জীবনে কিছু কিছু সময় থাকে যখন নিশ্চিত ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা জেনেও সে সেটাই করে। আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটা আত্তঘাতী বলে মনে হতে পারে, অথবা মনে হতে পারে মানষিক কোনো সমস্যা, কিন্তু যিনি এই মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তিনিই একমাত্র জানেন, কেনো এই আত্তঘাতীমুলক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বা নিতে হচ্ছে। কারো জীবনে যখন সারাটি দিন, ক্ষন অথবা মুহুর্ত বিপদের মধ্যেই থাকে, কিংবা এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই তার জীবন অতিবাহিত হয় যা সাভাবিক জীবন থেকে অনেক আলাদা, তখন কোনটা নিশ্চিত ক্ষতি আর কোনটা নিশ্চিত লাভ, এটা আর তখন বাছ বিচার করার সময় থাকে না, তেমনি থাকে না কোনো প্রাইয়রিটিও। সামনে যেটা আসে, সেটা আপাতত সামাল দিতে তখন যা যা করা উচিত বলে মনে হবে, সেটাই আসলে সঠিক সিদ্ধান্ত হিসাবে তাকে তাইই করতে হয়। হোক সেটা আত্তঘাতীমুলক বা এই জাতীয় কিছু। কখনো কখনো এই সিদ্ধান্তগুলি মানুষকে নিশ্চিত পরাজয়ের দারপ্রান্তে যেমন নিয়ে যেতে পারে, তেমনি পারে নিশ্চিত সাফল্যের দারপ্রান্তে নিয়ে যেতে। এটা এক প্রকারের গেম্লিং বলা যেতে পারে।
আমি যে সব ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে আমার প্রাত্যাহিক জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তাতে আমার ব্যাপারে কি ঘটবে আর সেটা কিভাবে সামাল দেবো, এই বিচার আমারই ছিলো তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম না আমি কি পরাজয়ের পথে এগুচ্ছিলাম নাকি নিশ্চিত বিজয়ের পথে। আমার প্রাত্যাহিক জীবনে বেশ কিছু বিষয় ছিলো যা অনেকটা অমাবশ্যার দিন রাত্রির মতো। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কিভাবে এই রাহু বৃত্ত অমাবশ্যার ছোবল থেকে আমার নিস্তার বা পরিত্রান। আর আমি এটাও বুঝতেছিলাম না, আমার এই অমাবশ্যার ক্ষন কিভাবে কেটে যাবে। অমাবশ্যা কবে কাটবে তার জন্য হয়তো জজ্ঞের আয়োজন করা যেতে পারে কিন্তু অমাবশ্যা কাটবে কিনা সেটা কোন ভাবেই জজ্ঞ নিশ্চয়তা দেয় না। অনেক সময় ছোট ব্যাপার বড় হয়, আর সেই বড় ব্যাপার থেকে তৈরী হতে পারে কোনো বড় ধরনের ঝামেলা। আমি ঠিক সে রকম একটা অমাবশ্যার পরিস্থিতিতে যেনো আছি।
বগুড়া সেনানীবাসে লোকেটিং ইউনিটে কর্মরত ছিলাম। আমার ওসি মেজর ইকবাল স্যার অনেক ভালো মানুষ কিন্তু চাপা সভাবের হওয়াতে তার সাথেও আমি অনেক কিছুই শেয়ার করতে পারছিলাম না। তাহলে ব্যাপারটা খুলেই বলিঃ
সেনানীবাসে একজন আর্মি অফিসারের বিয়ের বয়স অফিশিয়ালি নির্ধারন হয় তার বয়স কমপক্ষে ২৬ হতে হবে অথবা চাকুরীর মেয়াদ কমপক্ষে ৬ বছর যেটা আগে হয়। কিন্তু যে কোনো পরিস্থিতিই হোক আমি গত ৩০ শে মে ১৯৮৮ তারিখে কাউকে না জানিয়ে মিটুলকে বিয়ে করে ফেলি। এই ঘটনাটা জানাজানি হলে আমার শাস্তি হবে অনেক কঠোর এই কারনে যে, আমি আর্মির আইন ভংগ করে বিয়ে করেছি। সবচেয়ে কম শাস্তি হবে এই রকম যে, আমার অন্তত ২ বছরের সিনিয়রিটি কেড়ে নেয়া হতে পারে। তাই, আমার এখন কাজ হচ্ছে, সময় পার করা যাতে আমি আর্মির নিয়ম অনুসারে অন্তত হয় ২৬ বছর বয়সী হই অথবা চাকুরীর মেয়াদ অন্তত ৬ বছর পার করি। আর এটা হতে আমার আরো দেড় বছর বাকী। এই দেড় বছর আমাকে এতোটাই সাবধানে চলতে হবে যেনো কোনো গোয়েন্দা, কিংবা কোনো অফিশিয়াল তদন্তের মধ্যে পড়ে না যাই। ব্যাপারটা খুবই আতংকের। মিটুল (মানে আমার স্ত্রী) যেহেতু জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ফলে ওকে হোষ্টেলে রাখাতে আমার অন্তত একটা বউ লুকানোর জায়গা ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে মিটুল বগুরায় ওর এক বোনের বাসায় আসে যেখানে আমরা দেখা করি, রাত্রি যাপন করি। এটাও খুব বিপদজনক। কারন বগুড়া সেনানীবাস খুব ছোট একটা সেনানিবাস (বিশেষ করে জাহাজ্ঞিরাবাদ সেনানিবাস)। এখানে প্রতিটা অফিসারের মুভমেন্ট গোয়েন্দা সংস্থা খুব শক্ত করে মনিটর করে।
এমনই এক সময়ে আমাকে আমার আরপি (রেজিমেন্টাল পুলিশ) হাবিলদার (হাঃ মোজাম্মেল) কানে কানে একটা ইনফর্মেশন দিলো যে, স্যার, মিটুল চৌধুরী কে? আমার তো পিলে চমকে উঠার মতো অবস্থা। কারন মিটুল চৌধুরী সম্পর্কে বা এই নামটা তো অন্তত আমার আরপি হাবিলদার কোনোভাবেই জানার কথা নয়। জিজ্ঞেস করলাম, কেনো, কি হয়েছে? মোজাম্মেল জানালো যে, কোনো এক গোয়েন্দা বাহিনীর কেউ তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে। ব্যাপারটা আমাকে ভীষনভাবে ভাবিয়ে তুল্লো। ভাবলাম, যদি সত্যি সত্যিই কেউ এ ব্যাপারে খোজ খবর নেয়, তাহলে, আমি ফেসে যাবো, আর সেটা খুব দ্রুত। এর থেকে মুক্তির একটা উপায় বের করতে হবে যাতে আমি নিরাপদে আরো দেড় বছর কারো চোখে না পড়ি।
অনেক ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে। কারো সাথে এটা নিয়ে কোনো আলাপ আলোচনাও করতে পারতেছিলাম না। তাই নিজে নিজে দুটূ জিনিষ নিয়ে গবেষনা করলাম। (১) কোনো না কোনোভাবে আমার জানান দেয়া উচিত যে, মিটুল চৌধুরী আমার কি হয়। (২) জানান দেয়ার পর আমাকে ইমিডিয়েটলী লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া যাতে আমাকে নিয়ে গোয়েন্দা বাহিনীর কারো অতিরিক্ত ইন্টারেষ্ট নিতে না হয়। সে মোতাবেক, পরেরদিন আমি আমার ওসিকে বললাম, স্যার, আমার বাড়ি থেকে আমার বিয়ের ব্যাপারে মেয়ে দেখা হয়েছে। আপাতত "এঙ্গেজমেন্ট" করতে হয়েছে কিন্তু বিয়ের বয়স হলে আমরা বিয়ে করবো। আমার ওসি মেজর ইকবাল হাসলেন, কেনো হাসলেন বুঝা গেলো না। শুধু বললেন, ভালোই তো।
আমি সবাইকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে চাই বলে যারা যারা এটা নিয়ে মাতামাতি করতে পারে সেখানে সেখানে একটা করে মিষ্টির প্যাকেট পাঠিয়ে দিলাম যেখানে লেখা ছিল, " মিটুল চৌধুরীর সাথে ক্যাপ্টেন আখতারের এঙ্গেজমেন্টের মিষ্টি"। ব্যাপারটা খুব কাজে লাগলো। মুটামুটি সবাই জানতে পারলো যে, আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে মিটুলের সাথে কিন্তু বিয়ে পরে হবে। আর্মিতে বিয়ের বয়সের আগেও এঙ্গেজমেন্ট করার বিধান আছে। ফলে এটা কোন অপরাধ নয়। এবার আমার ২য় পলিশিতে পদার্পন করার পালা। অর্থাৎ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া। কিভাবে সেটা? ঠিক এর মধ্যে চিটাগাং হিল ট্রেক্সে ডেপুটেশনে যাওয়ার একটা অপসন চলে এলো। আর সেটা চিটাগাং হিল ট্র্যেক্সে বিডিআর এর সাথে সংযুক্তি। ছয় মাসের জন্য সংযুক্তি। আমি জানি এটা খুব রিস্ক কারন চিটাগাং হিলট্র্যেক্স একটা ঝুকিপুর্ন এলাকা যেখানে প্রতিদিন শান্তিবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেই বেচে থাকতে হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ওখানে গেলে আমার লাইফ রিস্ক আছে কিন্তু তাতে লাভ হবে যে, আমি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে পারবো। ফলে নরম্যাল সেনানীবাসে আমাকে নিয়ে আর কেউ মাতামাতি করবে না। আবার যদি না যাই, তাহলেও বিপদ। আমি প্রথম বিপদটাই বেছে নিলাম। এর কারন দুইটা। এক নম্বর কারন হচ্ছে-লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে কিছু টাকাও বাড়তি আসবে যেহেতু ওখানে রিস্ক এলাউন্স পাওয়া যায় আবার খরচও কম। আমার টাকারও দরকার ছিলো। এই উভয় সঙ্কট পরিস্থিতিতে আমি আমার ওসিকে বললাম যে, স্যার আমি বিডিআর এর সাথে সংযুক্তি হতে ইচ্ছুক। ডিভিশনে অনেকেই হিলট্রেক্সে যাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন, সেখানে আমি ইচ্ছুক বিধায় অপ্সনটা পেতে সময় লাগে নাই। আমার অনুমতি মিলে গেলো। আর সেই সুবাদে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখে আমার অফিশিয়াল সংযুক্তি আদেশ জারী হলো। আর আমি এর মাঝে কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে এই নিউ লংকারে ক্যাম্পে যোগ দিয়েছি।
চিটাগাং হিল ট্রেক্সে সচেতন থাকলে হয়তো বেচে যাবো কিন্তু প্লেইন ল্যান্ডে গোয়েন্দারা জোকের মত যেভাবে পিছনে লেগে থাকে তাতে সচেতন থাকলেও বেচে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। তাই হয়তো এই নিউ লংকার বিডিআর ক্যাম্প আমাকে বাচিয়ে দিতে পারে।