আমার একটা জিনিষ কিছুতেই বুঝে আসে না যে, নিষেধাজ্ঞা কি আসলেই কোনো কাজ করে? হ্যা, করতো যদি সারা দুনিয়ার দেশগুলি একসাথে সেই সিদ্ধান্তে এক থাকে। সেটা যে কোনো ক্ষমতাশীল দেশের জন্যে অবশ্যই বিপদজনক। কিন্তু সারা দুনিয়া কি এক সাথে এই নিষেধাজ্ঞায় কাজ করছে? করছে না। তাহলে দেখি-কতগুলি দেশ এবং কত জনসংখ্যার মানুষ এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে?
সারা দুনিয়ায় দেশ আছে ১৯৫টি। ইউরোপেই আছে ৪৪ দেশ। ইউরোপের ৪৪টি দেশের মধ্যে ইইউ এর অধীনে আছে ২৭টি দেশ। বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাধ্যমেই শুধু রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে, পুরু ইউরোপের মাধ্যমে কিন্তু নয়। এরমানে ইইউ, আমেরিকা, ইউকে আর কানাডা মিলে মাত্র ২৯টি দেশ নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। ২৭টি ইইউ দেশের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন। আর পুরু ইউরোপ জুড়ে জনসংখা ৭৫০ মিলিয়ন। অর্থাৎ ইউরোপেই প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেয় নাই। ইউরোপের বাকী ১৭টি দেশ এবং ৩০০ মিলিয়ন লোক রাশিয়ার বিরুদ্ধে নয় ধরে নেয়া যায়। অন্যদিকে অর্থাৎ সারা দুনিয়ার আরো ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ১৬৫টি দেশ নিষেধাজ্ঞা দেয় নাই।
সারা দুনিয়ায় মানুষের সংখ্যা ৮ বিলিয়ন বা ৮০০০ মিলিয়ন। এই ৮ হাজার মিলিয়ন থেকে মাত্র ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্লাস আমেরিকা কানাডা আর ইউকে মিলে ৪৫০ মিলিয়ন মানুষের দেশসমুহ রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বাকি ৭৫৫০ মিলিয়ন মানুষের দ্বারা রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা পায় নাই। অর্থাৎ মাত্র ৫%+ এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাকী ৯৫% রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞায় রাখে নাই। এতো বিশাল জনগোষ্ঠীর মার্কেটিং, অপুরচুনিটি তো অবাধ!! তারমধ্যে রাশিয়া নিজেই কিছু কিছু জায়গায় খুব শক্ত অবস্থানে যেমন খাদ্য সামগ্রী, ইউরেনিয়াম, গোল্ড, ডায়মন্ড, তেল, গ্যাস, আয়রন, কয়লা, প্লাটিনাম, নাট্রোজেন ফার্টিলাইজার, কপার, কাঠ, ক্যামিকেল ফার্টিলাইজার (ফসফরাস, পটাশিয়াম) এ তারা সয়ং সম্পুর্ন এবং এক্সপর্ট করে। রাশিয়ার এইসব পন্যের উপর সারা দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশ সমুহ কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। সেই সব দেশ সমুহের মানুষেরা অযথা ইউক্রেনের উপর এতো আবেগিত হয়ে তাদের নিজের ক্ষতি করার মতো পাগল এখনো হয় নাই। তারমানে, রাশিয়ার বাজার ৯৫% লোকের জন্য উম্মুক্ত।
এবার আসি, এই ইউরোপিয়ান দেশগুলির মধ্যে শক্তিধর দেশ হিসাবে কারা কারা। বলা হয় ফ্রান্স, জার্মানী এবং ইতালী হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মেরুদন্ড। এবার দেখি এদের মেরুদন্ডের শক্তিটা কত। ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২ এর হ্যান্স এন্ড ম্যাট কোর্ডার হিসাব মতে মোট ৯টি দেশে নিউক্লিয়ার অস্ত্র আছে-পাকিস্তান (১৬৫), ভারত (১৬০), ইসরায়েল (৯০), ফ্রান্স (২৯০), আমেরিকা (৫৪২৮), ব্রিটেন (২২৫), রাশিয়া (৫৯৭৭), চায়না (৩৫০) এবং নর্থ কোরিয়া (২০)। ইরানের ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার নয়। রাশিয়া এবং আমেরিকা একত্রে মোট ৯০% নিউক্লিয়ার অস্ত্র আছে আর বাকী ১০% আছে বাকি ৭টি দেশে। এরমানে ফ্রান্সের আছে ২৯০টি নিউক, জার্মানীর নাই, ইতালীর নাই। এটা হচ্ছে প্রধান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মেরুদন্ড।
একটা কথা সবার জানা থাকা দরকার যে, আমেরিকা, ব্রিটেন, এবং কানাডা কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অংশ নয় এবং তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যও না। কানাডা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে স্ট্রাটেজিক পার্টনার, ইউকে ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে, আমেরিকা ইউরোপের অংশই না। হ্যা, তারা ন্যাটোর সদস্য। ন্যাটো আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এক কথা নয়। ফলে ইউরোপিয়ানের শক্তি শুধু জার্মান, ফ্রান্স আর ইতালী যাদের শুধুমাত্র ফ্রান্সের ২৯০ টি নিউক আছে। সম্বল এটাই।
অন্যদিকে যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের না হয়েও ন্যাটোর সদস্য আমেরিকা আর ইউকে, তাই ন্যাটোর সদস্য হিসাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের থেকে ন্যাটোর নিউক বেশী। তারমানে এটা ইউরোপের সম্পদ না। একটা ডায়ালগ প্রায়ই শুনে থাকবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা ইউকে প্রেসিডেন্টের মুখে যে, আমরা ন্যাটোভুক্ত দেশের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবো, এটা বলে না যে, আমরা ইউরোপের প্রতিটা দেশের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবো।
আমেরিকার নিউক্লিয়ার অস্ত্র বেলজিয়াম, জার্মানী, ইতালি, তুরুষ্কের সাথে ন্যাটোর অংশ হিসাবে শেয়ার্ড করা। এরমানে হচ্ছে আমেরিকার বেশ কিছু নিউক্লিয়ার অস্ত্র এসব দেশে মোতায়েন করা আছে যেগুলির কন্ট্রোল আমেরিকার কাছে তবে ন্যাটো দেশ যাদের নিউক নাই তারা এগুলিতে ট্রেনিং নেয়। ব্যাপারটা বিকন্দ্রিকরনের মতো। রাশিয়া, চায়না, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান আর নর্থ কোরিয়া মিলে মোট নিউক আছে ৬৬৭২। তারা সেগুলি পূর্ন কন্ট্রোলে রেখেছে, বিকন্দ্রীকরন করে নাই। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইউকে, ইসরায়েল মিলে নিউক আছে ৬০৩৩ টি। ইসরায়েল এই যুদ্ধে নিউক ইউজ করবে না কারন তার ভয় ইরান। ফলে ইসরায়েল বাদ গেলে ন্যাটোর কাছে মোট নিউক আছে ৫৯৪৩। যদি অনুপাত করি তাহলে দাঁড়ায়, (1) : (0.88)
শুধুমাত্র এই শীতকাল যদি রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতে পারে, তাহলে মনোপলিজম এর মতো ইউনিপোলারিটির একচ্ছত্র রাজত্তের অবসান হবে, পেট্রো ডলারের রাজত্ব হারিয়ে যাবে, সারা দুনিয়ার হিসাব কিতাব অনেক বদলে যাবে।
এবার যেহেতু গোল্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা এসছে, এর প্রভাব সবচেয়ে ভাল পাবে অন্যান্য দেশ, আর নেগেটিভিটিতে থাকবে হেজিমুনিয়াল কারেন্সী ডলার এবং ইউরো। এটা নিয়ে আরেকদিন লিখবো।