আমি গত কয়েকদিন যাবত করোনায় ভুগছি। সাথে আমার বড় মেয়েও। কিভাবে ঘটনাটা হলো তা আমার এখনো জানা নাই। সে ব্যাপারটা পরে আসছি। বড় ভাবী (অর্থাৎ লিখনের মা) গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। আজ তাকে মানিকগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়েছে মানিকগঞ্জ গোরস্থানে দাফন করার জন্য। আমি যেতে চেয়েছিলাম কিনা জানিনা, যেহেতু করোনায় ভুগছি, তাই কেহ আমাকে যেতেও বলে নাই। আর আমি যাওয়ার কোনো কারনও দেখিনা।বড় ভাবীর মৃত্যুর ঘটনায় আমার বেশ কিছু অব্জারভেশন চোখে পড়েছেঃ
ক। লিখন আমেরিকায় ভিসা জটিলতায় এমনভাবে আটকে আছে যে, লিখন ইচ্ছে করলে ওর মাকে দেখতে আসতে পারতো ঠিকই কিন্তু হয়তো আর আমেরিকায় ফিরে যেতে পারবে না। এই ভয়ে লিখন ওর মাকে আর দেখতেই এলো না। ওর মাকে দেখার চেয়ে হয়তো ওর আমেরিকায় থাকাটা জরুরী মনে হয়েছে বিধায় লিখন আর ওর মাকে শেষবারের মতো দেখতে আসে নাই। প্রথিবীটা অনেক ছোট, আর কে কখন কোথায় থাকবে এটার ফয়সালা আল্লাহর হাতে। আমেরিকাতেই থাকতে হবে আমি এটা বিশ্বাস করি না। এই বাংলাদেশেও অনেক বিখ্যাত মানুষেরা বাস করে এবং অনেক পয়সা ওয়ালারা বাস করে। আমেরিকা কোনো সর্গরাজ্য নয় যে ওখানেই সেটেল হতে হবে সব আত্তীয়সজন বাদ দিয়ে। এই যে, আজকে লিখন তার মাকে শেষবারের মতো ও দেখতে পারলো না, ওর মা লিখনের হাতের মাটিও পেলো না, এর কোনো মানে হয় না। আমি জানি না আমার মৃত্যুর সময় আমার বাচ্চারাও আমাকে দেখতে আস্তে পারবে কিনা কিংবা আমি ওদের হাতে মাটি পাবো কিনা, তবে আমি মনে করি এমন কোনো জটিল পরিস্থিতিতে যেনো আল্লাহ আমাকে বা আমার সন্তানকে না ফেলেন যে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় আমি আমার সন্তানদের কাছে না পাই।
খ। বড় ভাবী যখন করোনায় আক্রান্ত, তখন দেশে তার সব ছেলেরা ছিলো। মারুফ ছিলো, তুহীন ছিলো, মুবীন ছিলো, ইমন ছিলো, সবাই ছিলো। একমাত্র মুবীন সারাক্ষন হাসপাতালে ওর মার জন্য ডিউটি করেছে। আর বাকী ছেলেরা খুব একটা দেখতেও যেত না আবার হাসপাতালেও ছিলো না। যেহেতু মায়ের করোনা, তাই সবাই দূরে দূরেই ছিলো। খুবই হতাশার কথা হচ্ছে, যখন বড় ভাবী মারা গেলেন, তখন মানিকগঞ্জে তার লাশের সাথে কে যাবে, বা কারা যাবে এটা নিয়েও একটা কনফিউশন ছিলো। ইমন, তুহীন কিংবা মারুফ তারা ওর মায়ের সাথে যাবে কি যাবে না তারা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। লিখন দেশে থাকলে লিখন কি সিদ্ধান্ত নিতো সেটা আমি জানি না, তবে, খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হতো বলে আমার জানা নাই। বড্ড খারাপ লাগলো কথাতা শুনে যে, যে মা আজীবন ছেলেদের জন্য জীবন দিয়ে দিলো, যে মা এতোটা বছর ওদেরকে বুকে পিঠে মানুষ করলো সেই মাকে করোনায় মারা যাওয়ার কারনে মানিকগঞ্জে গোরস্থানে একমপ্যানি করবে কি করবে না সেটাই এখন সবচেয়ে যেনো বড় প্রশ্ন। আসলেই পৃথিবীটা খুবই সার্থপর একটা জায়গা। এখানে মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কারো কথাই সে ভাবে না।
গ। লিজি আপা যখন বিল্ডিং বা বাড়ি বানানোর জন্য তার বাবার সম্পত্তির উপর সবার কাছে অনুমতি চাইলেন, তখন সব ভাইবোনেরা রাজী থাকলেও শুধুমাত্র লিখনদের পরিবার লিজি আপাকে তার বাবার সম্পত্তি থেকে উতখাত করার জন্য একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিলো। লিখনের সাথে একজোট হয়েছিলো ওর স্ত্রী শিল্পীও, যদিও শিল্পি লিজি আপার আপন বোনের মেয়ে। লিজি আপার এই বাড়ি বানানো নিয়ে লিখন এবং তার পরিবার (বড় ভাবী সহ) এমন একটা সিচুয়েশ তৈরী করে ফেলেছিলো যে, তুহীন বলেছিলো- যদি লিজি ওখানে বাড়ি বানায়, তাহলে লিজিকে সে খুন করে ফেলবে, মারুফ বলেছিলো যে, লিজিকে সে লাথি লাথিতে ওখান থেকে বের করে দেবে, আর অন্যান্রা বলেছিলো, তারা কখনোই আর মানিকগঞ্জে যাবে না। ইত্যাদি। আমি আর মিটুল সব সময় চেয়েছি যে, লিজি আপা যেনো ওখানে বাড়িটা করে। এর জন্য আমি নেপথ্যে থেকে যতো প্রকার সাহাজ্য করার দরকার, আমি সেটাই করেছি। আজ ঠিক এই মুহুর্তে মানিকগঞ্জে লিজি আপার ৬ তালা বিল্ডিং সায় দাঁড়িয়ে। বড় ভাবীর মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ এমন সময় ওদেরকে মানিকগঞ্জে নিয়ে গেলেন যখন ওরা সবাই দেখল লিজি আপার ৬ তালা বাড়ি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, আজ সেই লিজি আপার বাড়িতেই সবার আশ্রয়। কি অদ্ভুদ না? আল্লাহ জুলুমকারীকে এবং অহংকারীকে কিছুতেই পছন্দ করেন না। সমস্ত দম্ভ ভেংগে দিয়ে আজ আল্লাহ এইসব সদস্যদেরকে একেবারে সেই লিজি আপার বাড়িতেই উঠাইলো। কিছু কি শিখতে পারলো ওরা?
ঘ। মজার ব্যাপার হলো, যেদিন লিজি আপা মানিকগঞ্জে বিল্ডিং এর কাজে হাত দিলেন, ঠিক সেই সময়ে লিখন আমেরিকায় গিয়েছিলো রুটিন ভিজিটে। কি এক অদৃশ্য শক্তিতে আল্লাহ লিখনকে ভিসা জটিলতায় এমনভাবে আটকে দিলো যে, লিখন আর বাংলাদেশেই আসতে পারলো না। লিখন বলেছিলো যে, সে যদি দেশে থাকে তাহলে লিজি আপা কিভাবে বাড়ি বানায় সেটা সে দেখে নেবে। লিজি আপার পিতার ভিটা, তার নিজের হকের জমি, লিখনের জমিও না, অথচ লিখনের এই রকম দাম্ভিকতা আল্লাহ নিশ্চয় পছন্দ করেন নাই। কোনো না কোনো অজুহাতে আল্লাহ ঠিক তার ম্যাকানিজমে একেবারে সুদুর আমেরিকায় এমন করে বন্দি করে দিলো যে, ওর বাংলাদেশের চাকুরীটাও আর নাই, আর আমেরিকায় ৭/১১ দোকান গুলিতে খুবই সস্তায় একটা জব করতে বাধ্য হলো। এই ঘটনাটা আর যে কেউ যেভাবেই দেখুক, আমি দেখি আল্লাহর ন্যায় বিচারের নমুনা।
ঙ। এখানে একটা কথা না বললেই না। মারুফের ছেলের বয়স মাত্র ৩ বছর। বড় ভাবী তার নায় নাতকুরের জন্য ছিলেন ডেডিকেটেড। সারাক্ষন তাদেরকে খাওয়ানো, পরানো, বাইরে নিয়ে গুরিয়ে আনা, কোথাও বেড়িয়ে আনা ইত্যাদি কাজগুলি খুব আদরের সাথে করতেন। আর তার নাতি নাতকুরেরাও বড় ভাবীর প্রতি খুবই ভক্ত ছিলো। কিন্তু যেদিন বড় ভাবীর করোনা ধরা পড়লো, ঠিক সেদিন থেকে মারুফের ৩ বছরের ছেলে মশারী তাংগীয়ে যে এক ঘরে বসে গেলো, ভুলেও সে আর তার দাদীর কাছে আসে নাই। সে বারবার বলতো যে, সে করোনায় ভয় পায় এবং সে তার দাদীর কাছে আসতে চায় না। বড় ভাবীর মরার আগ পর্যন্ত এই অবুঝ বাচ্চাটাও আর ভাবীর কাছে আসে নাই। কি নির্মম তাই না?
যাই হোক, আমি এই কথাগুলি বলে কাউকে ছোট করতে কিংবা আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দিয়েছেন এটা ভাবি না। শুধু ভাবী যে, মানুষের উচিত বান্দার হক সব সময় ফিরিয়ে দেয়া। এ জগতে কেউ থাকে না, থাকবেও না। কিন্তু আজ যে কর্মগুলি আমরা রেখে গেলাম, সেটার ফলাফল সে পাবেই।
এইমাত্র মিটুল বড় ভাবীর দাফনের পর বাসায় এলো। বেশ কিছু জানতে ইচ্ছে করল। যেমন, লিখন আমেরিকায় আছে, ওর মা মারা গেলেন, লিখন কি রকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, ছটফট করেছে কিনা, না আসার কারনে, কিংবা অনেক মন খারাপ করে ওর মার জন্য কান্নাকাটি করছে কিনা ইত্যাদি। মিটুল জানালো যে, যখন ভাবীকে দাফনের নিমিত্তে কবরে নামানো হবে, তখন অনেকেই ভাবীকে দেখার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো। কেউ কেউ আবার ভিডিও ও করেছিলো। ওই সময় নাকি ইমন এবং মুবীন লিখনকে ফোন করে জানিয়েছিলো লিখন ভাবীর ভিডিও দেখতে চায় কিনা, কিংবা কিছু বলতে চায় কিনা। লিখন নাকি উত্তর দিয়েছিলো যে, সে কনো কিছুই দেখতেও চায় না, না ওর ছেলেমেদেরকে দেখতে দিতে চায়। এই ব্যবহারের অর্থ শুধু জানে লিখন। যাই হোক, ইতিহাস এটাই।
আজ থেকে হাসমত আরা (ভাবীর নাম) নামে কোনো মহিলার আনাগোনা এই দুনিয়া থাকলো না। কয়েকদিন সবাই তাকে নিয়ে হয়তো গল্প করবে, হাহুতাশ করবে, কেউ কেউ হয়তো তার অভাব ফিল করবে, কেউ আবার তার কথা ভুলেই যাবে। সময় তাকে আরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এক সময় হাস মত আরা নামে কোনো মহিলা এই দুনিয়ায় ছিলো এটাই কেউ জানবে না। মানিকগঞ্জের বাড়িই বা কি, সন্তানই বা কি কোনো কিছুই আর নাই। এটাই জীবন। জীবন সব সময় মৃত্যুর কাছেই পরাজয় বরন করেছে, আর করবেও। বড় ভাবী এখন ৩ হাত মাটির নীচে অন্ধকার কবরে একা এবং তার সাথে আর কেহই নাই। না তার সাধের বিছানা, না নায় নাতকোর, না আমেরিকার কোন সুসংবাদের কাহিনী।
আমি সব সময় মৃত মানুষের জন্য দোয়া করি। ভাবীর জন্যেও আমি দোয়া করি। তার উপরে আমার কোনো রাগ নাই।