Categories
রবী ঠাকুর তার "প্রায়শ্চিত্ত" নামের এক ছোট গল্পে একটা কথা লিখেছিলেন, "স্বর্গ ও মর্তের মাঝখানে একটা অনির্দেশ্য অরাজক স্থান আছে যেখানে ত্রিশঙ্কু রাজা ভাসিয়া বেড়াইতেছেন, যেখানে আকাশ কুসুমের অজস্র আবাদ হইয়া থাকে। সেই বায়ুদূর্গবেষ্টিত মহাদেশের নাম 'হইলে-হইতে পারিত'। যাহারা মহৎ কার্য করিয়া অমরতা লাভ করিয়াছেন তাহারা ধন্য হইয়াছেন, যাহারা সামান্য ক্ষমতা লইয়া সাধারন মানবের মধ্যে সাধারনভাবে সংসারের প্রাত্যাহিক কর্তব্যসাধনে সহায়তা করিতেছেন তাহারাও ধন্য; কিন্তু যাহারা অদৃষ্টের ভ্রমক্রমে হটাত দুয়ের মাঝখানে পড়িয়াছেন তাহাদের আর কোনো উপায় নাই। তাহারা একটা-কিছু হইতে পারিতেন কিন্তু সেই কারনেই তাহাদের পক্ষে কিছু-একটা হওয়া সর্বাপেক্ষা অসম্ভব।
এই কথাগুলির সাথে বর্তমান বিশ্ব মহামারী করোনা পরিস্থিতির একটা মিল রহিয়াছে। অনির্দেশ্য অরাজক স্থানের ত্রিশঙ্কু রাজা আমাদেরকে সেই সর্গ আর মর্তের মাঝে এমন করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন যেখানে কিছু মহৎ মানুষ অন্যের সেবা দান করিয়া অমরতা লাভ করিতেছেন, আবার কিছু নিতান্তই সাধারন মানব তাহাদের সংসারের দায়িত্ত পালন করিয়াও ধন্য হইতেছেন। কিন্তু আমরা যারা না মহৎ মানুষের দলে, না পুরুপুরি সাধারন মানবের দলে, তাহারা অদৃষ্টের ভ্রমক্রমে এই দুইয়ের মাঝে পড়িয়া হাজার খানেক গার্মেন্টস জনগোষ্টিকে লইয়া এমনরুপে হিমসিম খাইতেছি, যে, না এই বিশাল জনগোষ্টি আমাদেরকে দোষারুপ করিতে পারিতেছে, না আবার ক্ষমাও করিতে পারিতেছে, না আমরা কোনো দৈব ক্ষমতায় তাহাদেরকে এইরুপ কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারিতেছি যে, কোনো অসুবিধা নাই, আমরা আছি তোমাদের সাথে। তোমরা আকাশের পানে চাহিয়া, আর আমাদের কথার উপর ভিত্তি করিয়া যাহা নির্দেশ হইতেছে তাহাই করিয়া যাও, কোনো ভয় নাই। সর্বদাই একটা শংকা কাজ করিতেছে মনের ভিতর, মাথার ভিতর আর এই দুই শঙ্কা প্রতিনিয়ত কাবু করিয়া ফেলিতেছে জীবনীশক্তি থেকে শুরু করিয়া আয়ুষ্কালও। চারিদিকে আজ সারা বিশ্ব ব্যাপিয়া করোনা প্রতিটা ব্যক্তি, প্রতিটা সংসার আর গোটা সমাজ জীবনকে এমন করিয়া চাপিয়া ধরিয়া ত্রাসের সৃষ্টি করিয়াছে যে, নীরব শোকের ছায়াতলে সুগভীর সহিষ্ণুতা আর ধরিয়া রাখা যাইতেছে না।
ঢাকা শহরের রাস্তার একটা রুপ আছে। যত্রতত্র যানবাহনের ছড়াছড়ি, যেখানে সেখানে জটলা, হকারদের একচ্ছত্র দৌরাত্ত, পদভ্রজকদের যেনোতেনো হাটাহাটি, ফেরীওয়ার চিৎকার চেচামেচি, জনসমাগম, মিছিল, মিটিং, আরো যে কতকিছু দিয়া ভরপুর থাকে এই শহরের প্রতিটি অলগলি, আনাচে কানাচে। কোথাও দিনেরবেলায়ও অলস লাইটম্যানদের মনভোলার কারনে প্রখর সুর্যালোকেও রাস্তার স্ট্রীট লাইটগুলি আলো দিতে থাকে, উলটা পালটা গাড়ির হর্ন, স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের অবাধ চলাচল ইত্যাদি মিলাইয়া ঢাকার রাস্তাঘাট শুধু সচল নয়, যেনো মহাসচল হইয়া ব্যস্ততায় ভরপুর হইয়া থাকে। অথচ, আজ দুইদিন পর ফ্যাক্টরীর অফিসে আসিবার নিমিত্তে সকাল সাতটার সময় ঘর ছাড়িয়া আমি যেনো আমার সেই চিরাচরিত চেনা ঢাকা শহরকে নিজেই চিনিতে পারিতেছিলাম না। ঢাকার রাস্তার এই নতুন রুপ আমার চোখে আগে কখনো পড়ে নাই। ঈদের ছুটি সমুহের ইহার একটা নমুনা জানিতাম, কিন্তু আজ সেই ঈদের ছুটির সময়ের রাস্তার চেহারাও মলিন হইয়া নতুন এক রুপে আবির্ভুত হইয়াছে।
কোথাও কোনো হকার নাই, ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো পদচারনা নাই, মিটিং মিছিল যেনো উধাও হইয়া কোথায় যেনো স্থবির হইয়া ঝিমাইতেছে, ফেরী ওয়ালাদের সেই চেনা ডাক নাই, কোনো যানবাহনের হর্নও শোনা যাইতেছে না। মাঝে মাঝে বিকট সংকাপূর্ন সুর দিয়া কিছু এম্বুলেন্স অথবা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ফাকা রাস্তা পাইয়া উর্ধগতিতে পাশ কাটিয়া কোথাও হারাইয়া যাইতেছে, আর তারসাথে কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জলপাই কালারের সেনাবাহিনীর গাড়ি অথবা নীল রংগের পুলিশের গাড়ি এদিক সেদিক টহল দিতেছে, অথচ দেশে কোনো যুদ্ধ নাই, কারফিউ নাই, না আছে কোনো জরুরী অবস্থা। মাত্র ২২ মিনিটে অনায়াসেই আমি আমার অফিসে চলিয়া আসিলাম।
বর্তমান পরিস্থিতে যেখানে প্রতিটি পরিবার তাহাদের আপনজনের সুরক্ষায় চিন্তিত, নিজেদের জানমালের সুরক্ষায় চিন্তিত, আর এই সুরক্ষার তাগিদে সবাই ঘরের মধ্যে বন্দি হইয়া আছেন। কেহই মহামারীর আক্রান্ত হইবার ভয়ে ঘর হইতে এক কদম ও বাহির হইতে নারাজ, সেখানে আমরা যারা ঐ অদৃষ্টের ভ্রমক্রমে হাজারখানেক গার্মেন্টস জনগোষ্টির দায়িত্তপ্রাপ্ত হইয়াছি, তাহারা নিজের সুরক্ষার পাশাপাশি, নিজের পরিবারের সুরক্ষা ছাড়াও এই বিশাল জনগোষ্টীর সুরক্ষায়ও চিন্তিত। আমি খুব গর্ববোধ করিতেছি যে, এই কঠিন দূর্যোগের দিনেও যেখানে প্রতিটি সাধারন মানুষ তাহাদের রুটি রোজগার লইয়া মহাচিন্তায় শংকিত, সেখানে অদৃষ্টের ভ্রমক্রমে হাজারখানেক গার্মেন্টস জনগোষ্টির দায়িত্তপ্রাপ্ত হইয়া সমস্ত দুসচিন্তা, সমস্ত দায়ভার নিজের কাধে লইয়া কিছুটা হইলেও তাহাদের রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করিতে পারিতেছি, তাহাদের এই দুঃসময়ে পাশে দাড়াইয়া একটু হইলেও আশার আলো দেখাইতে পারিতেছি, তাহাতেই আমি সুখী এবং খুশী। মহা সংকট ময় এই দিনে যখন সবার ঘরে সুরক্ষায় থাকিবার কথা, আমি এবং আমার মতো অদৃষ্টের ভ্রমক্রমে হাজারখানেক গার্মেন্টস জনগোষ্টির দায়িত্ত প্রাপ্ত মালিকগন এই সব শ্রমিক দের জন্য নিজের সন্তানের মতো, নিজের পরিবারের মতো নিজেদের ক্যাপাসিটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়া কারখানার ভিতরে সুরক্ষার ব্যবস্থা করিবার আপ্রান চেষ্টা করিয়া যাইতেছি। এতোগুলি মানবের জন্য যখন আমাদের প্রান নিয়োজিত, ঈশ্বর নিশ্চয় আমাদেরকে এবং আমার মতো সেইসব অদৃষ্টের ভ্রমক্রমে হাজারখানেক গার্মেন্টস জনগোষ্টির দায়িত্ত প্রাপ্ত মালিকগনকে হেফাজত করিবেন।
ফলে রবী ঠাকুরের সেই কথাগুলি -"যাহারা অদৃষ্টের ভ্রমক্রমে হটাত দুয়ের মাঝখানে পড়িয়াছেন তাহাদের আর কোনো উপায় নাই। তাহারা একটা-কিছু হইতে পারিতেন কিন্তু সেই কারনেই তাহাদের পক্ষে কিছু-একটা হওয়া সর্বাপেক্ষা অসম্ভব" - বলিয়া মনে হইলো না। আমরা হয়তো একটা কিছু হইতে পারিয়াছি। বাকিতা মহান ঈশ্বর জানেন।