২৬/০৩/২০০২- মা আর নাই

জন্মঃ তারিখ জানা নাই

মৃত্যুঃ ১৮ মার্চ ২০০২, ১০ মোহররম, সোমবার

স্থান_ নতুন বাক্তার চর

সেনানীবাসের ৪৯/৪ ষ্টাফ রোডে আমার বাসা। আর্মি হেডকোয়ার্টারে মিলিটারী ট্রেনিং ডাইরেক্টরেটে আমি জেনারেল ষ্টাফ অফিসার-২ হিসাবে কর্মরত আছি। প্রচুর কাজ থাকলেও এখানে একটা ভালো বিষয় হচ্ছে, অফিস আওয়ারের পর খুব বেশী একটা অফ টাইমে অফিসে যেতে হয় না। সাধারনত বিকালের দিকে বেশ ফ্রি থাকি। এই ফাকে আমি নিবাইস ইন্সটিটিউটে এমবিএ এর সন্ধ্যাকালীন কোর্ষে ভর্তি হয়েছি। আমার সাথে আমার কোর্ষমেট মেজর সালাম, মেজর জাবের, মেজর মাসুদ ইকবালও ভর্তি হয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর আব্দুল মান্নান নিবাইশ এর মালিক এবং তিনি কয়েকদিন আগেই সবেমাত্র নিবাইশ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হিসাবে চাউ করেছেন। তিনি আমাদের পেয়ে বেশ উৎফুল্ল মনে হয় কারন আমরা ইতিমধ্যে তার নিবাইস ইন্সটিটিউটে একটা সারা জাগাতে পেরেছি। সপ্তাহে দুইদিন ক্লাস হয়। শুক্রবার আর শনিবার। তাই শুক্রবারটা আমার খুব ব্যস্ত সময় যায় দুটু কারনে, এক, নিবাইশে ক্লাস আর ২য় টা হচ্ছে- আমি প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার মাকে দেখার জন্য গ্রামে যাই।

মাকে ঢাকায় রাখতে চাইলেও মা ঢাকায় থাকতে সাচ্ছন্ধবোধ করেন না। যতোদিন আমার কাছে থাকেন, ভালোই লাগে, কিন্তু যখনই গ্রামে চলে যান, আমি প্রতি সপ্তাহে মাকে দেখার জন্য গ্রামে যাই। নিজের গাড়ি নাই তাই, সকাল বেলা একটা সিএনজি সারাদিনের জন্য ভাড়া করি, সরাসরি গ্রামে যাই, মায়ের সাথে এক বেলা সময় কাটাই, তারপর দুপুরে মায়ের সাথে খাওয়া দাওয়া করে বিকালে ওই একই সিএনজি নিয়ে সরাসরি নিবাইসে ঢোকি ক্লাসের জন্য। রাত ১০টা অবধি ক্লাস চলে। মায়ের সাথে আমার সময়টা কাটাতে বেশ লাগে। গ্রামে যখন হাজির হই, মা জানে আজ আমি যাবো, কিভাবে জানে জানি না। মাকে কখনো আগাম জানিয়ে আমি গ্রামে যাই না। যখনই সময় পাই, চলে যাই। মা আমার আসার কথা ভেবে, দুপুরে বেশ ভালো তরকারী আগে থেকেই রান্না করে রাখেন। আমি আর মা একসাথে খেতে বসি, কিন্তু মা খান না, আমার খাওয়া দেখেন আর সারাক্ষন আমার শরীরে হাত বুলাতে থাকেন। মাঝে মাঝে মাকে আমি প্রশ্ন করি, আচ্ছা মা, আমি কি এখন ছোট যে, তুমি এভাবে সারাক্ষন আমার পিঠে, মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে আদর করো যেনো আমি একটা ছোট বাচ্চা। মা কিছুই বলেন না, হাত বুলাতেই থাকেন, আমার ভালোই লাগে।

এবার গ্রামে গিয়েছিলাম মাকে দেখতে গত ৮ মার্চ ২০০২ তারিখে। বেলা তখন প্রায় ১১ টা বাজে। মাকে দেখলেই আমার প্রান জুড়িয়ে যায়, মন ভালো হয়ে যায়। অনেক গল্প হয় মার সাথে। গ্রামে ঘটে যাওয়া গত সাতদিনের সব খবর আমি মার কাছ থেকে পাই। গল্প করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। কখনো কখনো দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর, আমি আর মা এক সাথে গল্প করার জন্য বাইরের বাতাসে আমাদের পুর্ব পাশে রান্না ঘরের বাইরে মাদুর নিয়ে বসি। এবারও তাই হলো। দুপুরটা বেশ সুন্দর কিন্তু রোদের তেজ এতো বেশি যে, ভাবলাম, একটু বেলা পড়ে গেলেই রওয়ানা হবো, ক্লাশ আছে। এই সময়টা মার সাথে গল্প করি। অন্যান্য বারের মতো মা আজো আমাকে তার মুখ থেকে চিবানো পান দিয়ে বল্লো, আগামী সপ্তাহে আবার কবে আসবা? বললাম, আমার তো মা, শুক্রবার ছাড়া আসা হয় না, সারা সপ্তাহ কাজ থাকে। কিন্তু এই আগামী সপ্তাহে ১৫ মার্চ শুক্রবারে মনে হয় আসতে পারবো না। কারন বগুড়া সেনানীবাসে একটা কনফিডেনশিয়াল চিঠি নিয়ে আমাকেই যেতে হবে। কিন্তু ১৫ তারিখের পর ১৮ মার্চ তারিখে আশুরার জন্য সোমবার ছুটি আছে, সেদিন ইনশাল্লাহ চলে আসবো।

মা, আমার খালী পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে একটু নীচু স্বরে কি যেনো বললেন, ভালো বুঝা গেলো না কিন্তু এটা যেনো স্পষ্ট শুনতে পেলাম যে, মা বললেন, ওইদিন আমাকে পাও কিনা, কে জানে?

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। বললাম, মা তুমি কি বল্লা?

মা বল্লো, না তেমন কিছু না, তবে গত কয়েকদিন যাবত আমি তোমার বাবাকে বারবার স্বপ্ন দেখছি। তোর বাবা আমাকে বারবার তার সাথে দেখা করতে বলছে। আমিও জানি কেমন করে বলে দিলাম, আমি আসতেছি।

খুব অবাক হলাম মায়ের এরকম বিশ্বাস আর কনফিডেন্স দেখে। বললাম, আপনি কি এগুলি বিশ্বাস করেন? হতে পারে কোনো কারনে আপনার মন খারাপ ছিলো, একাকিত্ত থেকে মানুষ অনেক সময় তার আপনজনকে খুব মিস করা থেকে হয়তো এ ধরনের স্বপ্নের উদ্ভব হয়, তাই হয়ত বাবাকে মনে পড়ছে তোমার। এগুলি বিশ্বাস করা ঠিক না মা। আপনার কিছুই হবে না ইনশাল্লাহ।

মা কিছুই বললেন না বললেন, আমি যখন তোর বাবাকে খুব একটা সপ্নে দেখিনা, কিন্তু যখন সত্যি এমন কিছু আমার জানা দরকার অথচ আমি জানি না, সে রকম কিছু সময়ে আমি তোর বাবাকে সপ্নে দেখি। এটা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। সেটা আসলে স্বপ্ন নয়, সেটা আসলেই বাস্তব, হয়তো ব্যাপারটা সপ্নে ঘটে। কিন্তু ব্যাপারটা বাস্তব। মন খটকা লাগলো। মা সাধারনত এ রকমের কথা প্রায়শই বলেন না। কিন্তু যখন বলেন, আমি দেখেছি ব্যাপারটা সত্য হয়। যেমন, আমি যখন খুব গোপনে সবার অগোচরে আর্মিতে পরীক্ষা দিয়ে প্রায় চলে আসবো, ঠিক সে সময় মা কোথা থেকে প্রশ্ন করে বললেন, তুমি কি আমাদেরকে ছেড়ে এমন কোথাও যাচ্ছো যা আমরা কেউ জানি না? আমি অবাক হয়েছিলাম। মা জানলো কিভাবে? আমি মাকে উলটা প্রশ্ন করেছিলাম, কি বলো মা? মা তখন ঠিক আজকের মতো এ রকম কনফিডেন্স নিয়েই বলেছিলো, তোর বাবা সপ্নে আমাকে এ রকমই একটা মেসেজ দিলো যে, "তোর ছোট ছেলে তো কোথাও চলে যাচ্ছে, ওকে ঠেকাও"। যাই হোক, আমি চলে এলাম ঢাকায়। কাউকে কিছুই বলি নাই ব্যাপারটা নিয়ে। আমি আসলে ব্যাপারটা সিরিয়াসলী নেইও নাই।

মাকে নিয়ে আমি সবসময় টেনসনেই থাকি। মা ঝড়কে ভয় পায়, মা রাতে একাকী থাকতে ভয় পায়, মা তার কষ্টের কথা কাউকে বলতে ভয় পায়। মার সাথে আমার টানটা একদম নাড়ির সাথে। দেশে বর্তমানে মোবাইল সবেমাত্র চালূ হয়েছে। গ্রামীন একটা মোবাইল অনেক দাম দিয়ে হলেও কিনেছি। এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো যে, মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ রাখা। আমাদের পাশের গ্রামে একজন মহিলা আছেন যার নাম্বারে কল দিলে তিনি তার মোবাইলটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে যায়, এবং আমি তখন মায়ের সাথে কথা বলতে পারি। যাই হোক, আমি আমার আগের পরিকল্পনা মাফিক, আমি আসলেই এবার শুক্রবারে ব্যস্ততার কারনে গ্রামে যেতে পারি নাই। তাই আগামী সোমবার আশুরার দিনে মাকে দেখতে যাবো এটাই ছিলো আমার পরিকল্পনা। কিন্তু সে দিনটা আর আমার জীবনেই আসে নাই যেখানে মাকে সত্যি সত্যিই জীবিত পাবো।

১৮ মার্চ ২০০২। আশুরা এবং সরকারী ছুটির দিন। সকাল ৯ টার দিকে গ্রামে যাবো মাকে দেখতে এটা ভেবেই গতকাল রাতে মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়েছিলাম। বেলা যখন প্রায় সকাল ৮ টা। আমার পাশের বাসায় মেজর জামাল, এএসসি থাকেন। তিনি নক করলেন আমার বাসার দরজায়। ঘুমিয়ে ছিলাম, ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে স্যার আমাকে জানালেন যে, আর্মি এক্সচেঞ্জ থেকে আমাকে কি একটা জরুরী মেসেজ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু আমার ফোনের ক্রেডেলটা সম্ভবত ডিস্প্লেস অবস্থায় আছে, তাই এক্সচেঞ্জ ঢোকতে পারছে না। বললাম, কি ব্যাপারে জরুরি মেসেজ স্যার? ওরা কি কিছু বলেছে আপমাকে? তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। মনে খটকা লাগলো।

তাড়াতাড়ি ফোন করলাম আর্মি এক্সচেঞ্জে। আর্মি এক্সচেঞ্জ থেকে আমাকে জানালো যে, বাক্তার চর থেকে মোল্লা নামের এক ভদ্রলোক কি জানি একটা জরুরী মেসেজ দেওয়ার জন্য আমাকে আমার মোবাইল এবং ল্যান্ড লাইন ফোনে চেষ্টা করেছে কিন্তু পাচ্ছে না। আর্মির এক্সচেঞ্জে ফোন অপারেটরকে মোল্লা সাহেব একতা মোবাইল নাম্বার ও দিয়েছে। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম, মার কিছু হয় নাই তো? মোল্লা হচ্ছেন আমাদের ঘরের পাশে প্রতিবেশী। তাকে আমরা কাকা বলে সম্বোধন করি। আমাদের ঘরের সাথে উনার ঘর।

আমি আমার মোবাইল চেক করে দেখি যে, মোবাইল চার্জে দেওয়া ছিলো ঠিকই কিন্তু প্লাগটা অন করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই সারারাত চার্জ না হয়ে বরং চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষন চার্জ দিয়ে আমি গ্রামে মোল্লা কাকাকে ফোন করলাম। ফোনে যেটা উনি বললেন, তাতে আমার আরো সন্দেহ তৈরী হলো। মোল্লা কাকা বললেন যে, আমার মা খুবই অসুস্থ। তার অবস্থা ভালো না। আমি মোল্লা কাকাকে বললাম, কাকা, ঠিক কথাটা বলতে হবে। মা কি অসুস্থ্য নাকি মা আর নাই? আমি শক্ত মানুষ, আমাকে সত্যটা বলতে হবে কারন যদি মা অসুস্থ্য হন, তাহলে আমার গ্রামে যাওয়ার প্রিপারেশন এক রকম, আর যদি মা আর জীবিত না থাকেন, তাহলে আমার প্রিপারেশন অন্য রকম। আমাকে সত্যিটা বলেন।

এবার মোল্লা কাকা বললেন যে, দাদী মারা গেছেন। তুমি আসো।

আমার সারা শরীর কেপে উঠলো। আমার সেদিনের মায়ের কথাগুলি একদম স্পষ্ট মনে পড়লো যখন মা আমাকে বলেছিলেন যে, মাকে আমি আর জীবিত দেখতে পাই কিনা সন্দেহ আছে। কারন, বাবা নাকি মাকে যেতে বলেছেন। তখন কথাটা একেবারেই আমলে নেই নাই, কিন্তু কথাটা কতটা সত্য ছিলো সেটা আজ যেনো আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠলো। আমি দ্রুত মিটুলকে বললাম, মা আর নাই। আমরা দুজনেই হত বিহব্বল হয়ে গেলাম এই আচমকা শোকে। আমি মিটুলকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বললাম। গ্রামে যেতে হবে।

নিজের কোনো গাড়ি নাই। সেদিন আবার সোমবার। সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী সোমবারে গাড়ির লে অফ অর্থাৎ জরুরী এডমিন কাজ ব্যতিত কিংবা ট্রেনিং সঙ্ক্রান্ত কোনো জরুরী বিষয় না হলে আর্মির কোনো গাড়িই সেনানীবাস থেকে বের করার বিধান নাই। মায়ের এ রকম অসময়ের মৃত্যুর কথায় আমার নিজের মাথাও ঠিকমতো কাজ করছিলো না। কোথা থেকে একটা গাড়ি পাওয়া যায় সেটা ভাবতে লাগলাম। হটাত মনে হলো যে, পাশেই মেজর খিজির স্যার (ইএমই) ওয়ার্কশপের ওসি। আমরা এক সাথে হাইতিতে মিশন করেছি। উনাকে বলে দেখি কোনো সাহাজ্য পাই কিনা। যেই আমি মেজর খিজির স্যারকে ব্যাপারটা খুলে বললাম, তিনি ওয়ার্কশপ থেকে একটা ভালো গাড়ি আমাকে দিয়ে বললেন, আগে যাও মাকে দেখার জন্য, পরে দেখা যাবে আইনে কি বলে। গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমি দ্রুত গোসলে ঢোকি।

কদিন আগে আমি মায়ের একটা ডে লং ভিডিও করেছিলাম। সেখানে আমি মাকে অনেক প্রশ্ন করে করে মায়ের মনের ভিতরের কথা জানার চেষ্টা করেছিলাম। আমি মাকে তার ছোট বেলার কথা, মার সাথে বাবার প্রেমের কথা, মার বিয়ের পর তার শসুর বাড়ির কথা, বাবার মৃত্যুর পর মার মনের কথা, তারপর আমাদের কথা, তার কোন ছেলেমেয়ে তার কাছে কোন পর্যায়ে আছে তার অনেক খবর আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম। সেদিন ভিডিও করার সময় আমি মাকে এই প্রশ্নটাও করেছিলাম, যে, মার শেষ ইচ্ছা কি। তার মৃত্যুর পর তিনি কোথায় সমাহিত হতে চান, ইত্যাদি। মায়ের এই তথ্যগুলি আমি এম্নিতেই জানতে চেয়েছিলাম। ভিডিও করার সময় মা কখনো হাসতে হাসতে বিগলিত হয়ে গেছেন আবার কখনো কখনো কষ্টের কথাগুলি বলার সময় তার দুই চোখ দিয়ে অবিরত জল পড়েছিলো। আমি মাকে না হাসায় না কাদায় কোনো বাধা দিয়েছিলাম। বলুক মা।

আজ মাকে কোথায় সমাহিত করতে হবে এই তথ্যটা আমার মাথায় যেনো আসছেই না। এদিকে গ্রাম থেকে বারবার ফোন আসছিলো মাকে কোথায় সমাহিত করা হবে সেটা জানার জন্য। কারন কবর করতে হবে। জায়গাটা না বললে কাজে কেউ হাত দিতে পারছে না। আমি ওয়াসরুমে মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে ঢালতে বারবার মনে করার চেষ্টা করছিলাম মায়ের শেষ সমাহিত হবার ইচ্ছেটার কথা। কিন্তু আমার মাথা কিছুতেই আমাকে সাহাজ্য করছিলো না। গোসল শেষ করে আমি ফজরের কাজা নামাজটা পড়তে পড়তে হটাত মনে হলো, হ্যা, মনে পরেছে এবার। আল্লাহই আমাকে মায়ের শেষ ইচ্ছেটা স্মরণে আনতে সাহাজ্য করেছেন। মা বলেছিলেন যে, তিনি তার একমাত্র বোন আমার খালার কবরের পাশে যেনো সমাহিত করি। আমার খালা ছিলো একাধারে আমার মায়ের মার মতো, দিদির মতো, তার একটা বন্ধুর মতো। আমি নামাজ পড়েই মোল্লা কাকাকে ফোন করে বললাম, আমি দ্রুতই গ্রামে আসতেছি, আর মায়ের কবরট যেনো হয় আমার খালার কবরের পাশে। এটা মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিলো।

আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। অন্য সবসময় যাই, মাকে জীবিত দেখার জন্য, আর আজ যাচ্ছি মাকে সমাহিত করার জন্য। মনটা বড় কষ্টে আছে। সারাক্ষন মার জন্য তাসবিহ পড়ছি, আর মার জন্য দোয়া করছি। একসময় ভাবলাম, আমি কি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করবো নাকি মাকে সমাহিত করবো? ভাইয়াকে ফোন করলাম। পেলাম না। তার ফোন এনসারিং মেশিনে দেওয়া। ভাইয়া আমেরিকায় থাকেন। ভাবলাম, ভাইয়া আমাকে ফোনব্যাক করবেন নিশ্চয়ই। আমি যখন ভাইয়াকে ফোন করেছি, তখন আমেরিকায় রাত বেশী না, হয়তো ১০ টা বাজে। এই সময় ভাইয়ার কল ধরার কথা। ভাইয়া কল না ধরার কারনে আমি আমার জেঠস যিনি আমেরিকায় থাকেন, শেলি আপা, তাকে ফোন করে বললাম যে, আমার মায়ের মৃত্যুর খবরটা যে করেই হোক ভাইয়াকে জানান।

আমি গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম যখন তখন বেলা প্রায় ১১ টা সকাল। অনেক লোকের সমাগম। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই লোকজন এসেছে। মা শুয়ে আছেন একটা নামাজী পাটির মধ্যে কাত হয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে মা মারা গেলেন। নুরুন্নাহার আমাকে যেটা বলল তার সার্মর্ম এ রকম যেঃ

মা ফজর নামাজের সময় নামাজে ছিলেন। নামাজের মধ্যেই মা মারা গেছেন। আর উঠেন নাই। নুরুন্নাহার মনে করেছিলো, যে, মা মনে হয় নামাজ পরার পর এম্নিতেই নামাজের পাটিতে শুয়ে আছেন। কিন্তু সকাল ৭টা অবধি যখন মা আর পাটি থেকে উঠছেন না, তখন নুরুন্নাহার মাকে জাগাতে গিয়ে দেখে যে, মার কোনো শ্বাস চলছে না। এরপরেই নুরুন্নাহার পাশের বাসার মোল্লা কাকাকে ব্যাপারটা জানায়।

আমি মায়ের শান্ত বডিটাকে কয়েকবার নাড়া দিয়ে মা বলে ডাকলাম, কানের কাছে গিয়েও ডাকলাম। মা কোনো উত্তর করলেন না। আমি মার হাতের পালস চেক করলাম, তখনো মনে হচ্ছে শরীরটা গরম, ঠান্ডা হয়ে যায় নাই। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো মা নাই। সন্দেহ হলো একবার যে, মা কি আসলেই নাই নাকি ক্লিনিক্যালী কোনো এক অবস্থায় আছেন? আমাদের বাড়িতে পাশেই একজন ডাক্তার ছিলেন। তাকে বললাম, ভালো করে একটু দেখবেন মার অবস্থাটা কি? ডাক্তার সাহেব আমাকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বললেন, আখতার ভাই, খালাম্মা আর বেচে নেই। আমি অনেকভাবেই চেক করে দেখেছি। আপনি ঠান্ডা হোন। এখন খালাম্মাকে সমাহিত করার যাবতীয় ব্যবস্থা নিন। জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু এটাই বাস্তবতা যে, খালাম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আমার অন্যান্য বোনেরা, মায়ের নায়-নাতকোরগন অনেকেই বিলাপ করে কাদছেন। কিন্তু আমি কাদতে পারছি না। কেনো যেনো আমার কান্নাই পাচ্ছে না। আমি খুব সাভাবিকভাবেই মাকে সমাহিত করার জন্য গোসলের ব্যবস্থা করতে বললাম, কবরের জন্য লোক লাগিয়ে দিলাম। আমার বোন ফাতেমা আর আরেকজন মিলে মাকে গোসল করিয়ে দিল। গোসলের সময়ও আমি কয়েকবার তদন্ত করেছি মা কোন প্রকার নড়াচড়া করেন কিনা। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো মা মারা যান নাই। এ রকম সুন্দর একটা নিষ্পাপ মুখ, শান্ত আর সাভাবিক চেহারা যাকে দেখলে মনে হবে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। মার চেহাড়াটা আগের থেকে অনেক উজ্জ্বল। মার এই রকম সুন্দর চেহারা আমি কখনই দেখি নাই। গোসলের পর মাকে কাপড় পরানো হবে, আমি আবার মাকে জোরেই ডাক দিলাম। কিন্তু মা আমার ডাকে কোনো সারা দিলেন না। মাকে কাপড় পরানো হলো। সাদা দাফনের কাপড়। মাকে জানাজা পরানো হবে, অনেক লোক অপেক্ষায় আছেন। মাকে জানাজার স্থানে আনা হলো। আমি আবার ওই অবস্থাতেই মাকে ডাকলাম। যদি আবার মা নড়েচড়ে উঠে! এ সময় মোল্লা কাকা আমাকে ধরে বললেন, কাকু, তুমি অস্থির হইও না। দাদি আসলেই মারা গেছেন। তুমি খালি দোয়া করো। তোমাকে দাদি অনেক ভালবাসতো আর ভরষা করতো। তুমি এমন করলে উনি তো আরো কষ্ট পাবেন!!

জানাজা পরানো হয়ে গেল। আমি তখনো ভাইয়ার একটা ফোনকলের জন্য অপেক্ষা করছি, যদি ভাইয়া আমাকে ফোন করেন। ভাইয়াকে আবারো আমার মোবাইল থেকে ফোন করলাম, কিন্তু এবার ভাইয়ার ফোন আর এনসারিং মেশিনে ছিলো না। রিং হচ্ছিলো। কিন্তু যে কোনো কারনেই হোক, ভাইয়া ফোনটা ধরলেন না। আমি আবার শেলী আপাকে ফোন করলাম যদি এরই মধ্যে শেলী আপার সাথে ভাইয়ার কোনো কথা হয়ে থাকে আর ভাইয়া মার মৃত্যুর খবরটা জেনে থাকে সেটা জানার জন্য। শেলী আপা ফোন ধরলেন। আর আমাকে জানালেন যে, ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে। মার মৃত্যুর সংবাদ ভাইয়াকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাইয়া নাকি বলেছেন, উনি আসতে পারবেন না। খুব বিরক্ত হয়েছিলাম এমন একটা খবরে। ভাইয়ার উপর আমার শ্রদ্ধাবোধটা নিমিষেই শুন্যের কোঠায় চলে এলো। ভাবলাম, আজ যদি উনি শুনতেন যে, উনার শাসুড়ি মারা গেছেন, হয়তো ঠিকই চলে আসতেন।

কাউকে কিছু বললাম না। জানাজার পর মাকে কবরে সমাহিত করা হবে। আমি সবার উদ্দেশ্যে একটা এনাউন্সমেন্ট করলাম যে, আমার মা আজ চলে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি রয়ে গেছি মার ছেলে। যদি কখনো আমার মা কাউকে জানা বা অজানা মনে কষ্ট দিয়ে থাকেন, তাহলে যেনো কেউ তার দাবী না রাখেন। মাকে মাফ করে দিবেন। আর যদি কেউ মার কাছ থেকে কোনো পাওনা থাকে, নির্ধিধায় আমাকে জানাবেন, আমি কোনো প্রকার ভেরিফাই করবো না, আমি মায়ের সব দেনা শোধ করে দেবো। আর যদি মা কারো কাছ থেকে কিছু পাবেন বলে জানেন, আজ আমি তার ছেলে হিসাবে সবকিছু মাফ করে দিলাম। শুধু আমার মার জন্য আপ্নারা খাস মনে দোয়া করবেন।

আমরা সবাই মাকে কাধে করে কবরের কাছে নিয়ে গেলাম। আমার এখনো মন মানছে না যে, মা নাই। মাকে যে আমি সত্যি সত্যিই গোরস্থানে সমাহিত করতে যাচ্ছি এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না। কবরে শোয়ানোর ঠিক আগমুহুর্তেও আমি মাকে জোরে আরেকবার ডাক দিলাম। কিন্তু মা তো আমার কথা নিশ্চয়ই শুনছেন কিন্তু কোনো সাড়া দিলেন না। খালার কবরের পাশেই মাকে সমাহিত করা হল।

বেলা তখন প্রায় ৩টা যখন সমস্ত আয়োজন শেষ হয়। মাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে। আমি বাড়িতে সব বোনদেরকে নিয়া একসাথে বসলাম। সবার মন খারাপ। কেউ কেউ তখনো কাদছে। আমার চোখে এক ফোটা পানিও নাই। যেনো কিছুই হয় নাই। বিকাল হয়ে গেছে। আর্মির গাড়ি নিয়ে এসেছি, আমাকে আবার সন্ধ্যার আগেই ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। গাড়িটা পার্ক করা আছে প্রায় ১ মাইল দূরে। আমাদের বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি আসে না তাই। আমার যাওয়ার সময় হয়ে এলো। আমি মিটুলকে বললাম, চলো, ঢাকায় যেতে হবে। আমি আগে আগে হাটছি, মিটুলও বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। আমি হাটতে হাটতে প্রায় ৩০০ গজ যাওয়ার পর ভিতর থেকে এতো কষ্ট আর কান্না আসছিলো যে, আমি আর একটি পাও আগাইতে পারছিলাম না।

প্রতিবার যখন আমি গ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই, আমার মা বাড়ির পিছনে বসে থাকেন যতোক্ষন আমাকে দেখা যায়। আমি মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাই আর দেখি, মা বসে আছেন, হাত নাড়েন। আমিও হাত নাড়ি। মাকে ফেলে যেতে আমার সবসময় মনে কষ্ট হতো। কিন্তু আজকে আমার মনে বারবার এই ভাবনাটাই আসছে, আজ মা বাড়ির পিছনে বসে নাই, আমি পিছন ফিরে তাকাই, মা নাই। আমার গলা ফাটিয়ে কাদতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু আমার গলা দিয়ে একটু আওয়াজও বের হলো না। আমার চোখ জলে এতোটাই ভরে উঠছিলো যে, আমি এক হাত দূরের রাস্তাটাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি বসে গেলাম বিস্তর খালী জমিনে। আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। মা আমাকে আজ আর দেখছে না। আমাকে খালী জমিনের উপর বসে পড়তে দেখে আমার বাড়ি থেকে কয়েকজন দৌড়ে এলো। মিটুলও এলো। আমার চোখের পানিতে আমি কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার শরিরে কোন শক্তি ছিলো না উঠে বসবার। বুঝলাম, এতোক্ষন যে কষ্টটা আমার বুকের ভিতর শক্ত হয়ে চেপেছিলো, এখন সবগুলি কষ্ট আমাকে চারিদিক থেকে এমন করে ঝাপটে ধরেছে যে, আমার চোখ, আমার কন্ঠ, আমার পা, আমার হাত, আমার মাথা, আমার কান কোনোটাই আর সাভাবিক অবস্থায় নাই। আমি কতোক্ষন চুপ করে বসেছিলাম, আমার মনে নাই।

শক্তি নাই ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কিন্তু আমাকে তো ফিরতেই হবে। মা নাই, কোথায় ফিরে যাবো? এখন এই শুন্যঘরে গিয়ে তো মাকে পাবো না, মায়ের চিবানো পান খাওয়ার আর আমার হলো না। মা বাবার সাথে দেখা করার জন্য চলে গেছেন। আজ হয়তো বাবা অনেক খুসী তার সেই প্রায় ৩০ বছর আগে একা ফেলে যাওয়া প্রেয়সীকে কাছে পেয়ে।

ঢাকায় ফিরতে ফিরতে আমার প্রায় রাত ৮টা বেজে গেলো। মেজর খিজির আমাকে ফোন করে শুধু বললেন যে, খালাম্মার জন্য দোয়া করো। তিনি জান্নাতবাসি হয়েছেন। তিনি আল্লাহ্‌র পাটিতে বসেই জান্নাতে চলে গেছেন, এর থেকে পুন্যের কি হতে পারে? খিজির স্যারকে আমি কখনো তার এই দয়ার ঋণ শোধ করতে পারবো না।

ঢাকায় এসে আমি আমার কম্পিউটারটা খুললাম। মার সেদিনকার ভিডিওটা অন করলাম, উফ, এই তো মা ঠিক আমার সামনেই। তিনি কখনো হাসছেন, কখনো কাদছেন, কখনো আমার দিকে তাকিয়েই আছেন। অনেক রাত অবধি আমি আমার মার ভিডিও টা কয়েকবার আগে পিছে টেনে আবার রিওয়াইন্ড করে করে দেখলাম। অনেক রাত, চারিদিকে শুনশান নীরবতা। কেবল আমার মনের ভিতরেই অত্যান্ত প্রবল আর্তনাদ আমার বন্ধ কবাটির ভিতরে ঘুরপাক খাইতে লাগলো। আমি স্তব্দ তপতীর মতো আমার চেয়ারে ঠেস দিয়া শুধু সেলোলয়েড ফ্রেমে বাধা জীবন্ত মাকে দেখতে লাগলাম বটে কিন্তু মা আমার এখন ঈশ্বরের একদম কাছে চলে গেছে। এখন তার আর ঝড়কে ভয় পাবার কোনো কারন নাই, একা থাকার ভয় নাই, পৃথিবীর কোনো মায়া, কোনো কষ্ট, বা কোনো সুখের প্রভাব নাই। 

সাতদিন পর আমার বড় ভাই আমাকে একটা মেইল করলেনঃ মেইলটা আমি হুবহু আজ এখানেই তুলে দিলাম।

To: Mohammad Akhtar Hossain <makhtar@dotbd.com>
From: "Mohamed Habibullah" <M.HABIBULLAH@neu.edu>
Subject:
MIME-Version: 1.0
Date: Mon, 25 Mar 2002 13:10:31 -0500
Message-ID: <OFF893F0BA.F371BA0B-ON85256B87.0063D6FA@neu.edu>
X-MIMETrack: Serialize by Router on HUB02/Server/NEU(Release 5.07a |May 14, 2001) at 03/25/2002
01:10:51 PM
Content-type: text/plain; charset=us-ascii
Status:
Monday USA time 1:00 P.M.

Dear Akhtar

I just recieved your e-mail. Also.Today, I received a call from Shelly Apa and came to know that Ma died (Inna lillahe wa inna ilaihe rajeoon). I will miss Ma from now on. May Allah keep her in peace in the grave. I know I could not come to see her off. PLease let me know where you buried her. Let me also know everything anout everybody including Badir Bhai, Laila, Fatema and Meherunnesa. Take care.

কি প্রয়োজন এই সব সন্তানের জন্য যাদের হাতে তার জন্মদাত্রী মায়ের মৃত্যুতেও শেষকৃত্য করার জন্য হাতে সময় থাকে না? সম্পর্কের থেকে বেশী যখন নিজের সম্পদের দাম বেড়ে যায়, নিজের জন্মদাত্রির শেষকৃত্য করার জন্য যখন কোনো সন্তানের সময় থাকে না, আল্লাহ বা ঈশ্বর কিংবা ভগবান এইসব কিছুর একটা রেকর্ড রাখেন যাতে কোনো এক সময় যখন তাদের শেষকৃত্য হবে, হয়তো তাদের বেলাতেও এটাই রিপিট হয়। তবে আমি দোয়া করি যেনো, আমার কোন বংশধর অথবা আত্তীয়ের বেলায় এ রকমের শুন্যতা না আসে।

প্রিয় আখতার,

এইমাত্র আমি তোর চিঠি পেলাম। আজকে আমি শেলী আপারও টেলিফোন কল পেয়েছি এবং জানতে পারলাম যে, মা মারা গেছেন (ইন্না নিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজেউন)। আমি মাকে এখন থেকে অনেক মিস করবো। দোয়া করি আল্লাহ মাকে জান্নাতবাসী করুন। আমি জানি, মার মৃত্যুতে আমি মাকে দেখতে আসতে পারবো না। আমাকে জানাস মাকে কোথায় করব দিলি। বদির ভাই, লায়লা, মেহের এবং ফাতেমাদের সম্পর্কেও আমাকে বিস্তারীত জানাইস। নিজের যত্ন নিস।