কোনো একটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজের দেশের কারেন্সী বাদে অন্য ফরেন কারেন্সীকে সঞ্চয়ী হিসাবে গচ্ছিত রাখাকেই ফরেন রিজার্ভ বা ফরেন কারেন্সী রিজার্ভ বলে। যেসব মুল কারনে এই ফরেন মুদ্রা তহবিলে রাখতে হয় তার মুল কারন হচ্ছে-দেশের লোকাল মুদ্রার ভ্যালুকে ফিক্সড রেটে রাখা, ক্রাইসিস সময়ে লিকুইডিটি হিসাবে ইনফ্লেশনকে কমানো, বিদেশী ইনভেষ্টরদের নিশ্চিত দান, বৈদেশিক লোন পরিশোধ, আমদানী পেমেন্ট, অপ্রত্যাশিত কোনো বড় বাজেট অন্য কোথাও কাজে লাগানো ইত্যাদি।
এই রিজার্ভ সাধারনত ব্যাংক নোট, ডিপোজিট, বন্ড, ট্রেজারী বিল এবং সরকারী অন্যান্য সিকিউরিটিজের মাধ্যমে রাখা হয়। বেশীর ভাগ রিজার্ভ সাধারনত ইউএস ডলারের মাধ্যমেই গচ্ছিত থাকে কারন বর্তমানে ইউএস ডলারই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গ্রহনযোগ্য গ্লোবাল কারেন্সী। চীনের সবচেয়ে বেশী রিজার্ভ আছে ইউএস ডলারে।
প্রধানত দেশের রপ্তানিকারকেরা এবং ২য়ত শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক রেমিট্যান্স ইত্যাদি সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হয়, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক উক্ত ফরেন কারেন্সী রপ্তানীকারক, শ্রমিক কিংবা যারাই ডলার দেশে আনেন তাদেরকে লোকাল কারেন্সীতে প্রদান করে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা কিনে নেয়। এভাবেই রিজার্ভ বেড়ে উঠে।
ন্যনুতম সাধারনত তিন থেকে ছয় মাসের আমদানী বিলের গড় এবং প্রায় এক বছরের বৈদেশিক লোন পরিশোধের পরিমান রিজার্ভ থাকলেই মুটামুটি একটা দেশে চলে। তবে যার যতো বেশী রিজার্ভ তাদের দেশের কারেন্সী ততো স্থির। (বর্তমানে চীনের এই রিজার্ভ পরিমান প্রায় ৩২০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার, যেখানে রাশিয়ার আছে প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন) ।
যদি কোনো দেশের রিজার্ভ এতোটাই কমে যায়, বা না থাকে তাহলে সে দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় ধরনের ধ্বস নামে। সে দেশে যদি অনেক গোল্ড কিংবা ন্যাচারাল রিসোর্সও থাকে কিন্তু লিকুইড রিজার্ভ সঞ্চয় হিসাবে না থাকে, তাহলেও সেই গোল্ড বা ন্যাচারাল রিসোর্স দিয়ে রিজার্ভের উদ্দেশ্য পুরন করা সম্ভব হয় না।
এবার আসি, ডলার কেনো রিজার্ভ কারেন্সী- নীতিগতভাবে যে কোনো দেশের লোকাল কারেন্সীই হতে পারে এই রিজার্ভের কারেন্সী। কিন্তু তা সম্ভব হয় না এই কারনে যে, সেই লোকাল কারেন্সীতে বিশ্ব ব্যাপি ট্রেড হয় না। গ্লোবাল কারেন্সি হতে হয় সেটা যেটায় সবচেয়ে বেশী ট্রেডিং হয়। বর্তমানে ডলার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত একটা কারেন্সী বিধায় এটা গ্লোবাল কারেন্সী হিসাবে গন্য হয়, তারপর গন্য হয় ইউরো, এবং ৩য় স্থানে আছে জাপানের ইয়েন।
২০১৯ ৪র্থ কোয়াটারের আইএমএফ এর এক সুত্র অনুযায়ী ৬০% ইউ এস ডলার রিজার্ভ হিসাবে ছিলো। এর পরেই ছিলো ইউরোর স্থান যা প্রায় ২০%। প্রায় ৯০% ফরেক্স ট্রেডিং ইউ এস ডলারের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। আন্তর্জাতিক ১৮৫ টি মুদ্রার মধ্যে ডলার হচ্ছে একটি।
১৯৪৪ সালের আগে বেশীরভাগ দেশ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের মাধ্যমে ট্রেডিং করতো। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে (তখনো যুদ্ধ চলছিলো), ৪৪ দেশের ৭৩০ জন ডেলিগেটস আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারর নিউ উডস এর হোটেল বিটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রাকে মনিটরিং সিস্টেমে আনার জন্য মিটিং করে। সেখানে The Breton Woods system required countries to guarantee convertibility of their currencies into U.S. dollars to within 1% of fixed parity rates, with the dollar convertible to gold bullion for foreign governments and central banks at US$35 per troy ounce of fine gold (or 0.88867 gram fine gold per dollar). অর্থাৎ সব দেশের কারেন্সীর এক্সচেঞ্জ রেট গোল্ডে না হয়ে ডলারের উপর করা হবে। সে সময়ে সবচেয়ে বেশী গোল্ড রিজার্ভ ছিলো আমেরিকার। ১৯৭১ সালে এসে বিভিন্ন দেশ তখন গোল্ডের বিপরীতে রাখা ডলার আবার গোল্ড দাবী করলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন গোল্ড এবং ডলারকে আলাদা করে ডলারকে Fiat Currency হিসাবে ডিক্লেয়ার করেন যাতে ডলারকে আর গোল্ডের বিপরীতে ব্যাকিং করতে হবে না। কিন্তু ইতিমধ্যে এই ২৭ বছরে ডলার রিজার্ভ কারেন্সী হিসাবে প্রচলন হয়েই গেছে। (আমি Fiat কারেন্সীর ব্যাপারে এর আগে একবার লিখেছিলাম (Fiat Currency হচ্ছে সেই কারেন্সী যা কোনো কমোডিটি বা গোল্ড দ্বারা ব্যাকড নয়, বরং ইস্যুইং সরকার এটাকে লিগ্যাল টেন্ডারিং হিসাবে গ্যারান্টি দেয়)
যাই হোক যে কারনে এই লেখাটা।
আমরা ইদানিং প্রায়ই একটা কথা শুনে থাকি এবং বলেও থাকি। সেটা হলোঃ ডি-ডলারাইজেশন। এর মানে কি ডলারকে বের করে দেয়া? বা ডলারের দিন শেষ?
ব্যাপারটা এ রকম নয়। এটা যা বুঝায় তা হচ্ছে- ডলার ডিক্লায়েন। মানে ডলার কলাপ্স নয়। ডলারের ডিক্লাইনেশন ইতিমধ্যে শুরু অবশ্যই হয়েছে কিন্তু ডলার কখনোই কলাপ্সড করবে এটা ভাবাও উচিত না। আর সেটা কিভাবে?