নির্মম সত্য যখন কেউ বুঝাতে পারে না, অথবা বুঝতে চায় না, আর এই সত্য না বুঝানোর কারনে যখন কিছু মানুশ একাধারে নিষ্পেষিত হতে থাকে, তখন তারা নিজেরা বাচার জন্যে এমন কিছু পথ অবলম্বন করে যা সত্যের থেকে অনেক দূরে। আর এই সত্য যখন নিষ্পেষিত মানুষগন সবাই জেনেও গোপন রাখে, তখন যা হবার তাইই হয়- আর সেটা হচ্ছে বিপর্যয়। এই বিপর্যয় সবসময় ঘটে না। কিন্তু যখন ঘটে যাবে, আর যখন সত্যটা প্রকাশ্যে আসে তখন যারা এই সত্যটাকে আমলে নেন নাই অথচ নেওয়ার দরকার ছিলো, তখন তারাই উর্ধতন কর্মকর্তা বা পরিস্থিতির জন্য দায়ী হয়ে একপ্রকার অপরাধীই সেজে থাকেন। আর যখন নিজেরা তাদের অগোচরের কাহিনী একে একে প্রকাশ করতে থাকেন, তখন আমাদের সবার চক্ষু চরগগাছে রুপান্তরীত না হলেও বুকভরা কষ্টে অনেক জীবনকে বলি দেই। আজ আমার জীবনের প্রথম পেট্রোল করতে গিয়ে এটাই চোখে ধরা পড়লো।
আমরা সেই ভোর ৪টায় বেরিয়ে পড়েছিলাম পেট্রোল করার জন্য। আমাদের টার্গেট ছিল ব্যাটালিয়ান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের কোনো এক গ্রামে যাওয়া আর যাওয়ার পথে রাস্তা ঘাটের কি পরিস্থিতি তা উপলব্ধি করা। আমাদের সাথে ৪৪ ইষ্ট বেংগলের কিছু ঝানু হাবিলদার আর একজন জেসিও ছিলো। আমি পেট্রোল কমান্ডার হিসাবে ছিলাম।
পেট্রোল নিয়ে বের হতে না হতেই মুশল্ধারে বৃষ্টি নেমে এলো। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা ভিজে চুপসে গেলাম। যেহেতূ আজই আমার প্রথম পেট্রোল, ফলে আমি বই মোতাবেক, পুস্তক মোতাবেক আর সিনিয়রদের উপদেশ মোতাবেক প্রতিটি পেট্রোল ড্রিল অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করছিলাম। কখনো স্টকিং, কখনো হল্ট, আবার কখনো কখনো খুব সন্তর্পণে চলা ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ দেই নাই। কিন্তু একটা জিনিশ আমি লক্ষ্য করলাম যে, আমার এই একনিষ্ঠতা আমার অন্যান্য পেট্রোল সদস্যরা মেনে নিতে পারছিলো না। আমরা হাটতে হাটতে প্রায় একটা ছড়ার পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম, তখন বেলা উঠে গেছে। ছড়া পার হবার পুস্তকীয় নির্দেশনা মোতাবেক আমি যখন অন্যান্য সবাইকে নির্দেশনা দিচ্ছিলাম, বুঝলাম, এটা তাদের একেবারেই পছন্দ না।
ছরাটা তারপরেও পার হলাম আমার পুস্তকীয় ধারায়। ছরা পার হবার পর আমাদের যে উপঅধিনায়ক জেসিও আছেন, তিনি আমার কাছে এসে বললেন, স্যার আমরা তো সকালে নাস্তা করি নাই। ওইখানে একটা স্কুল ঘরের মতো ঘর আছে। প্রয়োজনীয় প্রোটেক্সন নিয়ে আমরা সবাই নাস্তাটা করে ফেলি। ভাবলাম, যুক্তি আছে। এই পাহাড়িয়া এলাকায় কতোক্ষন আর নাস্তা না করে হাটা যায়?
আমিও তাদের সাথে নাস্তা করতে বসলাম। এবার জেসিও সাহেব বললেন, স্যার, আপনি আজ নতুন পেট্রোল করতে এসেছেন। একটা কথা বলতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন, আর যদি ব্যাপারটা গোপন রাখেন। বললাম, বলেন।
জেসিও বল্লো, যে, স্যার এ রকম নিয়ম মেনে প্রতিদিন পেট্রোল করা যায় না। এই যে আজকে আমরা সবাই পেট্রোল করতে বেরিয়েছি, খোদা না করুক যদি কোথাও কোনো অঘটন ঘটে, আবারো দিন নাই রাত নাই, খাওয়া নাই, নাওয়া নাই, এই আমাদেরকেই আবার অপারেশনে আসতে হবে। এই এক কাপড়েই থাকতে হবে দিনের পর দিন। তাই আমরা জানি কিভাবে শরীরকে ঠিক রাখা যায়। মানে স্যার, আমরা এখানেই থাকবো, আর কোথাও যাবো না। আমাদের যেখানে যাওয়ার দরকার টার্গেট অনুযায়ী, সেখানে যেতে আরো ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। আবার সেখান থেকে ব্যাটালিয়ানে যেতে সময় লাগবে প্রায় আরো ৪ ঘন্টার মতো। মোট এই ৮ ঘন্টা এক নাগাড়ে হাটাহাটির পর যদি জরুরী কোনো অপারেশনে যেতে হয়, আমরা কি পারবো দিনের পর দিন এভাবে শারীরিকভাবে সাপোর্ট দিতে? তাই, যদি ব্যাপারটা গোপন রাখেন, আমরা এখান থেকে প্রতি আধা ঘন্টা পর পর ব্যাটালিয়ানে রিপোর্ট দেবো যে, আমরা কোথায় আছি। আর সেটা ম্যাপ দেখে দেখেই দিবো।
অবাক হলাম। বলে কি?
কিন্তু এটাই হলো নির্মম সত্য। মনে মনে ভাবলাম, নিজাম স্যার তো এই কারনেই মারা গেছেন। কারন দিনের পর দিন ওইসব এলাকায় না যাওয়ার কারনে শান্তিবাহিনী মনে করেছে যে, এসব এলাকায় আর্মির কেহ আসে না। তারা নিজের সময়মতো আদর্শ ফাদ পাতার সময় পেয়েছিলো আর অপেক্ষায় ছিল কোনো একদিন যদি আর্মির টহল এখানে আসে, সেদিন হবে প্রতিশোধের চরম মুল্য। আর এটাই হয়েছিলো নিজাম স্যারের বেলায়।
একবার ভেবেছিলাম, এই নির্মম সত্যটা আমি সিও সাহেবকে জানাই। আবার ভাবলাম, এটা কি শুধু আমিই জানি নাকি ইউনিটের অন্যান্য সবাই জানে খালি সিও ছাড়া? অথবা এমনো তো হতে পারে, সিও সাহেব নিজেও জানেন, কিন্তু তিনিও চুপ করেই আছেন? হয়তো জানে না খালি সেই ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার।
এভাবেই আমি আমার প্রায় প্রতিটা পেট্রোল করে সময় পার করলাম ওরিয়েন্তেশনের পিরিয়ড।