২৮/০২/২০২১-ত্রিভুজের চতুর্থ কোন

Categories

মানুষ তার জীবনকে সুন্দর আর শান্তিময় করার জন্যই সমাজ সৃষ্টি করেছিলো যা অন্য বেশীরভাগ বুদ্ধি সম্পন্ন প্রানীরা করে না। আর সেই সমাজ চালানোর জন্য কিছু নিয়ম ও তৈরী করা হয়। এই নিয়ম কানুন এইটা ভেবেই করা হয়েছিলো যে, মানুষ একে অপরের সাথে মিলে মিশে সুন্দরভাবে জীবন কাটাতে পারে। একে অপরের সুখ দুঃখের ব্যাপারে এগিয়ে আসে। তাই, সব সমাজই অনেক শর্ত আর নীতির শিকল দিয়ে মানুষের কল্যানের জন্য অনেক প্রকারের সম্পর্কের ভিত তৈরী করে থাকে। জাত, ধর্ম আর বর্নের স্তর গুলি ঠিক রেখেও কিছু কিছু সমাজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে হরেক রকমের এই সম্পর্কের বেড়াজালের শর্ত জূড়ে দিয়েছিলো যাতে সামাজিক নিয়মের মধ্যে সবাই যার যার গন্ডির মধ্যে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে এই সম্পর্কগুলি কিছু কিছু প্রতাপশালী শাসক, ব্যক্তি আর ধর্মজাযকদের প্ররোচনায় তাদের আরাম আয়েশের জন্য, তাদের খায়েস মেটানোর জন্য তারা সুক্ষ থেকে সুক্ষতমভাবে আইন কানুনের কিছু বন্ধন শিথিল করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে গিয়ে প্রথাগুলি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, প্রথা থেকে যায় ঠিকই, রীতি রয়ে যায় ঠিকই কিন্তু যে মানুষগুলির জন্য সম্পর্কের এই ভীত তৈরী করা হয়েছিলো, তারাই বদলে যায়, আর সেই আইনী আর শর্তাবতাবলীর ফাক দিয়ে অনেক সম্পর্কের পরিবর্তিত আদলে মানুষের কল্যান তো দূরে থাকুক, তা কেড়ে নেয় মানুষের সুখ আর জীবনও।

একটা সময় আসে যখন শুধু প্রথার নামে অনেক অশ্লীল আর বেপরোয়া কাজের বৈধতা পায়। এর প্রেক্ষাপটে উদাহরণসরুপ দেখা যায় যেমন বিয়ের প্রথা। বিয়ে নামক প্রথা থেকে মানুষ সরে আসতে আসতে এটা এখন এমন হয়ে গেছে যে, বিয়ের বদলে সহঅবস্থান, সহঅবস্থান থেকে লিভিং টুগেদার, পার্ট টাইম স্টেইং টুগেদার এর মতো প্রথা হয়ে গেছে। এ সবই আসলে টাকা আর লোভের কারনেই হয়। কিন্তু মানুষ সবসময় ভুলে যায় যে, টাকা আর লোভ কোনো সম্পর্ককেরই শক্ত ভীত তৈরী করে না যতোক্ষন এটার মধ্যে সমঝোতা আর শ্রদ্ধাবোধ না থাকে। কিছু মানুষ সম্পর্ক তৈরী করার আগে সবসময় পরিকল্পনা করতে থাকে যে, ভবিষ্যতে তৈরী হওয়া সম্পর্ক থেকে কিভাবে ফায়দা লুটা যায়। এই যে লুকানো একতা লোভ বা বিশ্বাসঘাতকতা, এর আড়ালে যে এফেয়ার্সের জন্ম, কারো কাছে এটা ভালোবাসা আবার কারো কাছে এটা কামনা। আর কারো কাছে এটা একটা চুক্তি। সম্পর্কের দাম যখন টাকার মুল্যে বিচার করা হয়, সেটা একটা ইংগিত যে, এফেয়ার্সের এই গাড়িটা ব্ল্যাক মেইলের লাইনে চলে যাচ্ছে। ভালোবাসার নেশায় কেউ চাদতারা এনে দেয়ার প্রতিশ্রতি দিতে পারে বটে কিন্তু সেই ভালোবাসা বা এফেয়ার্স চাদতারা পাওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা তা খতিয়ে দেখাটা সব পক্ষেরই উচিত। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল আমরা অনেক সময় বুঝেও না বুঝার ভান করি। আবার অনেক সময় বুঝতে চাইলেও বুঝি না। কিন্তু ভুলটা ভুলই। সময়ের স্রোতে এই ভুলটা আমাদেরকে প্রমান করে দেয় যে, আমরা ভুল ছিলাম, এবং বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক আমরা ভুল কাজটাকেই পছন্দ করেছি এবং সেটাই করেছি সম্পর্কের নামের অযুহাতে। অনেক সময় আমরা প্রোফেশনাল আর পার্সোনাল দুটুর সীমাই লংঘন করে ফেলি যখন এই ভুলের মধ্যে থাকি। যখন আমরা এই ভুলটা বুঝতে পারি, তখন অনেক দেরী হয়ে যায় আর কিছু বাকী থাকে না। বাকী থাকে শুধু ভুলের জন্য মাশুলটা। কারন তখন একটা ক্রাইমের সৃষ্টি হয়ে গেছে। ক্রাইম জগতে প্রত্যেক জিনিষের সাথে অন্য জিনিষের লেনদেন থাকে। সত্যিটাকে কখনোই লুকিয়ে রাখা যায় না। সত্য জিনিষটা একটা গন্ধ্যের মতো, এটা বাতাসে বের হয়ই।

এর বাইরে আরো অনেক প্রকারের সম্পর্ক থাকে। কিছু সম্পর্ক ঈশ্বর তৈরী করেন যা রক্তের সম্পর্কের সাথে বাধা থাকে, কিছু সম্পর্ক এই যে একটু আগে বলেছি, সমাজ তৈরী করে যা সমাজের নিয়মের আইন কানুনের শিকলে বাধা থাকে, আর এমনো কিছু সম্পর্ক থাকে যা হৃদয়ের তরীতে সওয়ার হয়ে আকাংখার মাঝ নদীতে সাতার কাটতে থাকে। ঈশ্বর প্রদত্ত সম্পর্কের বেলায় আজো অনেক কিছু যেভাবে চলার কতাহ সেভাবে চলে হয়তো, কিন্তু সমাজ কর্ত্রিক অথবা এই দুই রীতির বাইরে যে সম্নপর্ক গোপনে বা আধা প্রকাশ্যে অথবা প্রকাশ্যেই হোক তৈরী হয় তাদের মধ্যে অনেক কিছুই ধীরে ধীরে খুব ধোঁয়াশা এবং জটিল আকার ধারন করে কারন এই সপর্কগুলি যেখানে খুশী টেনে নেয়া যায়। কখনো তা তীরেও পৌছতে পারে আবার কখনো তা ডুবেও যেতে পারে। তীরে পৌছা অথবা ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনার বেড়াজাল একটা সুপ্ত এঙ্গেল বা কোনের উপর নির্ভরশীল যার নামঃ ত্রিভুজের চতুর্থ কোন।

এই কোন বা এঙ্গেল যেমন দৃশ্যমান থাকে না কিন্তু হিসাবে আনতে হয়। তেমনি এর মান ত্রিভুজের সব কোনের সমষ্টির যোগফলের থেকেও অধিক অথবা শক্তির তৃতীয় সুত্রের মতোই ঋণাত্মকও হতে পারে। এই চতুর্থ কোনের প্রভাব ত্রিভুজের সমষ্টিগত মুল্যায়নে এমন একটা নতুন আদল তৈরী করে যেখানে কবর খুড়ে লাশ বের হয়ে আসা প্রবাদটি পালটে হয়ে যায় কবর খুড়ে লাশ নয়, লাশের ভিতরের কংকালকে বের করে আনা। যেখানে ঐ কংকালের প্রতিটি  হাড়ে লেখা থাকে তার ফেলে আসা অনেক না বলা কথা, বেদনা আর ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের টেবিল অফ কন্টেন্টের প্রথম অধ্যায়েই থাকে রোমাঞ্চকর প্রেমের উপখ্যান। কিন্তু যে প্রেমকে যুগে যুগে মানুষ রক্ত, জল, গোলাপের ঘ্রান হিসাবে আখ্যায়িত করতো, সেই প্রেম আসলে শুরু থেকেই ছিলো একটা কলশির দুধের মতো। দুধকে যেমন বেশী করে আচে বসালে উতলে অর্ধেক হয়ে যায়, তেমনি আবার কম আচে বসালেও সেটা আরো গাঢ় হতে থাকে। এক সময় তা গাঢ় হতে হতে পুড়ে সব শেষ হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই কাহিনীর শেষ অধ্যায়ে প্রথম জীবনের প্রেমের দুধ কাহিনী থেকে তখন সবাই একে একে বের হয়ে যাওয়ার আপ্রান চেষ্টা করলেও সবাই সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। এর প্রধান কারন, যখন কোনো সম্পর্ক ভিতর থেকে ভেংগে যায় কিন্তু ছিড়ে যায় না, তখনি এই দুটু সম্পর্কের পরিভাষাও হয় দুই রকমের। আর এই পরিভাষার নাম; অপরাধের ভাষা।

অপরাধের ছায়া যখন কোনো সম্পর্কের উপর পতিত হয়, পৃথিবীর কোনো শক্তি আর তাকে জোড়া লাগাতে পারেনা।  মনের জ্বালা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে রিভার্স ব্ল্যাক মেইলের মাত্রা। ঈশ্বর মানুষের মনের ভিতরের এই সুপ্ত কাহিনী জানেন, বুঝেন এবং তাকে একটা নির্দিষ্ট লিমিট পর্যন্ত যেতে দেন এই কারনে যদি মনুষত্ত্য কিংবা বাস্তবতার নিরীখে কোনো মানব তার এই রিভার্স ব্ল্যাক মেইল তথা মনের অপরাধের আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে নেয় তো সে হয়তো ডুবতে ডুবতে কিনারায় উঠে যায় কিন্তু যদি সেটা না হয় তার অবস্থা এমন হয় যেনো সে দুটু ফুটূ নৌকায় পা রাখার সামিল। ডোবা তখন গ্যারান্টেড। আজ পর্যন্ত এমন কোনো ডিগ্রী তৈরী হয় নাই যেখানে প্রেমের জ্বালাই বলি আর রিভার্স ব্ল্যাক মেইলই বলি, সেটা নিরুপিত করতে পারে। যখন এই রিভার্স ব্ল্যাক মেইল শুরু হয়, তখন ওখানে হয় অপরাধের পিএইচডি। যখন পিএইচডি শেষ হয়, তখন দেখা যায়, কখন কবে কিভাবে কবরের লাশের কংকাল কোনো এক গাছের সাথে লম্বা হয়ে ঝুলতে আছে। আর যখন কোনো কংকাল নিজে নিজে গাছের সাথে ঝুলতে থাকে, ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের একটুও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই গাছে কংকাল উঠার পিছনে কারো না কারো হাত তো আছে, তার সাথে আছে অনেক রাত জাগা পরিকল্পনাও।

একটা সম্পর্ক যখন গড়ে উঠে, তখন গানিতিক বিশ্লেষনে এর দুটু কম্পোনেন্টই আসলে কাজ করে, একটি হলো “সময়”  আরেক”চাহিদা”। সময় একটা যেমন আপেক্ষিক জিনিষ না হয়েও মানুষের অভিলাষের কাছে এটা আপেক্ষিক, তেমনি চাহিদা নিজেই আমৃতকাল পর্যন্ত একটা পরিবর্তনশীল ফ্যাক্টরই ছিলো। সময়ের নিরিখে কারো উপর যখন কারো লোভ তৈরী হয়, চাহিদার মান ততো বেড়ে যায়, আর এই চাহিদাই সেটা যা মানুষের মৌলিক স্বভাবকে আমূল পরিবর্তন করে ত্রিভুজের চতুর্থ কোনে নিয়ে হাজির করায়, যা কখনো দেখা যায় না।   

সম্পর্কের গ্রাফের এই স্তরে এসে, একটি শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্ক কিংবা পূর্ব থেকে ঈসশরের দেয়া আইন কানুনে বাধা কোনো সম্পর্ক আরেকটা তৃতীয় চরিত্রের ধারায় এমন কিছু রসায়ন তৈরী করে যা জীবনকে শেষ করেই তারপর শেষ হয়ে যায়।  সম্পর্ক যখন ফাপা হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে অনেক দূষিত বাতাস ঢোকে যায়, আর দূষিত বাতাসে অক্সিজেনের অভাবে ভরে থাকে শুধু বিষাক্ত গ্যাস। যা শুধু মরনের কারন হয়। আবার এমনো হতে পারে, সম্পর্কটা প্রথম থেকেই ফাপা থাকে কিন্তু হয় কোনো পক্ষ বুঝে অথবা কোনো পক্ষই টের পায় না। তিলে তিলে এই ফাপা জায়গাটা আরো বড় হয়ে আরো বেশী দূষিত বাতাসের ঘনত্ত বেড়ে যায়। দূষিত বাতাসের ছোয়ায় আর সময়ের অবহেলায় এই সম্পর্ক তখন সিমেন্টের গাথুনীর বধলে আজীবন নরম মাটির মতো নরম ভীতে দাঁড়িয়ে থাকে। যখন কোনো সম্পর্ক নরম মাটি দিয়ে গাথা হয়, তখন এটা ভাংতে বেশী সময় লাগে না। ছোট ছোট ঢেউয়ে খুব তারাতাড়ি ধস নামে।

তখন যেটা হয়, যে, ঈশ্বর কর্ত্রিক প্রদত্ত সম্পর্ক, কিংবা সামাজিক রীতিতে বন্ধন কৃত সম্পর্ক অথবা গোপনে তৈরী ব্যক্তিগত সম্পর্ক বলতে আর কোনো কিছুই ফারাক থাকে না। মান ইজ্জত, অভিলাষ, পজিশন, কিংবা ভালোবাসা, আহলাদ, মায়া কিংবা বন্ধন সব টুটে একেবারে ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে ঐ সমুদ্রে যার গভীরতা মাপার কোনো যন্ত্র আজো মানুষ সৃষ্টি করতে পারে নাই।

এভাবেই চলমান থাকে আইনের কাজ, শাসনের অপব্যবহার আর মনুষত্ত্যের বিলোপ। একদিন এই অবলুপ্তির বিকাসেই মানুষ হারিয়ে ফেলবে তার আসল মনুষত্ত্যের নীতিকথা। প্রতিটি জীবই ধ্বংস হয়ে যাবে নিজেদের কারনে।