প্রায় ১৫ দিনের একটা সফর ছিল। আমি, আমার স্ত্রী, আমার বড় মেয়ে এবং বড় মেয়ের জামাই ডাঃ আবীর। খুব সুন্দরভাবেই আমরা সবাই একসাথে এবারের ওমরাটা করতে পেরেছি। আল্লাহ সুস্থ্য রেখেছিলেন। এর আগেও হজ্জ এবং ওমরা করেছিলাম, এবারের ওমরাটা যেনো আমার কাছে ছিলো ভিন্ন একটা অনুভুতি। হেরেম শরিফে নামাজে দাড়িয়ে তাবত মুসলিম মানুষের জন্য আমার দোয়া ছিল, আমার সকল জানা অজানা বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য দোয়া করেছি, এমন কি যারা আমাকে কোনো না কন কারনে পছন্দ করেন না বা আমাকে ফাকি দেন, আমি তাদের জন্যেও দোয়া করেছি। আমার বাবা মা, ভাই বোন, শশুড় শাশুড়ি, খালা খালু, দাদা দাদি, মামা মামি, চাচা চাচী, জেঠা জেঠি, আমার স্ত্রীর পরিবারের সবার জন্য, যারা বিগত হয়েছেন তাদের জন্য, যারা আগামিতে আসবেন তাদের জন্য, আর যাদের জন্য দোয়া করার কেউ নাই তাদের জন্যেও আমি প্রান ভরে দোয়া করেছি। আমার সুস্থ্যতার জন্য দোয়া করেছি, আমার অজান্তে কনো অপরাধ ক্ষমার জন্য দোয়া করেছি, হালাল রিজিকের জন্য দোয়া করেছি, প্রানভরে সব কিছুর জন্য দোয়া করেছি। আর দোয়া করেছি যে কন অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেন আমি সটিক থেকে তার প্রতিবাদ করতে পারি সেই দোয়াও করেছি। মানুষের উপকার করার মানসিকতা যেন আমার আরো উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি হয় সে দোয়াও করেছি। দোয়া করেছি- আমার দ্বারা যেন কখনো কন মানুষের ক্ষতি না হয় এবং যারা আমার ক্ষতি করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে দাবি রেখেছি।
এই ওমরায় আমি খুব বেশী করে নিজের মনে এই অনুভুতিটা আনার চেষতা করেছি যে, আমি যে সব জায়গা দিয়ে হেটে গিয়েছি, সেইসব জায়গা দিয়ে আমাদের নবী, অন্যান্য খলিফারা কিংবা অনেক বুজুর্গ মানুশ যারা আল্লাহর আশির্বাদ পেয়ে ক্ষমা পেয়েছেন তারা হেটেছেন, এই অনুভুতিটা আমার প্রতিটা কদমে কদমে অনুভুত হয়েছে। আমি যেন তাদের কাফেলার সাথেই হেটেছি।
নবীর রওজায়র পাশে আমি অহেতুক অনেক ঘুরা ফেরা করেছি, সেই এলাকার চত্তর দিয়েও আমি বহুবার হেটে গিয়েছি আর ভেবেছি, এই জায়গার কোথাও না কোথাও আমার নবির পদধুলী ছিলো যেখানে কখন আমি সেজদায় পড়েছি, কখনো একা বসে ভেবেছি সেই দিন গুলির কথা যখন নবিজি জীবিত ছিলেন এবং তিনি তার সাহাবীদের নিয়ে এদিক সেদিক হয়ত পদধুলি দিয়েছেন। আমি প্রতিদিন নামাজের আজানের সময় যখন ‘আশহাদু আন্না মোহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ” বলে আজানের আওয়াজ শুনেছি, আমি ততোবার নবির রওজায় মবারকের দিকে তাকিয়ে শুধু এতাই বলেছি, আমি সাক্ষি দিচ্ছি ঠিক এই রওজার পাশে বসে, আমার নবী হজরত মোহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসুল এবং আমি তার উম্মত। বারবার তার র ওজা মোবারকের দিকে তাকিয়ে যেন এই উপলব্ধিতা হচ্ছিল-হ্যা তিনি আমাকে দেখছেন, আমি হয়তো তাকে দেখছি না, কিন্তু তিনি আমার মনের এই সাক্ষীটা তিনি সাদরে গ্রহন করছেন। আমার মন ভরে উঠছিলো বারবার।
আমি হেরেম শরীফের সামনে গিয়েও যখন আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামাজে মাথা নত করছিলাম, বারবার যেন এতাই মনে হয়েছে-আমি আল্লাহর বিশাল পায়ের নীচে আমার মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা যেনো অনুভব করছিলাম। যেনো তার চরনটা আমার কপালে ঠেকে আছে। প্রতিটি নামাজের শেষে জানাজা নামাজ হচ্ছে। একজন নয় অনেকের জানাজা একসাথে। কে জানে আমার তো জানাজা এখানেই হতে পারতো। এই মৃত্যু নিয়ে কুয়েতি এক বরেন্য লেখকের লেখাটা আমার মনে পড়তো প্রতিদিন। সে লিখেছিলো;
"মৃত্যু নিয়ে আমি কোনো দুশ্চিন্তা করবো না, আমার মৃতদেহের কি হবে সেটা নিয়ে কোন অযথা আগ্রহ দেখাবো না। আমি জানি আমার মুসলিম ভাইয়েরা করণীয় সবকিছুই যথাযথভাবে করবে।"
তারা প্রথমে আমার পরনের পোশাক খুলে আমাকে বিবস্ত্র করবে, আমাকে গোসল করাবে, তারপর আমাকে কাফন পড়াবে, আমাকে আমার বাসগৃহ থেকে বের করবে, আমাকে নিয়ে তারা আমার নতুন বাসগৃহের (কবর) দিকে রওনা হবে, আমাকে বিদায় জানাতে বহু মানুষের সমাগম হবে, অনেক মানুষ আমাকে দাফন দেবার জন্য তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম কিংবা সভার সময়সূচী বাতিল করবে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ মানুষ এর পরের দিনগুলোতে আমার এই উপদেশগুলো নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করবে না, আমার (ব্যক্তিগত) জিনিষের উপর আমি অধিকার হারাবো, আমার চাবির গোছাগূলো, আমার বইপত্র, আমার ব্যাগ, আমার জুতোগুলো, হয়তো আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে উপকৃত করার জন্য আমার ব্যবহারের জিনিসপত্র দান করে দেবার বিষয়ে একমত হবে, এ বিষয়ে তোমরা নিশ্চিত থেকো যে, এই দুনিয়া তোমার জন্য দু:খিত হবে না অপেক্ষাও করবে না, এই দুনিয়ার ছুটে চলা এক মুহূর্তের জন্যও থেমে যাবে না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা ব্যবসাবাণিজ্য সবকিছু চলতে থাকবে, আমার দায়িত্ব (কাজ) অন্য কেউ সম্পাদন করা শুরু করবে, আমার ধনসম্পদ বিধিসম্মত ভাবে আমার ওয়ারিসদের হাতে চলে যাবে, অথচ এর মাঝে এই সম্পদের জন্য আমার হিসাব-নিকাশ আরম্ভ হয়ে যাবে, ছোট এবং বড়….অনুপরিমাণ এবং কিয়দংশ পরিমান, (সবকিছুর হিসাব)।
আমার মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম যা (হারাতে) হবে, তা আমার নাম!!! কেননা, যখন আমি মৃত্যুবরণ করবো, তারা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, কোথায় “লাশ”? কেউ আমাকে আমার নাম ধরে সম্বোধন করবে না, যখন তারা আমার জন্য (জানাযার) নামাজ আদায় করবে, বলবে, “জানাযাহ” নিয়ে আসো, তারা আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করবে না….!
আর, যখন তারা দাফন শুরু করবে বলবে, মৃতদেহকে কাছে আনো, তারা আমার নাম ধরে ডাকবে না…! এজন্যই দুনিয়ায় আমার বংশপরিচয়, আমার গোত্র পরিচয়, আমার পদমযার্দা, এবং আমার খ্যাতি কোনকিছুই আমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে, এই দুনিয়ার জীবন কতই না তুচ্ছ, আর, যা কিছু সামনে আসছে তা কতই না গুরুতর বিষয়… অতএব, (শোন) তোমরা যারা এখনো জীবিত আছো,….জেনে রাখো, তোমার (মৃত্যুর পর) তোমার জন্য তিনভাবে দু:খ করা হবে,
১. যারা তোমাকে বাহ্যিক ভাবে চিনতো, তারা তোমাকে বলবে হতভাগা,
২. তোমার বন্ধুরা বড়জোর তোমার জন্য কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন দু:খ করবে, তারপর, তারা আবার গল্পগুজব বা হাসিঠাট্টাতে মত্ত হয়ে যাবে,
৩. যারা খুব গভীর ভাবে দু:খিত হবে, তারা তোমার পরিবারের মানুষ, তারা এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, একমাস, দুইমাস কিংবা বড় জোর একবছর দু:খ করবে। এরপর, তারা তোমাকে স্মৃতির মণিকোঠায় যত্ন করে রেখে দেবে!!!
মানুষদের মাঝে তোমাকে নিয়ে গল্প শেষ হয়ে যাবে, অত:পর, তোমার জীবনের নতুন গল্প শুরু হবে, আর, তা হবে পরকালের জীবনের বাস্তবতা, তোমার নিকট থেকে নি:শেষ হবে (তোমার):
১. সৌন্দর্য্য
২. ধনসম্পদ
৩. সুস্বাস্থ্য
৪. সন্তান-সন্তদি
৫. বসতবাড়ি
৬. প্রাসাদসমূহ
৭. জীবনসঙ্গী
তোমার নিকট তোমার ভালো অথবা মন্দ আমল ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, শুরু হবে তোমার নতুন জীবনের বাস্তবতা, আর, সে জীবনের প্রশ্ন হবে: তুমি কবর আর পরকালের জীবনের জন্য এখন কি প্রস্তুত করে এনেছো? ব্স্তুত: এই জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে তোমাকে গভীর ভাবে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন, এজন্য তুমি যত্নবান হও,
১. ফরজ ইবাদতগুলোর প্রতি
২. নফল ইবাদতগুলোর প্রতি
৩. গোপন সাদাকাহ’র প্রতি
৪. ভালো কাজের প্রতি
৫. রাতের নামাজের প্রতি
যেন তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পারো….
তুমি কি জানো কেন মৃতব্যক্তিরা সাদাকাহ প্রদানের আকাঙ্খা করবে, যদি আর একবার দুনিয়ার জীবনে ফিরতে পারতো? আল্লাহ বলেন: ((হে আমার রব! যদি তুমি আমাকে আর একটু সুযোগ দিতে দুনিয়ার জীবনে ফিরে যাবার, তাহলে আমি অবশ্যই সাদাকাহ প্রদান করতাম….)) তারা বলবে না,
উমরাহ পালন করতাম,
অথবা, সালাত আদায় করতাম,
অথবা, রোজা রাখতাম,
আলেমগণ বলেন: মৃতব্যক্তিরা সাদাকাহ’র কথা বলবে, কারণ তারা সাদাকাহ প্রদানের ফলাফল তাদের মৃত্যুর পর দেখতে পাবে,আর, কারণ, উত্তম কথাও এক ধরণের সাদাকাহ।।।