২৬/১১/১৯৯৭- সম্রাট আকবর প্যালেস।

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

নভেম্বর 

২৬

সম্রাট আকবরের প্যালেসে আমরা যখন পৌছাই তখন বেলা প্রায় ১২টা বাজে। সম্রাট আকবরের প্যালেসে ঢোকার সময়েই একটা হলঘর আছে যার মধ্যে আছে একটা ঝাড়বাতি। বিশাল বড়। এতো বড় ঝাড়বাতি আমি কখনো দেখিও নাই, আর কেউ কখনো বানিয়েছে কিনা আমার জানাও নাই। এই হল ঘরেই সম্রাট তার সহচরীদের নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, আমরা যেখানে যেখানে ভিজিটে যাচ্ছি, সেখানে সেখানেই সেদিন অন্য কোনো আউট সাইডার ভিজিটর এলাউ ছিল না। ফলে আমরাই গাইডের সাহাজ্যে খুব নিরিবিলিতে পুরু জিনিষগুলি দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম, কোনো কোলাহল ছিলো না, কোনো ভীড়ও ছিলো না।

যাই হোক, সম্রাট আকবরের প্যালেসে  এসে বেশ কিছু অটোমেটিক নিরাপদ বলয়ের ব্যবস্থা সম্রাটগন আগে থেকেই করে রেখেছেন। সেটা দেখলাম। যেমন-

(১) আগেকার দিনে সব সম্রাটগনই তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য, প্রতিটি মেইন গেট এমনভাবে তৈয়ার করেছেন যে, কোনো অতর্কিত হামলায় যেনো বেশ কিছু সময় পাওয়া যায়, এই ব্যবস্থাগুলি করা। আগেকার দিনে হাতী ছিলো শক্তির একটা প্রতিক। যখন কোনো বহির্গমন শত্রু হামলা করতে আসতো, তারা হাতীর ব্যবহার বেশী করতেন। তার সাথে করতেন ঘোড়ার ব্যবহার। হাতী এবং ঘোড়া যখন তার সমস্ত শরীর দিয়ে কোনো একটা বাধা ধাক্কা দিতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে একটা গতির মোমেন্টাম তৈরী করতে হয়। সম্রাটগন এই অংকটা জানতেন। তাই তাদের বাসস্থান এমন একটা উচু জায়গায় করতেন যার উচ্চতা স্বাভাবিক উচ্চতার থেকে প্রায় ১০০ /১৫০ ফুট উপরে। আর এই ১০০/১৫০ ফুট উপরে উঠতে কয়েক ধাপে ঢালুর ব্যবস্থা থাকতো। এই ঢালুগুলি এই রকম করে ঝিকজ্যাক করে তৈরী করা যাতে বাক থাকে, আর প্রতিটি বাক একেবারে ৯০ ডিগ্রী বাকানো। যাতে হাতি বা ঘোড়া কিছুদুর গিয়ে তাকে পুরুপুরি ৯০ ডিগ্রী ঘুরতে হয় এবং সে আবার শুন্য গতিতে চলে আসে। তাতে হাতী বা ঘোড়ার শক্তিও শুন্য হয়ে যায়। ফলে সম্রাট শাহজাহানের প্যালেসে কিংবা সমারট আকবরের প্যালেসে ঢোকতেও ঠিক এই রকমের কিছু প্রতিবন্ধকতা দিয়েই প্রবেশ পথ সুরক্ষিত। এইরকম প্রায় ৫ থেকে ৬টা বাক আছে, আর প্রবেশ পথগুলি একেবারেই মসৃণ নয়। হাতী বা ঘোরা এই অমসৃণ পথে চলতে তাদের পায়ে ব্যথা অনুভব করতো, ফলে পায়ে ব্যাথা পাবার কারনেও হাতী বা ঘোড়া সঠিক গতিতে আসতে পারতো না। এবড়ো থেবড়ো কংক্রিটের রাস্তা। আমরাই স্বাভাবিক জুতা নিয়ে ঐ রাস্তায় হাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। প্রতিটা রাস্তার দুই ধারে আবার ছোট ছোট পটহোল আছে, যেখানে সেন্ট্রিরা রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো যাতে কোনো শত্রু ঢোকতে গেলে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা যায়।

 

(২) আমরা উঠে গেলাম সম্রাটের বাসভবনে। উঠেই দেখি, আরেক জগত। বিশাল চত্তর, চারিদিকে গাছগাছালীতে ভরা। একটা মালভূমির মতো। ঠিক মাঝখানে একটা পিতলের বিশাল বড় কলসি। এই কলসীটা এতো বড় যে, অনায়াসে ১০ বারো জন মানুষ এর মধ্যে খেলা করতে পারে। গাইড জানালো যে, শীতের দিনে সম্রাট এই কলসীতে পানি ভরে রাখতেন, সুর্যের তাপে এই পানি গরম হতো, আর রানী তার সহচরীদেরকে নিয়ে এই গরম পানিতে জলকেলি করতেন আর স্নান করতেন। রানী বলে কথা। তখন আমরা প্রশ্ন করলাম, তাহলে গরমের দিনে রানী কিভাবে ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন? গাইড জানালো, আমরা ওইটাও দেখবো কিভাবে সম্রাট রানীর জন্য ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা করেছিলেন। রানী যেখানে স্নান করতেন, সেখানে কোনো সরাসরি প্রহরী নিয়োগ থাকতো না যাতে তারা দেখতে পায় রানীর গোসল বা জলকেলী। কিন্তু এলাকাটা এমনভাবে ঘেরাও করা যে, বাইরের থেকে কোনো বিপদের সম্ভাবনা নাই। সেভাবেই আউটার চত্তরে গার্ড নিয়োগ করা আছে। যাও আবার গার্ড, তারা আবার নপুংসক সব গার্ড। যাতে কেউ যদি শারীরিকভাবে উত্তেজিত হয়েও যায়, তাতে কোনো সক্ষম পুরুষ রানী কিংবা রানীরে দলবলের কোন ক্ষতির আশংকা না থাকে। শুধু এটাই শেষ নয়। কোনো কারনে যদি বৃষ্টি হয়, ঝড়ো পরিবেশ থাকে অথচ রানী গরম জলেই নিরাপদে অন্যত্র স্নান করতে পারেন, তারও ব্যবস্থা সম্রাট করে রেখেছিলেন। আরেকটি কামরা আছে যেখানে সূর্যের আলোক রশ্মি এমনভাবে ঐ রুমে পতিত হয় যেনো ঐ বড় কলসীতে রাখা পানি ঘরের ভিতরেই ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে। সেখানে থাকতো মহিলা নিরাপত্তার বেষ্টনী। আর নিরাপদ দুরুত্তে নপুংসক কিছু রাইফেলধারী প্রহরী।

 

(৩) এবার গেলাম আমরা আরেকটি কামরায় যেখানে রানী তার সহচরীদের নিয়ে ঠান্ডা জলে গরমের দিনে স্নান করতেন। পাশেই গঙ্গা নদী। ঐ নদী থেকে পানির পাইপ দিয়ে সারাক্ষন ঠাণ্ডা পানির প্রবাহ থাকতো যাতে কামড়াটা সারাক্ষন জলীয় বাস্পের মাধ্যমে ঠাণ্ডা থাকে। আর এই ঠান্ডা পরিবেশে কলসীতে রাখা পানিও বেশ ঠাণ্ডা থাকে। রানী গরমের দিনে এই শীতল পানিতে স্নান করেন।

পুরু জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, আর ভাবলাম, কোনো এক সময় এই সম্রাটদের পদচারনা এ সব স্থানে পড়েছে। তারা পুরু ভারতবর্ষ এসব প্রাসাদ থেকে পরিচালনা করতেন। এখানে সবার প্রবেশের কোনো অনুমতিও ছিলো না। অথচ আজ এতো বছর পর যে কেঊ ১০০ টাকার টিকেট কেটেই যখন তখন ঢোকে যেতে পারে। রাজা নাই, সম্রাট নাই, কোনো প্রহরী নাই, আছে তাদের সমস্ত স্মৃতি আর ইতিহাস। এখান থেকে তাজমহলের চুড়াগুলি দেখা যায়। গাইড বললেন যে, সম্রাট শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিলো এই গংগার পাড়ে শাহজাহান মহল তৈরী করার। কিন্তু তার সে পরিকল্পনা বাস্তবরূপ নেবার আগেই তিনি তার ছেলের হাতে বন্দি হন এবং বন্দি অবস্থাতেই মারা যান। সম্রাট শাহজাহানের দেহ সমাধী করা হয় তাজমহলে নূরজাহানের কবরের পাশে। আর এই কবরটাই হচ্ছে একমাত্র আইটেম যা ব্যতিক্রম। আর এর ফলে তাজমহলের সেমিট্রিক্যাল চরিত্রকে আর সেমিট্রিক্যাল রাখে নাই। অর্থাৎ তাজমহলকে যেখান দিয়েই দুইভাগ করা হোক না কেনো, শাহজাহানের সমাধির কারনে এটা দুই ভাগের যে কোনো এক ভাগে থেকে যায় সম্রাটের দেহ, সব কিছুই আর সমান সমান থাকে না। সম্রাট শাহজাহান এমনভাবে তাজমহলটাকে গড়েছিলেন যে, যে কোনো দিক থেকেই কেউ প্রবেশ করুক না কেনো, তাজমহলের দুই পাশে সব সময় একই জনিষের একটি করে আইটেম পড়বে। এমন কি গাছগুলিও।

 

এই ছবিতে আমার পিছনে যে বিশাল চত্তরটা দেখা যাচ্ছে, এর ঠিক মাঝখানেই একতা বড় পিতলের থালা আছে যেখানে অনায়াসেই ৬/৭ জন মহিলা একসাথে পানিতে সাতার কাটতে পারেন। এখানেই রানী শীতকালে তার সহচড়িদেরকে নিয়ে জল কেলী করতেন। এতো বছর আগেও তারা তাদের জীবনের সবটুকু আনন্দ করেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। রাজা বা সম্রাটের কাছ থেকে তারা আক্ষরীক অর্থে কতটুকু মহব্বত আর ভালোবাসা পেয়েছে সেটা জানতেন শুধুমাত্র এ সব রানীরা কিন্তু বাহ্যিক ভাবে যদি দেখা যায়, তারা হয়তো মনের কষ্টকে আরাল করেই দিন পার করেছে। এটাই বা কম কিসের?

যখন ফিরে আসছিলাম, অনেক ভাবনা মনে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো, এই মাত্র নবাবের সাথে আমরা দেখা করেই এলাম। কেনো মনে হচ্ছিলো এ রকম?