৯ কার্তিক ১৩৯৩
আজ থেকে প্রায় ৫ মাস আগে মীরপুরে যে মেয়েটির সাথে আমার সারারাত টিভি দেখা হয়েছিলো, সেই মেয়ে, মিটুল, তার কাছ থেকে আজ আমি একটা চিঠি পেলাম। আমার জীবনে আজ পর্যন্ত যে কয়টি মেয়ে চিঠি লিখেছে, তার মধ্যে সে দ্বিতীয়। প্রথম জন ছিলো কার্লা। এই কার্লার সাথে আমার চিঠি আদান প্রদান হয় প্রায় ৪ বছর। কোনো ক্লান্তি বোধ করি নাই। বারবার মনে হয়েছে, আমি কখনোই যেনো ক্লান্ত হবো না। কিন্তু শেষ অবধি তার যবনিকা হয়েছে কোনো এক মর্মান্তিক শোকের মাধ্যমে। আমি সেই গল্পটা কখনই কাউকে বলতে চাই না।
চিঠিটি পেয়ে প্রথমেই ভরকে গেলাম। আমি এটা receive করতে দ্বিধা বোধ করছিলাম কারন মিতুল নামে আমি কাউকে চিনিনা। তবুও receive করলাম এবং এটার কারনও ছিল। কারন হল মিতুল নামের ঠিক নিচেই Jahangir Nagar University লেখা ছিল। আর আমি Jahangir Nagar University তে ভর্তি হয়েছে এমন একজনকে চিনি, সেটা হল আসমা। যার কথা আমি আগেও লিখেছি। সত্যি তাই হল চিঠি খোলার পর। মিতুলই আসমা।
খুব সুন্দর চিঠি লিখেছে সে কিন্তু অতি সামান্য কথা।
“ঠিকানা ছিল না আপনাকে দেবার মত, তাই চিঠি লিখতে পারিনি। নিশ্চয়ই ভুলে যান নাই। চিঠি লিখলে খুশী হব। আমাকে লেখার ঠিকানা দিলাম। চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।“
উপরে নীচে কোথাও কোনো সম্বোধন নাই। আমি কি বন্ধু, নাকি ভাই, নাকি প্রিয় কেউ, কিছুই উল্লেখ নাই। এলাকার ভাই হলে এক কথা, নাও না। আবার প্রিয় কেউ হলে অন্য রকমের সম্বোধন হবে। আর ও ট আমার বন্ধু হয়েই উঠেনাই এখনো। হয়তো সময়ই বলে দেবে কি সম্বোধন হবে কোনো এক সময়।
আসলে মিতুলকে আমি প্রথম দিন যতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম ও তার থেকেও বেশি বাস্তববাদী । আর একারনেই ও আমাকে নির্ভয়ে চিঠি লিখেতে পেরেছে। বাংলাদেশটা এখনো অতটা আগায় নাই যেঁ ইচছে করলেই একটা মেয়ে নির্ভয়ে অন্য একটি ছেলেকে চিঠি লিখেতে পারে। এটা একটা সাহসের ব্যপার। এ সমাজে আমরা যারা বাস করি, হয়ত এটা আগের শতাব্দির বা যুগের থেকে অনেক এগিয়ে আছে কিন্তু এর মানে এই নয় যে, প্রকাশ্যে আমরা এতা বলার সাহস করতে পারি যে, আমি অমুককে ভালোবাসি, অথবা অমুক আমাকে ভালবাসে। হয়ত এমন একটা যুগ সামনে এম্নিতেই আসবে যখন বাবা-মাই জিজ্ঞেস করবে, কেনো তাদের বাচ্চাদের কোন প্রিয় মানুষ নাই। এখন যেমন প্রিয় মানুষ থাকলে বাবা মায়েরা, অভিভাবকেরা অসস্থিতে ভোগেন, হয়ত এমন একটা সময় আসবে যখন বাবা মায়েরা কেনো তাদের প্রিয় মানুষ নাই তার জন্য অসস্থিতিতে ভোগবেন। আর এটাই হচ্ছে সময়ের বিবর্তন।
মিটুল আমাকে চিঠি লিখতে পারে নাই কারন তাকে আমার চিঠি যাওয়ার কোনো ঠিকানা সে দিতে পারে নাই। ওর বাসায় আমার চিঠি যাক, এতা যেমন ওর জন্য সস্থিদায়ক নয়, তেমনি আমার জন্যেও নয়। আর এখন যেহেতু সে ইউনিভার্সিটির হলে থাকছে, ফলে ঠিকানা একটা তো পাওয়াই গেলো যেখানে সব কিছুই রক্ষা হয়। যোগাযগের ব্যাপারটা থাকলো কিন্তু বাড়িতে গোপন রইলো। ব্যাপারটা এটাই ঘটেছে ওর বেলায়।
আমাদের বাড়ীর অথবা মিতুলদের বাড়ীর কেউ এখনো জানে না আমাদের এই যোগাযোগের ব্যাপারটা । আমি জানি তারা কেউ এইসব ব্যাপারে জানলে খুব একটা খুশিও হবে না। আর এ ব্যাপারে আমিও খুব একটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নই। কারন আমি আমার পরিবারকে চিনি, আমি বদি ভাইকে চিনি, আমি হাবিব ভাইকে চিনি, তারা আর যাই হোক হিটলারের বংশধর ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু আমি আগাগোড়া নিজের পছন্দেই কাজ করতে ভালোবাসি। আমার মতামতকে আমি সম্মান করি। তাতে অন্য কারো মতামত আমাকে আমার মতামতের উপরে স্থান দেবো সেটা সাবজেক্টের উপর নির্ভর করে। মিটুলের ব্যাপারতা নিয়ে আমি কোনভাবেই দিধাগ্রস্থ নই। কেউ যদি জানেও, আমার এইটুকুন সাহস আছে তা মুখুমুখি হবার।
মিতুল সম্পরকে আমার কিছু মন্তব্য আমি আগেই করেছিলাম যদিও আমি তাকে মাত্র একটা পুরা রাত দেখেছি, একসাথে বসে টিভি দেখেছি। তাতে আমার যে ধারনাটা হয়েছে সেতা আবারো বলি, সে একেবারেই একটা সাধারন গোছের কঠিন প্রত্যয়ের মানুষ। প্রশংসায় খুশী হয়ত হয় কিন্তু সে নিজে জানে কোন প্রশংসা তার জন্য অতিরঞ্জিত আর কোন প্রশংসা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। গা ভাসিয়ে দিয়ে আপ্লুত হবার মেয়ে সে নয়। তার মধ্যে আরো একটা গুনাবলী আমি মার্ক করেছি যে, অযাচিত ভাবে কারো ব্যাপারে মন্তব্য করাকে তার পছন্দের মধ্যে পড়ে না। অল্পতেই খুসী থাকার চেষ্টা করে। বলতে গেলে একটু সাহস রাখে সব কিছুতেই। এদেশের অধিকাংশ মেয়েরা হয় বাবা মায়ের নাম বেচে তার অস্তিত্ব জানান দেয়, অথবা যাদের নাই, তারা নিজেকে প্রতিষ্টিত করার চেষতা করে। আমার কাছে মনে হয়েছে মিটুলের ব্যাপারে দ্বিতীয়টা খাটে।
যাই হোক, অনেকদিন পর ওর চিঠি পেয়ে আমারো অনেক ভাল লাগছে, মনে হচ্ছে আমি ওর চিঠির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। আজ সে চিঠিটা এসেছে। আমি কি ওকে খুজছিলাম? আমি আসলে কাকে খুজছিলাম? আমি ওর জন্যে বা ওর চিঠির জন্য কতোটা অপেক্ষায় ছিলাম, সেটা এই চিঠি পাবার আগে অতোটা খুচিয়ে দেখিনি, তবে মনে হলো, আমি অনেক অনেক খুশি হয়েছি।
কিছু কিছু কথা আমার মাঝে মাঝে “কাকে” যেন বলতে ইচছে করে। কিন্তু সেই “কাকে” পাই কোথায়? বড় বউদিকে মাঝে মাঝে বলি কিন্তু সব কি আর তার সাথে বলা যায়? কখন কখন এমদাদ কে শেয়ার করি, কিন্তু সে তো আর সেই “কাকে” নয় ।
মিতুল অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। আমি কেমন আছি, আমার দিন কেমন যাচ্ছে, ইত্যাদি। কি জানাবো ওকে? আমি যদি বলি, আমি ভাল নেই, কি হবে এতে? আমি যদি বল, আমি মাঝে মাঝে হারিয়ে যাই, কিভাবে নেবে সে? আমি যদি বলি, আমি কাওকে ভালবাসতে চাই, কি করতে পারবে সে? আমি সেই “কাকে” চাই। ও কি সেই “কাকে”?
তারপরেও আমি ওকে চিঠি লিখব।