই বিদ্রোহী নয়। শুধুমাত্র চাকমা গোষ্ঠীটাই এই বিদ্রোহের প্রধান হোতা। এখানে পাংখু আছে, মার্মা আছে, ত্রিপুরা আছে আরো অন্যান্য ট্রাইবস যারা শান্তিপূর্ন জীবন চায়। এর মানে হলো, আমরা যদি শুধুমাত্র এই চাকমা ট্রাইবটাকে আইসোলেশন করতে পারি, তাহলে সংখ্যাটা অনেক অংশে কমে যায়। যাই হোক, ব্যাপারটা আরো নিবিড়ভাবে দেখা এবং বুঝা দরকার। এখনি সব কল্পনা বাস্তব বলে উপসংহারে  আসা যাবে না।

বরকলে আসার জন্য সেনাবাহীনি পেট্রোল বোট ইউজ করে। কিন্তু সাধারন মানুষজন ব্যবহার করে বটবটি নামে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এতোক্ষন আমরা যারা বিডিআর এর সাথে সংযুক্তিতে ছিলাম, তারা একইসাথে ছিলাম। তাদের মধ্যে যারা ছিলো তারা হচ্ছে ৬ ফিল্ডের শাহরিয়ার (সে মদনে পোষ্টিং), আমি নিউলংকারে, ক্যাপ্টেন জামাল ১৪২০ ক্যাম্পে, তাসওয়ার রাজা (হাসন রাজার নাতি) আরেক ক্যাম্পে, ইকবাল (সিগ্ন্যালের) সেও মদনের আরেক ক্যাম্পে। ফলে আমি আর জামাল স্পীড বোটে রওয়ানা হলাম বরকলের উদ্ধেশ্যে। চমৎকার একটা লেক। খুবই সুন্দর। আমাদের স্পীড বোট প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে কাপ্তাই থেকে রওয়ানা দিয়ে বরকলের দিকে যাচ্ছে। এতো লম্বা পথ হাই স্পীড বোটে আমার এটাই প্রথম। আশেপাশে উপজাতীদের কিছু কিছু বাড়িঘর চোখে পড়ে। অবাক লাগে, এরা কোথায় বাজার করে, কোথায় বেচাকেনা করে, কার কাছে করে আমার জানা নাই। আমরা সবাই ইউনিফর্ম পরা অস্ত্র নিয়ে বসে আছি। আমি জানি না যদি কোনো শত্রু আমাদেরকে এই অবস্থায় আক্রমন করে, আমরা কতটুকুই বা সামাল দিতে পারবো। শুনলাম আমাদের যাওয়ার রাস্তার দুই ধারে নাকি রুট প্রোটেক্সন আছে, চোখেও পড়েছে অনেক রুট প্রোটেক্সন ক্যাম্প।

৪০ মিনিট চলার পর আমাদের বোট একটা ঘাটে এসে থামলো। এটাই ৪৪ ইষ্ট বেংগলের প্রধান ব্যাটালিয়ান। আমরা নেমে গেলাম। সিনিয়র জেসিও মোজাম্মেল আমাদেরকে ঘাট থেকে রিসিভ করলেন। আমরা (আমি আর ক্যাপ্টেন জামাল) নিজেদের ব্যাগ বোটেই রেখে নেমে গেলাম। কারন আমাদের ব্যাগ নেওয়ার লোক আছে। ৪৪ ইষ্ট বেঙ্গলে যাওয়ার পর দেখলাম, প্রায় সবগুলি ঘরই বাশের বেড়া দিয়ে ঘেড়া। একদিকে সিও সাহেব তার পরিবার নিয়ে থাকেন, সেটা আবার মাটির প্রলেপে ওয়াল দেয়া। আর বাকী সবগুলি ঘর নিঘাত বাশের। আমরা অফিসার ফিল্ড মেসে ঢোকলাম। গিয়ে দেখলাম, ক্যাপ্টেন ইসমাত (১১ লং কোর্ষের) স্যার ভিডিওতে ইন্ডিয়ান ছবি দেখছেন। একটু পরে এলো আমার কোর্ষ্ম্যাট লেঃ তারেক। সে আমাদের ক্যাডেট কলেজের এক বছর সিনিয়র ছিলো। কিন্তু এখন আমাদের কোর্ষের সাথে কমিশন পাওয়ায় আমি আর আগের সম্পর্কটা ধরে তাকে ভাই বলি না। তুমি করেই সম্মোধন করি। সাথে আরো দুই কোর্ষম্যাট মামুন আর আব্দুল্লাহও এলো। ভালো লাগলো ওদের দেখে। একটু ভরষাও যেনো পেলাম। আমি আর্টিলারীর লোক, এখানে ওরিয়েন্টেশন করবো সেটা ওরা কিভাবে নেয় জানি না, তবে আমার কোর্সম্যাটদের দেখে একটু ভালো লাগলো।

ইসমাত স্যার এই ইউনিটের এডজুটেন্ট। আমরা ছবি দেখতে দেখতে ইসমাত স্যার বললেন, সিও সাহেব সন্ধ্যায় কথা বলবেন। সিও সাহেবের নাম, লেঃ কর্নেল আশফাক। স্যার এটাও বললেন, তার সামনে স্মার্ট হইও না কারন মানুষ বেশি সুবিধার না। একটু ভরকে তো গেলামই। উপঅধিনায়কের পদে আছেন মেজর মিজান স্যার। বেশ তোতলামিতে ভরপুর। আমার মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে, কমিশন পাবার সময় কি বিএমএ তে স্যারের এই তোতলামী ধরা পরে নাই? কিন্তু মানুষ হিসাবে বেশ ভালো। সিও সাহেবের কথার বাইরে যাবার কোনো অবকাশ নাই। তার দুই মেয়ে। লাঞ্চের পরে অনেক আলাপ করলাম ফিল্ড মেসে বসেই।

আলাপ আলোচনার পর আমরা আমাদের ব্যারাকে চলে গেলাম। কি এক অবস্থা। সৈনিকের সাথেই থাকা আর তাদের একই খাবার সবার জন্য। তবে আমরা ইচ্ছা করলে অফিসার মেসেও খেতে পারি। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, কোম্পানি কমান্ডারগন যার যার কোম্পানীর সাথেই ডাইনিং করেন। তাতে একটা লাভ হলো, কোনো টাকা লাগে না। হয়তো এই কিছু টাকা বাচানোর জন্যেও অফিসাররা সৈনিকদের সাথেই ডাইনিং করেন।

রাতে সিও সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হলো। তিনি অনেক কিছু বললেন না, শুধু বললেন, আমাদের জন্য ওরিয়েন্টেশনের প্রোগ্রাম করা হয়েছে কিনা, আর করে থাকলে সেটা যেনো আমাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। আগামিকাল থেকেই পেট্রোল চলবে। আর প্রতিদিন পেট্রোল রিপোর্ট সিও সাহেবকে দেখাতে হবে।

আমরা যার যার ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের একটা করে কপি হাতে নিয়ে আবারো চলে এলাম যার যার ঘরে। আগামীকাল ভোর ৪ টায় আমার একটা পেট্রোল আছে।