২৬/১১/১৯৯৭- তাজমহল ভিজিট

আমরা পরদিন (২৬ নভেম্বর)  সকালে তাজমহলের উদ্দেশ্যে সবাই এক সাথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমাদের সাথে কোনো এক ইউনিভার্সিটির টিচার গাইড হিসাবে ছিলেন যিনি খুব ভালো ইতিহাস জানেন এবং ভাল ইংরেজি বলতে পারেন। তিনি একে একে তাজমহলের প্রবেশদ্বার থেকে সবকিছু বলতে থাকলেন কেনো এটা প্রিথিবিতে ৭ম আশ্চর্যের  মধ্যে একটা স্থান পেয়েছিলো। আমরাও এর অনেক কারন জানতাম না। আমি এখানে কিছু কিছু ব্যাখ্যা তুলে ধরি তিনি আমাদেরকে কি কি বলেছিলেন।

প্রথমেই তিনি তাজমহল সৃষ্টির কারনগুলি উল্লেখ করলেন। মমতাজের আসল নাম ছিলো আরজুমান্দ বানু বেগম। মহলটির কাজ শুরু হয়েছিলো ১৬৩২ সালে আর শেষ হয়েছিলো ১৬৫৩ সালে। প্রায় ২১ বছর। শিল্পনৈপুণ্যসম্পন্ন একদল নকশাকারক ও কারিগর সৌধটি নির্মাণ করেছিলেন যারা উস্তাদ আহমেদ লাহুরির সাথে ছিলেন, যিনি তাজমহলের মূল নকশাকারক হওয়ার প্রার্থীতায় এগিয়ে আছেন। তাজমহলকে (কখনও শুধু তাজ নামে ডাকা হয়) মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যদিও সাদা মার্বেলের গোম্বুজাকৃতি রাজকীয় সমাধীটিই বেশি সমাদৃত, তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল। মমতাজ ছিলো সম্রাট শাহজাহানের ২য় স্ত্রী।

তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি বড় চারবাগ (মুঘল বাগান পূর্বে চার অংশে বিভক্ত থাকত) করা হয়েছিল। ৩০০ মিটার X ৩০০ মিটার জায়গার বাগানের প্রতি চতুর্থাংশ উঁচু পথ ব্যবহার করে ভাগগুলোকে ১৬টি ফুলের বাগানে ভাগ করা হয়। মাজার অংশ এবং দরজার মাঝামাঝি অংশে এবং বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো আছে এবং উত্তর-দক্ষিণে একটি সরলরৈখিক চৌবাচ্চা আছে যাতে তাজমহলের প্রতিফলন দেখা যায়। এছাড়া বাগানে আরও বেশ কিছু বৃক্ষশোভিত রাস্তা এবং ঝরনা আছে। চারবাগ মানেই যাতে স্বর্গের বাগানের প্রতিফলন ঘটবে। তাজমহলের চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে তিনদিক থেকে বেষ্টিত। নদীর দিকের পাশটিতে কোনো দেয়াল নেই। এই দেয়ালবেষ্টনির বাইরে আরও সমাধি রয়েছে যার মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি এবং মুমতাজের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড়ো সমাধি রয়েছে। 

(১) তাজমহলে ঢোকতে মোট চারটা গেট আছে, প্রতিটি গেট থেকে মেইন তাজমহল একই রকম দেখা যায়। একই রাস্তা, একই গাছ, গাছের সংখ্যাও সমান। প্রশস্ত, এবং দুরত্ত সমান। সব গাছ একই গাছ।

(2) যে গাছগুলি তাজমহলের প্রবেশ পথ থেকে মেইন বিল্ডিং পর্যন্ত লাগানো আছে, সেই গাছগুলি এমন একটা উচ্চতা পর্যন্ত বড় হবে যা রানীর জন্য সুবিধাজনক। গাছগুলিতে ফুল ফুটলে যেনো রানীর মাথা নুয়ে ফুল তুলতে না হয়, সখীদের নিয়ে হাটতে হাটতে ফুল তুলতে পারেন, ঠিক সেই পরিমান বড় হয়ে গাছ গুলি আর বড় হবে না। কি অদ্ভুদ।

(৩) তাজমহলের প্রবেশ পথে দাডিয়ে মেইন বিল্ডিং এ তাকালে চোখে পড়বে "লা ইলাহা ইল্লাললাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ"। এই লেখাটা যদি কাছে গিয়া দেখা যায়, দেখা যাবে যে, প্রতিটি অক্ষর কিন্তু সমান নয়। কিন্তু তাজমহলের প্রবেশ পথে দাড়াইয়া দেখলে প্রতিটি অক্ষর সমান মনে হবে। আর এটা সূর্যের আলোর প্রতিসরনাংকের ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে করা হয়েছে। এটা খুবই সুক্ষ একটা গনিতের ফর্মুলা। এটা এই তাজমহলে এপ্লাই করা হয়েছে।

(৪) তাজমহলের যেখান দিয়াই কেউ ঢোকুক না কেনো, তাকে যদি দুই ভাগ করা হয়, তাহলে প্রতিভাগে সমান সংখ্যক গাছ, সমান সংখ্যক রাস্তা, সমান সংখ্যক বিল্ডিং, সমান সব কিছু হবে। তাই একে বলা হয় সিমেট্রিক্যাল কন্সট্রাকশন বা স্ট্রাকচার।

(৫) তাজমহলে একপাশে একটা মসজিদ আছে। তাজমহলের এই সিমেট্রিক্যাল হবার জন্য পাশাপাশি দুটো মসজিদ বানানোর নিয়ম নাই বলে, একপাশে একটা মসজিদ আর আরেকপাশে মসজিদের ন্যায় একটা জাওয়াব বানানো হয়েছে। বাহ্যিকভাবে দেখে বুঝার উপায় নাই, কোনটা মসজিদ আর কোনটা জাওয়াব । জাওয়াব আলাদা শুধু এর মেহরাম নেই আর এর মেঝে নকশা করা যেখানে মসজিদের মেঝে ৫৬৯ জন মুসল্লির নামাজ পড়ার জন্য কালো পাথর দিয়ে দাগ কাটা। তাজমহল দেয়াল ঘেরা আগ্রা শহরের দক্ষিণ অংশের একটি জমিতে তৈরি করা হয়েছিল যার মালিক ছিলেন মহারাজা জয় শিং। শাহজাহান তাকে আগ্রার মধ্যখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি নেন।

(৬) তাজমহলের চার পাশে চারটা বড় বড় পিলার আছে। স্বাভাবিক চোখে দেখলে মনে হবে যে, পিলারগুলি সোজা এবং খাড়া, কিন্তু আসলে এই পিলারগুলি একেবারেই সোজা খাড়া না। এই পিলারগুলি একটু বাইরের দিকে হেলিয়ে বানানো। কোনো কারনে যদি প্রাকৃতিক কারনে পিলারগুলি ভেঙ্গে পড়ে, পিলারগুলি যেনো কোনো অবস্থাতেই তাজমহলের ভিতরের সাইডে না পড়ে সেভাবে বানানো। এটা তার ওজনেই তাজমহলের বাইরের দিকে পড়ে যাবে, যাতে তাজমহলের কোনো ক্ষতি না হয়।

(৭) এবার যাই তাজমহলের ভিতরের অংশে। ভিতরে রঙ বেরংগের পাথর দিয়ে অনেক ইতিহাস লেখা। কখনো যৌবনের প্রতিক, কখনো কোনো প্রেমের কাহিনী। বিভিন্ন কালারের পাথর দিয়ে দিয়ে সমন্নয় করে একটা পাথর আরেকটা পাথরের সাথে নেচারালী লাগানো। কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহান একটা পাথরও কেটে লাগাতে দেন নাই। অবিকল পাথরগুলি যেভাবে ছিলো সেটাই একটার সাথে আরেকটা খাপে খাপ মিলিয়ে মিলিয়ে সংযোগ করে লাগানো এবং প্রতিটি পাথর একে অপরের সাথে নিখুতভাবে লাগানো। কত বছর যে লেগেছে এই পাথর বাছাই করার জন্য, এবং তার সাথে রঙ এবং সাইজ মেলানোর জন্য, তার কোনো ইয়াত্তা নাই। ২১ বছর শুধু এম্নিতে এম্নিতেই লাগে নাই এই তাজমহল বানাতে। 

(৮) পাথরগুলি সেমিট্রান্সপারেন্ট। যদি ওয়ালের বা দেয়ালের এক পাশ থেকে টর্চের লাইট দেয়া হয়, ওয়াল বা দেয়ালের উলটো দিকে এই লাইট বেশ প্রবাহিত হতে পারে।

(৯) রানী যেখানে শুয়ে আছেন, অর্থাৎ তার কবর, সেটায় যেনো কোনো ভিজিটর ভিজিট এর কারনে রানি বিরক্তবোধ না করেন, তার জন্য একই ডিজাইনে, একই তরিকায় ঠিক এমন জায়গায় আরেকটি কবরের মতো কবর বানানো হয়েছে যে, যেদিক থেকেই তাজমহলকে ভাগ করা হোক, একদিকে রানীর অরিজিনাল কবর আর অন্যভাগে রানীর রেপ্লিকা অর্থাৎ ফেক কবর ভাগে পড়বে। সমস্ত ভিজিটরদেরকে রানীর এই রেপ্লিকা কবর পর্যন্তই যেতে দেয়া হয়। কিন্তু আমরা যেহেতু ভারতের রাষ্ট্রীয় গেষ্ট হিসাবে বিবেচিত ছিলাম, ফলে আমরা খুব ভাগ্যবান যে, আমরা রানীর অরিজিনাল করব পর্যন্ত ভিজিট করার অনুমতি ছিলো। দেখে বুঝার উপায় নাই, কোনটা নূরজাহানের অরিজিনাল করব আর কোনটা নূরজাহানের ডুপ্লিকেট। দুটুর ডিজাইন, স্টাইল এবং সব কিছুই এক।

(১০) একষ্টিক থিউরী ব্যবহার করা হয়েছে এই তাজমহলের ভিতরে। একষ্টিক থিউরী হচ্ছে বাইরের কোনো শব্দ তার কোন সুর, কিংবা আওয়াজ নষ্ট না হয়ে বক্তা যে আওয়াজে যে সুরে কথা বলবেন, ঠিক সেতাই শুনা যাবে এই তাজমহলের ভিতরে বসেও। এটা দেখার জন্য আমাদে গাইড জানালেন যে, সম্রাট শাহজাহান, চেয়েছিলেন, যখন বাইরে আজান পড়বে, রানির ঘর থেকে যেনো অই আজানটা অবিকল কোনো শব্দ ডিসটরসন না হয় এবং রানি নূরজাহান ঠিক ঐ আওয়াজটাই শুনতে পান। এটা প্রমান করার জন্য গাইড প্রথমে আমাদেরকে একটা সুমধুর আওয়াজের অডিও শুনালেন বাইরে দাড় করিয়ে, তারপর নিয়ে গেলেন, রানীর কবরের পাশে। আবারো সেই সুমধুর আওয়াজটা বাজানো হলো। আসলেই ঠিক তাই, যে সাউন্ডটা আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম, তদ্রুপ রানীর ঘর থেকেও একই আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো।

(১১) তাজমহল একটা জাইরো সিস্টেমে তৈরী করা। অর্থাৎ পুরা তাজমহল কোনো কারনে যদি ভুমিকম্পের কবলে পড়ে তাহলে এটা অর্থাৎ পুরু তাজমহল প্রায় একদিকে সারে সাত ডিগ্রি অন্য দিকে সারে সাত ডিগ্রী হেলে গেলেও তাজমহলের কোনো ক্ষতি হবে না। অর্থাৎ দুই দিকে মিলে তাজমহল প্রায় ১৫ ডিগী হেলতে পারে। এর ফলে তাজমহল প্রায় ৭ রেক্টর স্কেলের ভুমিকম্প সহ্য করার মতো একটা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাজ মহল এর মধ্যে নাকি পর পর দুবার প্রায় এই সম পরিমান ভুমি কম্পে পড়েছিলো কিন্তু এই হেলতে পারা জাইরোর কারনে তাজমহলের কোনো ক্ষতিই হয় নাই। 

(১২) তাজমহলে দাঁড়িয়ে যদি সকালবেলা পূর্ব দিকে সুর্য উঠা দেখেন, তাহলে সুর্য শাহজাহান মহল থেকে যেনো উদিত হচ্ছে এটাই বুঝা যাবে, এটা বছরের যে কোনো সময়ের জন্যই প্রযোজ্য। আবার শাহজাহান মহলে কেউ দাড়াইয়া যদি সুর্যাস্ত দেখেন, তাহলে বছরের যে কোনো সময় মনে হবে যে, সুর্য মমতাজ মহলের উপর দিয়ে সুর্যাস্ত হচ্ছে।

এই রকমের আরো অনেক বৈজ্ঞানিক কারন রয়েছে যার কারনে তাজমহল বিশ্ববাসীর কাছে ৭ম আশ্চর্যের মধ্যে একটা স্থান করে নিয়েছে। এটা কোনো স্বাভাবিক বিল্ডিং বা স্ট্রাকচার নহে।  আমরা প্রায় ঘন্টা তিনেক তাজমহলে থাকার পর বেরিয়ে গেলাম সম্রাট আকবরের আস্তানায়।