মানুষ সম্ভবত তার বিলুপ্তির সীমায় পদার্পন করেছে ইতিমধ্যে। ভয়ংকর কথা বলে মনে হলেও এটা প্রাকৃতিক নিয়মের একটা চলমান অংশ। এর আগেও এই বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে, আর সেটা একাবার নয়, পরপর পাচবার।
বিজ্ঞানীরা বলেন আমাদের এই পৃথিবীর বয়স প্রায় সাড়ে চার বিলিয়নের মতো। এই সাড়ে চার বিলিয়ন বছরে পৃথিবীর প্রায় ৭৫% প্রানী সমুহের বিলুপ্ত হয়েছে বেশ কয়েকবার যাকে বলা হয় “মাস এক্সিঙ্কশন”। মাস এক্সিঙ্কশন তাকেই বলে যখন কোনো স্থান থেকে ৭৫% প্রজাতী (গাছপালা, জীবজন্তু, কিংবা অদৃশ্য কোনো প্রানীসকলসহ অনেক অনুজীব) মাস এক্সিঙ্কশন হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। যার মধ্যে রয়েছে ডাইনোসর এবং আরো অনেক প্রানী।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, ন্যাচারাল প্রক্রিয়ায় সমস্ত জীবজন্তু, গাছপালা, জীবানু, অনুজীব সবাই একটা জীবন মরনের মধ্যে থাকে। কিছু বিলুপ্ত হয়, আবার কিছু নতুন জন্ম হয়। এভাবেই ন্যাচারাল ব্যালেন্স হয়। কিন্তু গত ৪০/৫০ বছর যাবত এই বিলুপ্তির ঘাটতি যেমন ম্যামাল, ব্যাক্টেরিয়া, প্ল্যান্টস, অনুজীব ইত্যাদি ন্যাচারাল প্রক্রিয়ায় হচ্ছে না, হচ্ছে আর্টিফিশিয়ালভাবে, আর সেটা হচ্ছে প্রায় দশ হাজার গুন গতিতে।
তাহলে এর কারন কি?
এর একটাই কারন। মানুষ।
মানুষ মনে করে এই পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য, অন্য কারো জন্যে নয়। কিন্তু এটা শতভাগ ভুল। পৃথিবীর মাটির গভীরে যে ব্যাক্টেরিয়া আছে তার থেকে শুরু করে আকাশে যারা ভেসে বেড়ায়, সমুদ্রের তলদেশে যেসব নাম না জানা প্রানীকুল অনুজীব ইত্যাদি আছে, সবার জন্য এই পৃথিবী। কিন্তু মানুষ সেটা ভাবে না। ফলে এই মুহুর্তে মানুষ একা পৃথিবীর ৭০% ল্যান্ড এবং ব্যবহারযোগ্য পানী ব্যবহার করছে। বাকী ৩০% ল্যান্ড আর ৩০% ফ্রেস পানি বাকী যতো গাছপালা, উদ্ভিদ, অন্যান্য প্রানীসকলসহ ব্যাক্টেরিয়া, জীবানু, নাম না জানা প্রানীদের জন্য রয়েছে যা নিতান্ততই অপ্রতুল।
আর এই ঘটনাটা ঘটতে শুরু করেছে ১৯৭০ সালের পর থেকে। ১৯৭০ সাল কেনো বলছি? কারন
১৯৭০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে যে, আমাদের পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিলো প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন। ফলে এই সাড়ে তিন বিলিয়ন মানুষের জন্য যে বসবাস যোগ্য ল্যান্ড এবং ফ্রেস পানি দরকার ছিলো তা ১৯৭০ সালেই তার কোটা পরিপুর্ন হয়ে যায়। ফলে ১৯৭০ সালের পর যে হারে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে তাতে ইউজেবল ল্যান্ড এবং ফ্রেস পানির দখলও মানুষের বেড়েছে, বেড়েছে আর্বানাইজেশন, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেন ইত্যাদি। অর্থাৎ অন্যান্য প্রানী, জীববজন্তু, গাছপালা এদের জন্য পর্যাপ্ত ল্যান্ড বা ফ্রেস পানির ভাগ কমে যাচ্ছে এবং গেছে। এই পপুলেশন বোম্ব এখন ধীরে ধীরে আরো বেড়েই চলছে বিধায় মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীবকুলের একটা বিলুপ্তি চোখে ধরা পড়ছে। উদাহরন দেই-
আগে মানুষ ন্যাচারাল পরিবেশ ভোগ করতো, তাদের বাড়ির পাশে গাছপালা থাকতো, সেই গাছপালায় অনেক পাখীর বাসা থাকতো, বাড়ির পাশে ঝোপ জংগলে হয়তো পিপড়া, সাপ, কিংবা মাটির নীচে অনেক কেচো, শামুক, জীবানু ব্যাক্টেরিয়া, আরো ইত্যাদির থাকার ব্যাপারটা চোখে পড়ত যা এখন কংক্রিটের কারনে, মানুষের আর্বানাইজেশনের কারনে, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কারনে ধীরে ধীরে এসব জীবজন্তুর আর থাকার কোনো জায়গা রইলো না। বাড়ির পাশে হয়তো ১০০ গজ দূরে যে সাপটা বাস করতো তার আর কোথাও থাকার জায়গা নাই, বংশবৃদ্ধির কোনো উপায় নাই, পাখীরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে যেতে এক সময় তারাও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, অনেক প্রজাতীকে এখন আর চোখেও দেখা যায় না। অনেক জলজ মাছের এখন শুধু নাম পাওয়া যায়, বাস্তবে তারা প্রায় উধাও হয়ে গেছে।
১৯৭০ সালে যেখানে মানুষ ছিলো সাড়ে তিন বিলিয়ন, এখন সেটা দাড়িয়েছে আট বিলিয়নে। অর্থাৎ প্রায় তিনগুন। হাজার হাজার বছরে যতোটা না এই বৃদ্ধির হার বেড়েছিলো, সেটা এই ১৯৭০ এর পর থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুন বেশী, প্রায় দশ হাজার গুনের থেকেও বেশী। এর ফলে যেমন বনের অনেক প্রকারের ভাল্লুক, সমুদ্রের স্যালমন ফিস, কিংবা ছোট ছোট প্রজাতী, বনের বহু প্রজাতীর গাছপালা এখন আর চোখে পড়ে না। তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র একটা অঞ্চলের কথা বলি-ল্যাটিন আমেরিকার এমাজন ফরেষ্ট যাকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়, সেখানে এখন ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কারনে হাজার হাজার বনাঞ্চল, নদীপথ সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাহলে এই অঞ্চলের প্রজাতিগুলি গেলো কই? জলজ প্রানীগুলি গেলো কই? সেটা এখন আর ফুসফুস হিসাবে কাজ করছে না।
সমদ্রের কথা যদি বলি-দেখবেন পৃথিবীর ডাম্পিং এরিয়া এখন সমুদ্র। এই ডাম্পিং এর কারনে সেখানকার জলজ প্রানীদেরকে আমরা প্রায় গলা টীপে মেরে ফেলছি, তাদের বাসস্থানকে এতোটাই অসহনীয় করে ফেলছি যে, তাদের নিজেরা যেমন বেচে থাকতে পারছে না, নতুন প্রজন্মও আর জন্ম নিচ্ছে না। আগে যেখানে এক লক্ষ জলজ প্রানী নতুন প্রজন্ম এর জন্ম দিতো সেখানে হয়তো এখন দশ হাজার জলজ প্রানীর বসবাস এবং তাদের দ্বারা জন্মদানের প্রজন্মও কমে যাচ্ছে সেই একই হারে। আর এই নতুন প্রজন্মও আবার খুব দ্রুত পরিবেশ বিপর্য্যের কারনে আরেক প্রজন্ম দেয়ার আগেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এবং এক সময় সবাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
অথচ পৃথিবীটা ওদেরও। শুধু মানুষের জন্য এই পৃথিবীটা না। এই পৃথিবী অনুজীব থেকে শুরু করে সমস্ত জীব জন্তু, গাছ পালা, সবার। খুব বেশী সময় দূরে নয় যেখানে আমরা সবাই আমাদের কারনেই বিলুপ্ত হবো যাকে আমরা মাস এক্সিঙ্কশন বলছি।