আমার বয়স ইতিমধ্যে ৫৯ পার হয়ে গেলো। প্রায় ৫ যুগ। নেহায়েত কম নয়। অন্য কারো জীবনে কি ঘটছে, কি ঘটতে পারতো কিংবা কি কারনে কি ঘটেছে বা ঘটে নাই সে ব্যাপারে না জানলেও আমি আমার জীবনের পুরু ইতিহাসটাই জানি। কোথায় কি কারনে কিভাবে কেনো আমার জীবনে ক্ষনেক্ষনে কিংবা পরিকল্পিতভাবে কি বদল হয়েছে, সব আমি জানি। আমি আমার বাল্যকাল দেখেছি, কৈশোর দেখেছি, যুবককাল দেখেছি, আমি আমার হতাশা দেখেছি, আমার পিছলে পড়ার দৃশ্য দেখেছি, আবার সেই পিচ্ছল পথ থেকে ভাসতে ভাসতে আমার সাফল্যকেও দেখেছি। এই বিস্তর সময়ে আমি আমার আশেপাশে থাকা অনেক মানুষজনও দেখেছি। কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, কেউ হাত উঠিয়ে নিয়েছে, কেউ পাশ কাটিয়ে চলে গেছে, কেউ বা আবার বিনা কারনেই পাশে দাড়িয়েছে। কখনো কারো উপরে খুব রাগ করেছি, কখনো কারো উপরে অনেক অভিমান করেছি, কাউকে কোন কারন ছাড়াই ভালোবেসেছি, কাউকে ভালোবাসতে গিয়েও ভালোবাসতে পারিনি, আবার কারো সাথে অযথাই রাগারাগি করেছি। কেউ আবার আমার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হলেও আমি তাকে অবহেলা করেছি, আবার কারো সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য আমি নিজেই হয়তো অনেক ব্যাকুল হয়েছি কিন্তু তার নাগাল হয়তো আমি পাইই নাই। অনেক বন্ধু পর হয়ে গেছে, অনেক অপরিচিত আবার বন্ধুও হয়েছে। কখনো আমার অজান্তে শত্রু তৈরী করে ফেলেছি, আবার কাউকে কিছু না করেও আমি তাদের কাছের বন্ধু হয়ে গেছি। এককালের সবচেয়ে ভালো কলিগ পরবর্তীতে সবচেয়ে অপ্রিয় হয়ে গেছে সেটাও দেখেছি, আবার যাকে কখনোই প্রিয় মনে করিনি, সেও এক সময় এতো কাছে চলে এসছে যা কখনো ভাবিও নাই।
জীবনের এমনসব অনেক কিছুই ঘটে গেছে আমার এই প্রায় ৫৯ বছরের সময়ে। আমি এখন সেই শৈশবের দুরন্তপনা বালকের মতো ক্ষিপ্র গতিতে দৌড়াই না, এডভেঞ্চারে এখন আর সাহস পাই না, বন্ধু আসরে এখন আর সেই আগের মতো উচ্চস্বরে চেচাই না। এখন কেনো যেনো শুধু নিজেকেই নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কি ঘটে গেলো আমার আশেপাশে, কি করতে পারতাম কারো জন্য, এগুলি আর আমাকে টানে না।
পথে হাটতে হাটতে পথে দাঁড়িয়ে থাকা অনাথ কোনো ভিক্ষুককে এখন আর কটু মন্তব্য করিনা। শুধু ভাবি, আহা রে জীবন। হয়তো তারও কোনো ইতিহাস আছে। হয়তো তারও কোনো পরিবার ছিলো, আজ তার পাশে কেউ নাই। হয়তো বা সেইই সব ছেড়ে ছুড়ে একা বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কোথাও তার কোনো জায়গা নাই এই পথ ছাড়া। এখন তাকেও আর প্রশ্ন করিনা-কেনো সে ভিক্ষা করে, কেনো সে কোনো কাজ বেছে নেয় না।
বাজারে গিয়ে এখন আর কারো সাথে দাম নিয়ে তর্ক করিনা। দাম বেশী মনে হলে ভাবি-থাক না, আমার পোষায় না, আমি বেরিয়ে আসি। হয়তো দোকানদার একটা দাম বলার জন্য অনুরোধ করে, আমি মুচকী হেসে হয়তো বলি-নাহ, পছন্দ হয়নি। বলে বেরিয়ে যাই। ভাবি-কি দরকার তার সাথে আবার দাম নিয়ে ঘাটাঘাটি করা। আবার এমনো হয় যে,-সে হয়তো একটু বেশী দামই বলেছে, তাতে কি? যদি আমার কাছ থেকে পাওয়া একটু বেশী দামে তার নিজের পরিবার আরো একটু সুন্দর হয়, কিংবা তার উঠতি কোনো প্রয়োজন মিটেই যায়, ক্ষতি কি? হয়তো ইচ্ছে করেই মেনে নেই।
একটা সময় ছিলো, ১০ টাকার রিক্সা ভাড়া ১০ টাকা না পাওয়া অবধি হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি, তাও ১০ টাকার বেশী দেবো না বলে পন করেছি। এক রিক্সা থেকে আরেক রিক্সার দামদর করেছি। এখন আমি আর কোনো দামদরও করি না। কি যায় আসে যদি ১০ টাকার ভাড়া সে আমার কাছ থেকে ২০ টাকাই নিলো? সেতো আর কটি টাকা চায় নাই। হতেও তো পারে তার এই অতিরিক্ত টাকাটা আসলেই দরকার। তার মেয়ের জন্য হয়তো একটা স্কুলব্যাগ কিনবে বা অন্য কিছু। আমি আন্দাজ করে একটু বেশিই দেই। যদি দেখি তার মুখে হাসি ফুটেছে, ভাবি-ঠকাইনি, কিন্তু যদি তার মুখে এমনভাব ফুটে উঠে যে, হয়তো আর একটু বেশী দিলে ভালো হতো, আমি দেরী করি না, আরো একটু বাড়িয়েই দেই। তার মুচকী হাসিটা আমার কাছে দরকার। হয়তো এই রিক্সাওয়ালার সাথে আমার দ্বিতীয়বার আর দেখা হবেওনা। না আমি ওর নাম জানি, না সে আমাকে চিনে। কিন্তু ক্ষনিকের এই ছোট মুচকী হাসিটা নেহায়েত কম নয়।
কারো সাথে এখন আমি আর তর্কও করি না। কারো তর্কে আমি জিততেও চাই না। বুঝতে পারি ভুল তর্ক কিন্তু আমি আর আগের মতো সেই তর্কে সরব নই। কারন, কাউকে আমি শোধরিয়ে দিয়ে তার ইথিক্সকে আমি বদলাতে পারবো না। কেউ কারো জন্যই বদলায় না। সবাই নিজের জন্যই একসময় বদলায়। যেমন আমিও বদলে গেছি। তবে আমি আগে যেমন শুধু বক্তা ছিলাম, এখন আমি ভালো শ্রোতা হয়ে গেছি। বলুক না মানুষ তাদের কথা, আমি শুনি, হাসি, কখনো কখনো চুপ থাকি, কখনো কখনো আবার উসাদ মনে এটাও ভাবি- বলুক সে তার নিজের কথা, অন্তত আমার মতো একজন শ্রোতা তো আছে যে তার কথা শুনছে। তাদের গল্পগুলিতে হয়তো অনেক স্মৃতি আছে যা আমার কোনো কাজেই লাগবে না, তারপরেও তাদের একাকীত্ব জীবনের সেই পুরানো কিছু কথা না হয় আমিই শুনলাম। তার বুকটা তো কিছুটা হলেও হালকা হলো, কিছুক্ষন সময়ের জন্য হয়তো সে আবার ফিরে যায় তার সেই পুরানো কোন দিনে, পুরানো কোনো হাসি দুঃখ মাখা জীবনে।
কেউ আমাকে মুল্যায়ন করুক বা না করুক, এখন এগুলি নিয়ে আর বেশী মাথা ঘামাই না। অবজ্ঞা করলেও আমি সেখানে তাকে অবজ্ঞা করি না। আস্তে করে হয়তো চুপিসারে সরে যাই। কোনো কিছুই বা কারো কোন মুল্যায়নে বা অবমুল্যায়নে আমার কোনো কিছুই পরিবর্তন হবে না। ইগো থেকে বেড়িয়ে যাই। প্রানভরে সবার প্রসংসা করি। কাউকে প্রসংসা করলে আমার তো কোন ক্ষতি নাই। অন্তত তাকে আমি কষ্ট দেইনি এটা ভেবেই সেটা করি। হয়তো তাকে কেউ প্রসংসাও করেনি, আমি না হয় করলাম। কি ক্ষতি?
কাউকে আমি টাকা ধার দিয়েছি, আমি কাউকে সেটার জন্য প্রতিনিয়ত চাপে রাখি না। এটা তার দায়িত্ব আমাকে সেটা বুঝিয়ে দেয়া। যদি ভালো মানুষ হয়, যদি দায়িত্তশীল হয়, যদি উপকারের কথা মনে রাখে, সে ফিরে আসবে অতি বিনয়ের সাথে। কিন্তু আমি ধরে নেই-যা দিলাম, তা দিয়েই দিলাম। যদি কখনো তা ফিরে আসে, সেটা আমারই ছিলো। যদি ফিরে না আসে, অন্তত আমি বুঝলাম, উপকার করার লিমিট হয়তো সেখানেই শেষ। কিন্তু অপদস্ত করি না।
এই দুনিয়ায় কতো মানুষ যে আছে যারা একা থাকে, যারা ভালোবাসা দিতে গিয়েও দিতে পারেনি, তাদেরকে ভালোবাসা দিতে চেয়েও অনেকে তা দিতেও পারেনি। তার কাছে হয়তো অন্য কোনো কিছু আরো প্রিয়, আর বেশী দামী। কেউ কারো ভিতরের কথা জানে না। আজিবন বলে গেলেও তাদের ভিতরের কষ্ট, সুখ, আহলাদ কোন কিছুই অন্য কাউকে বুঝানো যায় না। হাসিটা ঠটে থাকলেও সুখের অনুভুতিটা থাকে অন্তর, দুঃখের, কষ্টের বেদনার পানিটা চোখের জলে দেখা গেলেও কষ্টের অনুভুতিটা থাকে মনের ভিতরে। সেগুলি দেখানো যায় না, সেগুলি কাউকে বুঝানোও যায় না। ভাষাই যদি হতো একমাত্র প্রকাশের মাধ্যম তাহলে বোবার কথা, প্রানিদের কথা কোনো মানুষ কখনোই বুঝতে পারতো না। পরিবর্তনও একটা ভাষা।
আমি আমার জন্যই বাচি, এক সময় আমি বাচতে চেয়েছি আমার পরিবারের জন্য, আমার সন্তানের জন্য, আমার সমাজের জন্য, আমার দেশের জন্য। কিন্তু এখন আমি আমুল পরিবর্তীত এক মানুষ। আমি আমার জন্যই বাচি। প্রতিটি দিনকে জীবনের শেষ দিন মনে করে বাঁচি।
হয়তো একদিন সেই দিনটা খুব কাছে যখন আমার জন্যেও আর বাচার দরকার হবে না। পৃথিবী বড্ড সুন্দর, এর গাছপালা সুন্দর, মেঘলা আকাশ সুন্দর, ঝড়ো হাওয়া সুন্দর, চাঁদ সুন্দর, শীত সুন্দর, পাখীদের কিচির মিচির শব্দ সুন্দর, এমন কি কাল বৈশাখী ঝড় ও সুন্দর। কিন্তু একদিন এই সব ছেড়ে আমাকে চলেই যেতে হবে। তাহলে কার সাথে আমি কি নিয়ে তর্ক, কি নিয়ে ইগো, কি নিয়ে এতো বাহাদুরী কিংবা অবজ্ঞা করবো?
আমি অনেক বদলে গেছি।