২৪/০২/২০২৩-রুলস বেজড অর্ডার

গত কিছুদিন যাবত আমি রুলস বেজড অর্ডার নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে একটা ব্যাপার মুটামুটি পরিষ্কার হলো যে, এই "রুলস বেজড অর্ডার" আসলে কোথাও আইনের বই বা লিখিত কোনো দলিল নাই এবং এটা কারা অনুমোদন করেছে সেটাও কেউ জানে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে-বর্তমানে বড় বড় পলিটিশিয়ানরা কথায় কথায় ‘রুলস বেজড অর্ডার’ কথাটা উচ্চারন করেন। কিন্তু তাদেরও এই রুলস বেজড অর্ডার সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারনা আছে বলে আমার মনে হয় না। আর যদি পরিষ্কার ধারনা থেকে থাকে তাহলে আরেকটা জিনিষ খুব পরিষ্কার যে, সবাই যার যার সুবিধার জন্য এবং ফায়দা লুটার জন্য এই "রুলস বেজড অর্ডার" সমর্থন করেন। যেমন, চায়নার এবং আমেরিকা উভয়েরই তাইওয়ানের ব্যাপারে, আমেরিকার ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্থান, প্যালেস্টাইন কিংবা ইসরায়েলের ব্যাপারে, রাশিয়ার জর্জিয়া কিংবা মালদোভার ব্যাপারে, ফ্রান্স এর আফ্রিকান দেশগুলির ব্যাপারে এই "রুলস বেজড অর্ডার" মানতে খুব পছন্দ করে। আসলে এই "রুলস বেজড অর্ডার" আর কিছুই না, এটা যার যার সার্থে তারা নিজেদের মতো করে কিছু আইন বানিয়ে সেটা অন্যকে মানতে বাধ্য করে। সেটা যদি তাদের নিজের দেশের আইনের বিপক্ষেও যায়, তাতেও মানানোর চেষ্টা চলতে থাকে। যেসব দেশ নিজেরা সাবলম্বি নয়, যারা বিগ পাওয়ারের উপর, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের উপর, আইএমএফ এর উপর কিংবা বৈদেশিক লোন বা ডোনেশনের উপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য ব্যাপারটা খুবই অসহনীয়। তারা না মানতে পারে, কারন না মানলে সাহাজ্য বন্ধ হয়ে যাবে আবার মানলে দেখা যায় যে, এটা নীতিবহির্ভুত হয়ে যায়। ফলে নিজেদের সার্থেই ছোট ছোট দেশগুলি চুপ থাকে। আর এই চুপ থাকার মানে এই নয় যে, তারা সাপোর্ট করছে, আবার এই চুপ থাকার কারনে যারা এগুলি প্রয়োগ করে তারা ভাবে, কেউ তো আমাকে বাধা দিচ্ছে না।

কিন্তু যখন এই "রুলস বেজড অর্ডার" বড় বড় বিগ পাওয়ারের মধ্যে সংঘাত ঘটে তখন হয় সমস্যা। যেমন এখন হচ্ছে, রাশিয়া-চীন-আমেরিকা-ইউরোপ ঘিরে। তাইওয়ানকে ঘিরে চীন মনে করছে ‘রুলস বেজড অর্ডার’ এর মাধ্যমে তাইওয়ানের উপর সে যা খুশী করতে পারে, আবার আমেরিকাও ভাবে সেই বা নিয়ন্ত্রন ছাড়বে কেনো। ইউএস এর লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্থানে নিজেদের ইচ্ছায় রিজিম পরিবর্তনে কিংবা প্যালেষ্টাইনকে ইসরাইলের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া অথবা ইউক্রেনে এক নাগাড়ে ৮ বছর এক তরফা গোলাগুলিতে প্রতিষ্টিত সরকারকে উতখাত করে নিজের পছন্দমত সরকার গড়ে তোলার মত যে কোনো অজুহাতে তাদেরকে কব্জা করার নিমিত্তে অথবা তথাকথিত ডেমোক্রেটিক ইস্যু বা নিরাপত্তার অজুহাতে তাদেরকে বশে আনা, জর্জিয়া, মালদোভা, কিংবা ইউক্রেনকে ধরে রাখার নামে তাদেরকে রাশিয়ার ডি-মেলিটারাইজড করা, আফ্রিকায় বিভিন্ন দেশ যেমন বারকিনু ফাসো, বা মালি কিংবা নাইজেরিয়ায় সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে ফ্রান্সের আধিপত্য বিস্তার করার সবচেয়ে ভালো আইনটা হচ্ছে এই অলিখিত এবং অন-অনুমোদিত এই “রুলস বেজড অর্ডার”।

এটা একটা “মিথ”।

সবাই কোনো না কোনো এরেনায় আল্টিমেট কন্ট্রোল চায়। যখনই একই এলাকায় একের অধিক কারো নিয়ন্ত্রন রাখার দাবী না চলে আসে, ততোক্ষন এই “রুলস বেজড অর্ডারে” অন্যজন হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু একের অধিক হলেই টক্কর। এটা সবচেয়ে বেশী কার্যকরী হয়েছে যখন মাল্টিপোলার সিস্টেম ভেংগে ১৯৯০ সালে ইউনিপোলার সিস্টেমে দুনিয়াটা জড়িয়ে গেছে। তখন ইউনিপোলার নেতাদেরকে বাধা দেয়ার মতো কোনো শক্তিই অবশিষ্ট ছিলো না। তারা মনে করে যে, সব আইনের উর্ধে তারা। তারা যা বলবে, যা ভাববে, যা করবে সেটাই “রুলস বেজড অর্ডার”। এই রুলস বেজড অর্ডারের মাধ্যমে ইউনিপোলার নেতারা আন্তর্জাতিক সব সিস্টেম (ওয়ার্ড ব্যাংক, আইএমএফ, ইউএন, রিজার্ভ ব্যাংক, ওএসসিই, কিংবা মানবাধিকার সংস্থা ইত্যাদি) যেনো সব তাদের। যাকে খুশী আক্রমন, যাকে খুশী নিষেধাজ্ঞা, যাকে খুশী একঘরে করে রাখা ইত্যাদি এই রুলস বেজড অর্ডারের মাধ্যমে করা যায়।

মজার ব্যাপার হলো, এই রুলস বেজড অর্ডার কোথাও বই আকারে লিপিবদ্ধ নাই। না এর অনুমোদন নেয়া লাগে। সিচুয়েশন বুঝে কংগ্রেস কিংবা প্রেসিডেনশিয়াল আদেশেই নতুন ‘রুলস বেজড অর্ডার’ জানিয়ে দিলেই কাজ শেষ। রুলস বেজড অর্ডারের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল সিস্টেমকে বুড়ো আংগুল দেখানো খুব সোজা। এ পরিপ্রেক্ষিতে কিম পিটারসন (ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিষ্ট) নিউ এজ পত্রিকায় গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ এ তার লেখায় তিনি লিখেছেন-

...” ইউএস আইসিসি (ইন্টার ন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) কে রিকগনাইজ করে না। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ভেটো ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় ইসরায়েল করত্রিক সংঘটিত রেসিষ্ট কার্যকলাপ সমর্থন, নিকারাগোয়ায় ওয়াটার মাইনিং এর ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড কোর্ট রুলিং এর আওতায় দোষি সাবস্থ্য হবার পরেও তা ইগনোর করা, এংলো ইউরোপিয়ান জাপানিজ সাউথ কোরিয়ান জোট বিভিন্ন ভায়োলেশনে জড়িত থাকার পরে আন্তর্জাতিক বিচারে দোষি হওয়া সত্তেও তাদেরকে এই রুলস বেজড অর্ডারের আওতায় পরিশুদ্ধ করা, সিরিয়া দখল, আন প্রভোকড ইরাক আক্রমন, ৭০ বছর যাবত কিউবাকে এক ঘরে করে রাখা ইত্যাদি সব এই রুলস বেজড অর্ডারের দ্বারা জায়েজ। “

অন্যদিকে ফ্রান্স, জার্মানী, ইউকে কিংবা ইউরোপিয়ান দেশগুলির এমন ভগ্ন দশা যে, তারা এককালের মোড়ল অথচ তাদের আর সেই শক্তি নাই যাতে নিজেরা না মানলেও অন্যকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাখতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য, আরব দেশগুলি কিংবা দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলিতে তো আজীবন সংঘাত লেগেই আছে, হয় বাইলেটারেল, না হয় জিওপলিটিক্যাল অথবা টোটালেটেরিয়ান সরকারের চর্চা। ফলে ক্ষমতা হারাতে পারে, কিংবা কোনো প্রয়োজনে এসব বিগ পাওয়ারের সাহাজ্য লাগতে পারে ভেবে এরাও এসব বিগ পাওয়ারের বিরুদ্ধে বা রুলস বেজড অর্ডারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। ফলে বাধা না দিয়ে “জি হুজুর” থাকলেই যেনো “কুলও রক্ষা পায় আবার মোড়ল গিড়িও থাকে” এমন একটা পরিস্থিতিতে তাদের বসবাস।

৩য় বিশ্বযুদ্ধ না লাগলে সম্ভবত এবার এই "রুলস বেজড অর্ডার", ইউনিপোলারিটি, নিউ কলোনিয়ালিজম কন্সেপ্ট ইত্যাদির ইতি হবার সম্ভাবনা।

পৃথিবী আবার শান্ত হবে। এটাই প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *