ক্ষমতার উল্টোপিঠের চিত্র ক্ষমতাশীলরা বেশীরভাগ সময়েই মাথার মধ্যে রাখেন না। অনেকেই বলে থাকেন যে, ক্ষমতার উল্টোপিঠে আছে দূর্ভোগের সীমাহীন যন্ত্রনা আর জনরোষের এক বীভৎস চেহাড়া। অনেক ক্ষেত্রেই এর সত্যতা আছে বটে কিন্তু আমি বলি, ক্ষমতার উল্টোপিঠে দুটু চিত্র সার্বোক্ষনিক বিদ্যমান থাকে। আর সেটা হচ্ছে, ক্ষমতায় অবস্থান করে ক্ষমতাশীনরা যে আনন্দ, যন্ত্রনা, দূদর্শা কিংবা ভোগ বিলাস করেন, সেই ক্ষমতা যদি মানুষের কল্যানকর কাজে ব্যবহৃত হয়, আর মানুষ সেটা বুঝতে পারে তাহলে যখন এইসব ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা যখন আর হাতে থাকে না বা তারা ক্ষমতা হারান, তখন তারা হয়ে উঠেন অত্যান্ত জনপ্রিয় এবং জনসাধারনের চোখের মনি, সম্মানের পাত্র এবং আজীবন তারা মানুষের ভালোবাসায় শিক্ত থাকেন। আবার এর আরেকটা চিত্র আছে-আর সেটা হল যদি এই শাসক গোষ্ঠী যখন একচেটিয়া বর্বর, দুঃশাসন এবং জনগনের না হয়ে নিজেদের এক নায়কতন্ত্রতায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তখন যতো দিন যেতে থাকে মানুশ তত বেশি অসহিস্নু হয়ে এক সময় শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা বিপ্লবে নামে। জনগন জয়ীও হয় এবং শাশক গোষ্ঠির পতন তখন কেউ ঠেকাতে পারে না। এই চিত্রটাই হচ্ছে সেটা যা আমি প্রথমে বলেছিলাম যে, ক্ষমতার উল্টপিঠে থাকে দূর্ভোগ আর সিমাহীন যন্ত্রনা।
আমাদের বাংলাদেশেও এর কোনো ব্যত্যয় দেখিনা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অবধি পতিত শেখ হাসিনার রাজত্বকালে ঠিক এমনি একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। মানুষ সীমাহীন কষ্ট, গোস্যা, রাগ আর ঘৃণা নিয়ে মুখ বন্ধ রেখে তাদের অস্বাভাবিক জীবন যাপন করে গেছে। ভোটের অধিকার না থায়, প্রশাসনে ৪র্থ ধাপ পর্যন্ত দলীয়করন করায়, আইনের শাসন না থাকায়, বাক স্বাধীনতা পুরুপুরি বিলুপ্ত করায় জন সাধারন একেবারে নিষ্পেষিত জীবন জাপন করেছিলো। ছাত্রদের কোটা আন্দোলন হয়তো ছিলো একটা ম্যাচের কাঠি কিন্তু আসল আগুনের উত্তাপ ছিলো মানুষের মনের ভিতর। ফলে একটা কাঠিই যথেষ্ট ছিলো গনরোষের মতো একটা অভ্যুত্থান স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠার। আর ঠিক সেটাই হয়েছে। ৩৫% জন গোষ্টির একটা পলিটিক্যাল দল, শতভাগ এম পি, মিনিষ্টার, স্পিকার সহন এটর্নী জেনারেল, ডেপুটি এটর্নী, পুলিশের আই জি থেকে শুরু করে বাঘা বাঘা আর্মির জেনারেল সহ সচীব, উপসচীব, ভিসি, নেতা পাতিনেতা এক রাতের মধ্যে উধাও। সাথে প্রধান মন্তী, সরকারের আরো বড় বড় হোমরা চোমড়ারাও। যেনো যাদুর কাঠির মতো সব লুকিয়ে গেলো। তারাও জানতেন তাদের এই পরিনতির কথা। তা না হলে এভাবে কেউ উধাও হবেন কেনো?
১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার পরে যে আওয়ামীলীগ এর পরের ২১ বছর কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতায় আসতে পারতেছিলো না, তখন শেখ হাসিনা মাথায় হিজাব দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের কাছে করজোড়ে একটা কথাই বলতে শুনেছি যে, আমাদেরকে আরেকবার একটা সুযোগ দিন, আমরা আবার জনগনের সেবক হয়ে ফিরে আসব। মানুষ ২১ বছর পর শেখা হাসিনার এমন কাতর কথায় বিশ্বাস করে তাকে ভোটের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতায় নিয়ে এসছিলো বটে কিন্তু হাসিনা তার কথা রাখেন নাই। ক্ষমতায় গিয়ে তিনি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী করে ফেললেন যেখানে সব রাষ্ট্রীয় কাঠাম একে একে নিজের কব্জায় নিয়ে এক নায়কতন্ত্র আইনে দেশকে জিম্মি করে ফেললেন। কারো কোনো ব্যাপার নিয়ে তিনি মাথা ঘামালেন না। মানুষ ধোকা খেয়েছিলো। কিন্তু মানুষের আর কিছুই করার ছিলো না। সেই এক নায়কতন্ত্রী শাসন শেষ পর্যন্ত আবারো মানুষকে পুরাতন শাশকদের মতো একই ধাচে জিম্মি করে ফেল্লো।
ফলে এই সময় যখন মানুষ ছাত্রদের কোটা আন্দোলনকে সমর্থন দিতে গিয়ে ‘একদফা এক দাবী, সরকার পতনের দাবী' তুল্লো, তখন শেখা হাসিনার কোনো শক্তিই (ছাত্রলীগ, যুবলীগ, সেনাবাহিনো, বিজিবি, আনসার, পুলিশ কিংবা প্রশাসন) তাকে আর বাচাতে পারেনি। শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
এই যে, পালিয়ে গেলো, তাদের জন্য কি কোনো মানুষ আর সিম্প্যাথিতে থাকবে? সম্মান করার কোনো জায়গায় আছে? একেবারেই নাই। ফলে তারা এবং তাদের সহযোগীরা সারা দেশ থেকে এমনভাবে ঘৃণিত হলো যে, তাদের আবার স্বাভাবিক লাইফে আসতে আগের ২১ বছর নয়, এবার হয়তো ৫০ বছর কিংবা ১০০ বছরও লাগতে পারে। তারা রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে। এগুলির কোন প্রয়োজন ছিলো না। এতো টাকার দরকার ছিলো না তাদের এবং তাদের সহযোগিদের। তারা মানুষের জন্য কাজ করতে পারতো। এখন যেতা হচ্ছে- বিচারপতিদের অন্ডকোষ কেটে দিচ্ছে, মন্ত্রী এম পি দেরকে মানুষ বিবস্ত্র করছে, মাথায় জুতা নিক্ষেপ করছে, ডিম দিয়ে ছুড়ে মারছে, আরো কত কি। তাদের বাসা থেকে হাজার হাজার কটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে। যাদের জন্য এসব করা, ছেলেমেয়ে, নিজেদের জন্য, বউ বাচ্চাদের জন্য তারা কিন্তু এখন কেহই এর ভাগিদার হচ্ছেন না। কোনো আইনজীবীও তাদের পক্ষে ওকালতি করতে নারাজ। মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে তাদেরকে না দেখলে বুঝা যেতো না আল্লাহর কাঠগরা কত কঠিন হবে।
এদের বাকি জীবনটা সম্ভবত এই বিচারের মধ্যেই শেষ হবে। যারা একদিন নরম বিছানা, শত শত আর্দালি নিয়ে রাজকিয় জীবন জাপনে অভ্যস্থ ছিল, এখন থেকে তারা এমন একটা জীবনে ঢোকে গেলেন যেখানে রাস্তার চোর বাটপাররা ধর পড়লে যেমন থাকে তাদের মতো। টাকা কোন কাজেই তাদের লাগল না। কি দরকার ছিল এসবের অদের? পারতো না তারা মানুষের ভালবাসা অর্জন করে বুক ফুলিয়ে সম্মানের সাথে বেচে থাকতে? পারত না তারা এ দেশের মানুষ গুলিকে ভালোবেসে নিজেদের জীবন উতসর্গ করতে? পারতো। কিন্তু সইরাতন্ত্রী মানুষেরা কখনই এই পরবর্তি পর্বের কথা মাথায় রাখে না বলেই যুগে যুগে ফ্রান্স রিভুলিউশন, জার বিপ্লব, কমলা বিপ্লব, আরব বস্নতের মতো বিপ্লব ইত্যাদির ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু শাসকগন ইতিহাস পড়ে না, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।