যদিও মিটুলের চিকিৎসার জন্য এই দিল্লীতে আসা কিন্তু ইন্ডিয়ায় ঘুরে বেড়ানোর অনেক জায়গা থাকায় এই লোভটা কখনোই সামলাইতে পারি না যে আশেপাশের কিছু বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান ভিজিট না করা। হোটেলের পাশেই অনেক গুলি ট্রাভেল এজেন্সী আছে। সন্ধ্যায় খবর নিলাম কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। দেখলাম, আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে সবাই একটা জিনিষই সাজেশন দিচ্ছে যে, হিন্দুদের তীর্থ স্থান হৃষীকেশ এবং হরিদ্দারে যাওয়া।
শনিবার সকাল, খুব শান্ত সকাল। ছুটির দিন বলে হয়তো ভীড় একটু কম। কিন্তু আসলে এখানে এতো গরম পড়েছে যে, মানুষ বের হতেই চায় না। মুখে তাপ লাগে যখন গাড়ির কাচ খোলা হয়। আমরা একটা এসি গাড়ি ভাড়া করলাম, যাত্রী মোট ৫ জন। আমি মিটুল, সাবিহা আপা, সাবিহা আপার মেয়ে এবং তার জামাই নাঈম। খুব ভদ্র একটা ছেলে, দেখতেও সুন্দর। দিল্লীর হোটেল থেকে প্রায় ৪/৫ ঘন্টার জার্নী। পথে পথে অনেক বার থেমেছি অনেক গুলি জায়গায়।
পাজারগঞ্জ থেকে গাজিয়াবাদ হয়ে ফরিদ নগর- আমিনাগর- মনসুরপুর হয়ে মুজাফফর নগর দিয়ে যেতে হয়। হরিদ্দারের কাছাকাছি গেলে বাহাদারাবাদ হয়ে সেলি পুর হয়ে জালাপুর । জালাপুর থেকে খুব বেশী দূর নয় হরিদ্বার। হরিদ্দারের আশেপাশে প্রচুর পরিমানে মন্দির আছে আর আছে কয়েক শত পরিমান ছোট ছোট আবাসিক টাইপের হোটেল। সম্ভবত যারা এখানে আসে, পরিবার পরিজন নিয়েই আসেন, তাই কয়েকদিন থাকার জন্য আশেপাশের মানুষগুলি একটা আবাসিক হোটেলের মতো করে তাদের কিছু ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি ঘর ভাড়ায় দিয়ে থাকেন। লাল মন্দির, উম মন্দির, আর অনেক আশ্রম আছে এখানে।
আমরা যখন হরিদ্বার পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় সারে বারোটা। প্রচুর ট্রাফিক, পুলিশের হিম শিম খেতে হচ্ছে এই ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে। আমরা গাড়ি কোনো একটা ওপেন স্পেসে রেখে বেশ কিছুদুর হেটে যেতে হলো। এতোটাই রোদ আর গরম ছিলো যে, আমরা তাতক্ষনিকভাবেই সবাই একটা করে ছাতা কিনতে হলো। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে, বাংলাদেশের মানুষের মতোই ইন্ডিয়ার এই এলাকার মানুষগুলি মানুষের চাহিদার উপরে পন্যের মুলয় আপ ডাউন করে। যেটা কোনোভাবেই উচিত না। একেকটা ছাতা আমরা কিনলাম তার ফেস ভ্যালু থেকে প্রায় তিন গুন দামে। উপায় ছিলো না, সুতরাং কিনতেই হলো। আমরা হিন্দুরা যেখানে গংগা স্নান করে সেখে হেটে হেটেই এলাম। মাঝে একতা বিশাল পায়ে চলার ব্রিজ তবে রিক্সাও এর উপর দিয়ে যাতায়ত করে। যদি গাড়ি পার হতে হয় ব্রীজের সেই ধারন ক্ষমতাও আছে কিন্তু ব্রীজের এই পারে গাড়ি রাখার খুব একটা পার্কিং স্থান নাই বিধায় বেশীর ভাগ গাড়ি সাধারনত ব্রীজ পার হয় না।
অসম্ভব মানুষের ভীর। গরু ছাগল, মানুষ, ছেলে মেয়ে বুড়া বুড়ি সবাই গঙ্গার পানিতে যে যার মতো করে স্নান করছে। হাজারো পশারীর দোকান আশেপাশে। কেউ আবার প্রসাদ নিয়ে বসে আছে, কেউ সেটা কিনে গংগা দেবতার জন্যে পানিতে নিক্ষেপ করছে যদি দেবতা তার উপর সন্তুষ্ঠ হন এই ভেবে। মানুষের বিশ্বাস এমন একটা বস্তু যার জন্যে কোনো প্ল্যাটফর্ম লাগে না যদি হয় সেটা কোনো ধর্মের উপরে বিশ্বাস। কেউ দেবতাকে দেখেন নাই কিন্তু সবার অন্তরে যার যার মতো করে দেবতা বাস করেন। কারো সাস্থের জন্য প্রার্থনা, কারো রোগ মুক্তির প্রার্থনা, কারো ধন সম্পদের জন্য প্রার্থনা, কেউ আবার কোনো এক নাম না জানা মনের অস্থরতা থেকে মুক্তির প্রার্থনা করছে। যখ কেউ পানি ডুব দিচ্ছেন, দেখে বুঝা যায় যেনো এই মাত্র তিনি একেবারে নিষ্পাপ হয়ে পানির উপরে উঠলেন যেনো। তিনি কতোতা নিষ্পাপ হলেন আর কতোটা হলেন না এতা কোনো মানদন্দ দিয়ে মাপা যাবে না কিন্তু প্রত্যেকের মনের ভিতরে ডুব দিয়ে উঠার পর যে তৃপ্তি তা দেখে বুঝা যায় তার মনের সুখ আর খুসির অবস্থান। আমার বউ হরদ্দারের চারিদিকে ঘুরে দেখার ইচ্ছা পোষন করলো। চারিদিক দেখার জন্য আমাকে আবার মেইন রাস্তা ধরে অন্য প্রান্তে যেতে হবে। সাবিহা আপা গেলেন না। আমরাই গেলাম। একটা বিশাল মাঠ যার চারিদিকে অনেক দেবতা দাঁড়িয়ে আছেন কেউ ঘোরার উপর, কেউ ধনুক নিয়ে আবার কেউ প্রার্থনার ভংগিতে। কিছু অলস যুবক কোন এক গাছে নীচে বসে হয়তো ফেসবুক টিপছেন। কেউ আবার গাজার আসরে মগ্ন।
এই জায়গার আরেকটি বৈশিষ্ঠ হলো যে, গংগার পানিকে উৎস করে ভারত সরকার বড় একটা জলবিদ্যুত কেন্দ্র তৈরী করেছেন। পানির স্রোত অনেক। কেউ কেউ আবার এই পানির স্রোতকেই দেবতার শক্তি মনে করে মাঝ নদীতে সাতরে গিয়ে স্রোতকে আলিংগন করছে। সাধারনত অল্প বয়সী যুবকেরাই এটা করছে। পুন্য স্নানের জন্য পুরু হরিদ্দারের ঘাট গুলিতে সিড়ি দেয়া যাতে লোকজন বসে প্রসাদ দিতে পারে, শরীরে পানি দিতে পারে এবং খুব আরাম করে পানিতে নামতেও পারেন। জল থেকে উঠেই অনেকে আবার কোলাকুলিও করছেন যেমনটা আমরা করি কন ঈদের নামাজের পর মুসল্লীরা। এই গংগার ধারেই এতো বেশী দোকান যে এটা প্রায় আমাদের দেশের গুলিস্থানের মতো। খাবারের দোকান, পসারীর দোকান, ফল ফুলের দোকান, প্রাসাদ বিক্রির দোকান, ডোসার দোকান, কি নাই এখানে। আগরবাতির গন্ধে পুরু এলাকাটা যেনো কেমন স্যাতস্যাতে হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় কিন্তু এখানকার মানুষেরা এই আগর বাতীর গন্ধেই হয়তো ভগবানকে খুজে পান। প্রায় ঘন্টা দেড়েক থাকার পর আবার আমরা আমাদের দিল্লীর হোতেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ক্ষুধাও লেগেছে। রাস্তার ধারে প্রচুর পরিমানে আখের রস বিক্রি করে এমন সব মানুষ আখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা নেমে সবাই আখের রস খেলাম। জুস ও পাওয়া যায়, আপেলের, অরঞ্জের ইত্যাদির। তাটকা জুস, খেতে খারাপ লাগে না। একটা কথা না বললেই নয় যে, এখানে যদিও তাপমাত্রা প্রায় ৪৫/৪৬ ডিগ্রী কিন্তু হিউমিডিটি কম থাকায় শরীর ঘেমে যায় না।
একটা ভালো রেষ্টুরেন্ট খুজতেছিলাম দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। প্রায় আরো ৩০/৪০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটা চমৎকার রেষতুরেন্ট পেলাম, ফুল এসি করা। খাবারের মান ও ভালো। আমরা সবাই দুপুরের খাবার খেতে খেতে প্রায় ৪ টা বেজে গেলো। আমরা যখন দিল্লীর প্রায় কাছাকাছি, এমন সময় বাংলাদেশ থেকে আমার এক আর্মির বন্ধু মেজর মহিউদ্দিন ফোন করলো যে, আমার আরেক বন্ধু মেজর জেনারেল ওয়াকার (বর্তমানে প্রধান মন্ত্রীর ফুফাতো ভাই এবং ফুফাতো বোনের সামিও বটে) সে ফোর্ট্রেস হসপিটালে ভর্তি, পারলে যেনো দেখে আসি। ওয়াকারের বাংলাদেশের নাম্বার আমার কাছে ছিলো কিন্তু দিল্লীতে এসে কোন নাম্বার সে ব্যবহার করছে সেটা না পাওয়ায় ওয়াকারের সাথে আর কথা বলতে পারলাম না কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামীকালই ওকে হাসপাতালে দেখতে যাবো।
আমাদের হোটেলে পৌছতে পৌছতে প্রায় রাত ৭ টা বেজে গেলো।