২৮/০৪/২০১৯-নতুন ওয়ালেট

আমার ওয়ালেটটা বয়সের ভারে উহার গায়ের ছাল বাকলা উঠিয়া প্রায় জরাজীর্ন হইয়া গিয়াছিলো। নতুন একটা ওয়ালেট কিনি কিনি করিয়াও কেনা হইতেছিলো না। তো, আমার ব্যসায়ীক পার্টনার মূর্তজা ভাই একদিন উহার রুপ দেখিয়া বড়ই কাতরতা অনুভব করিলেন। আর মৃদু মৃদু হাসিয়া কহিলেন, আহা রে আপনার এই ওয়ালেটখানা তাহার কোম্পানী পাইলে উহা তাহাদের আর্কাইভে এন্টিক পিস হিসাবে রাখিয়া দিয়া বলিত, দেখো, আমাদের কোম্পানীর ওয়ালেট এতো জরাজীর্ন হইয়া যাইবার পরেও কাষ্টমারগন তাহা ব্যবহার করিতেই থাকেন। ইহা এতো আরামদায়ক এবং ব্যবহারযোগ্য।"

আমিও কিঞ্চিত হাসিয়া কহিলাম, আজ প্রায় ৫৫ বছর অতিবাহিত করিতেছি, আজ পর্যন্ত নিজে কোনোদিন ওয়ালেট কিনি নাই। ওয়ালেট কোম্পানীর নামও জানি না। ফলে নিজেও বুঝিতে পারি না কোন কোম্পানী ভালো ওয়ালেট বানায় আর কে ঠকায়। সব সময় প্রিয়জনেরাই আমাকে ভালোবাসিয়া, কেউ শ্রদ্ধা করিয়া, ওয়ালেটসমুহ উপহার দিয়া থাকেন। এখন বৃদ্ধ হইয়াছি, বড়রা হারাইয়া যাইতেছেন বলিয়া স্নেহ করিয়া ওয়ালেট দেওয়ার মতো লোক হারাইয়া যাইতেছে, কিন্তু ছোটদের ভালোবাসা ক্রমেই বাড়িতেছে বটে কিন্তু ডিজিটাল যুগে আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওয়ালেটের পরিবর্তে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন বিধায় অনেকেই ওয়ালেট উপহার হিসাবে দেওয়ার কথা মনে রাখেন না। তারপরেও কেহ কেহ আবার উপহার দেওয়ার সময় কি উপহার দেওয়া যাইতে পারে ইহা মাথা খাটাইয়া অনেক সময় ওয়ালেটসমুহ উপহার হিসাবে দিয়া থাকেন। কিন্তু সেইসব অনুজগন এখনো হয়ত আমার ওয়ালেটটির বুড়ো বয়সের খবরটা জানিতে পারেন নাই। ফলে আরেকটি নতুন ওয়ালেটও আমার পকেটে ঢোকিতেছে না। প্রৌড় স্ত্রীর মতোই আমার ওয়ালেটটি সকালে অফিসে যাওয়ার প্রাক্কালে সঙ্গী হইয়া রাতে পকেটে থাকিয়াই নীড়ে প্রবেশ করে।

গতকাল আমার ব্যবসায়ীক পার্টনার এবং আমি একসাথে দুপুরের খাবার খাইতে বসিয়া তাহার সদ্য জার্মানীর ভ্রমন কাহিনী শুনিতেছিলাম। গল্প করিতে করিতে একেবারেই মামুলীভাবে আমার সামনে একটি চমৎকার বক্সের ছোট কি যেনো ধরাইয়া দিলেন। বলিলেন, ভাই, এটা আপনার জন্য কিনিয়াছি। কোনো প্যাকেট দিলে, তাও আবার এই রকমের পার্টনার, যিনি আমার ব্যসায়ীক পার্টনারের থেকে বেশি, আমার পরিবারের সদস্যদের মতো, উহা সাথে সাথে না খুলিয়া আর পারা যায় না। মন সারাক্ষণ অশান্ত হইয়া, চঞ্চল হইয়া ভাবিতে থাকে, কি উহা। না দেখা পর্যন্ত মন না শান্ত হয়, না কৌতূহল নিবারন হয়। যুবতীর বস্ত্র হরনের মতো অতি তাড়াতাড়ি আমি প্যাকেটটি খুলিয়া দেখিতে পাইলাম, আহা, বড় সুন্দর একখানা ব্রান্ডের ওয়ালেট। Mont Blank। খুবই সুন্দর, যেনো উঠতি বয়সের বালিকার গায়ের গন্ধের মতো সুবাস, আর চেহাড়া। টান টান তাহার গতর, ইহার মাঝখানে কপালে টিপ দেওয়ার মতো একটা ছোট তারকা খচিত টিপ। ২ বছরের ওয়ারেন্টি। আবার ইন্স্যুরেন্স করা। কি তাজ্জব ব্যাপার বিদেশীদের। যেখানে আমাদের দেশের মানবকুলের জীবনের নিরাপত্তা নাই, যেখানে যাহাই কিনি তাহাতেই হরেক পদের দূষন জাতীয় জিনিষ দিয়া ভেজালে সমৃদ্ধ, সেখানে বিদেশী কোম্পানীগুলি বাংলাদেশকে অনুসরন না করিয়া নির্ভেজাল জিনিষ বানাইয়া ২ বছরের ওয়ারেন্টি দিয়া আবার তাহার সহিত ইন্স্যুরেন্স পর্যন্ত করিয়া দেয়। আসলে তাহারাই ব্যবসা বুঝিয়া গিয়াছে। তাই আমাদের মতো আমজনতারা ভালো জিনিষ পাইবার জন্য সুদূর বিদেশ গমন করিতে হয়। বাংলাদেশের চামড়া দিয়াই তাহারা তৈরী করিয়া বাংলাদেশেই আবার ব্যবসা করিতে করিতে তাহাদের ব্যাংক ভরিয়া উঠিতেছে। আর এ দেশের ব্যবসায়ীরা ক্রমেই লাটে উঠিয়া দুর্নীতির সমাজ আরো আঁকড়াইয়া ধরিয়া যতটুকুন নীচে তলাইয়া যাইতে পারে তাহারই যেনো প্রতিযোগিতায় নামিয়াছে।

খুবই ভালো লাগিলো। খবই আনন্দিত হইলাম তবে আশ্চর্জ হইলাম না। কারন মাঝে মাঝেই দেশের বাইরে গেলে আমার পার্টনার আমার জন্য নামীদামী ব্রান্ডের কোনো না কোনো উপহার নিয়া আসেন। দাম জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কখনো তাহা ডিস্ক্লোজ করেন না, বরং এমন করিয়া হাসেন যেনো, উহা এমনিতেই বিদেশীরা দিয়া দিয়াছেন। তিনি দাম না জানানোর ব্যাপারে এতোই সচেতন যে, উপহারের গায়ে লিখা স্টিকারটিও খুজিয়া খুজিয়া চিরতরে ধংশ করিয়া দেন। কিন্তু এইবার তিনি বোধহয় দামের স্টীকারটি খুজিয়া না পাইয়া উহা আর সরাইতে পারেন নাই। আমি ওয়ালেট খানা নতুন পীরিতের মানুষের মতো, তাহার গতর, পকেট, আনাচে কানাচে সর্বত্র উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিতে গিয়া কোনো এক গোপন পকেটে দামের স্টীকারটি নজরে পড়িল। "২৩৫ ইউরো"!! এমনিতেই বাহিরে রোদের তাপমাত্রা ছিলো প্রায় ৪১ ডিগ্রী, ঘরে এসি থাকা সত্তেও প্রাইস স্টীকার দেখিয়া প্রথমে মাথা, পরে মন ভনভন করিতে লাগিলো। ওয়ালেটে টাকা রাখিবো কি, এখন দেখিতেছি, ওয়ালেট নিজেই সব টাকা খাইয়া ফেলিতেছে। তাও আবার ফরেন কারেন্সি।যাই হোক, নতুন ওয়ালেটে খুশি হইয়াছি অনেক কিন্তু পরক্ষনেই আমার মনের ভিতরে একটা তীব্র বেদনাও অনুভুত হইলো এই কারনে যে, এতদিনের পুরানো আমার বৃদ্ধ ওয়ালেটটির এখন অবসর গ্রহনের সময় হইয়াছে।

নতুন ওয়ালেটের আগমনে আমার পুরানো ওয়ালেটকে অতি সত্তর জায়গা ছাড়িয়া দিতে হইবে। হয়ত আগামীকাল হইতে তাহার আর কোনো প্রয়োজন হইবে না। এতোদিন যাহাকে আমি প্রতিনিয়ত পকেটে আগলাইয়া রাখিতাম, যে আমার নিত্যসাথী ছিল, যা কিনা আমার গিন্নীর, বা ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনে বুক খুলিয়া তাহাদের সাহায্য করিয়া আনন্দের ভাগ বাড়াইয়া দিতো, আগামিকাল হইতে তাহাকে আর কেহই খুজিবে না। এইকথা ভাবিতে ভাবিতে আমি নতুন এবং পুরাতন উভয় ওয়ালেটকেই পাশাপাশি রাখিয়া কিছুক্ষন স্তব্দ হইয়া নিবিড় চোখে তাকাইয়া রহিলাম। চোখ ভিজিলো কিনা জানি না, তবে মন গলিয়া উঠিলো। ভাবিলাম, আমরাও একদিন নতুনদের ক্রমাগত আগমনে এই সোনালী আকাশ, সবুজ গাছ পালা, সমুদ্রের ঢেউ, আকাশ ভর্তি জোস্নার আলো ছাড়িয়া নতুনদের জায়গা করিয়া দিতে হইবে এবং হয়। তখন আমরাও হয়ত এমন কোথাও অদৃশ্য হইয়া যাইবো। জগত সংসারে ইহা একটি চিরাচরিত নিয়ম। তারপরেও সব পুরানো দিন, পুরানো মানুষ, পুরানো বন্ধু, পুরানো সময় আমাদেরকে আরেক জগতে লইয়া যায়। মন খারাপ হইবে ভাবিয়া আমার পুরানো ওয়ালেটটির ছবি প্রকাশ করিলাম না। তবে নতুন ওয়ালেটটির শুভ কামনায় তাহার কয়েকটি ছবি পোস্ট করিলাম। তাহার যাত্রা শুভ হোক। সবাই তাহার জন্য দোয়া করিবেন যাহাতে তাহার পেট সব সময় ভরা থাকে। অনেক অনেক ধন্যবাদ মুর্তজা ভাইকে। 

 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ওয়ালেটের জন্মদিনে বা পুরানো ওয়ালেটের অবসর গ্রহনের নিমিতে কোনো আকিকা বা ফেয়ারওয়েল কিংবা মিলাদ পড়ানোর সুযোগ নাই। ইহা ধর্মীয় মতে গ্রহনযোগ্য নহে। তবে কেহ সহী হাদিস সাপেক্ষে আবেদন করিলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশে কিছু একটা দোয়া মাহফিল করা যাইতে পারে। এতো খুশী হইবার কোনো কারন দেখিতেছি না। কারন সহী হাদিস পাওয়ার পরে যখন মহামান্য কোর্টের আদেশের জন্য আবেদন করা হইবে, সেই মহামান্য আদালত কতদিন পর মিলাদের সপক্ষে আদেশ প্রদান করেন, তাহা সঠিক বলিতে পারিতেছি না। আর যাই হোক, মহামান্য আদালত অনেক দূর্নীতি, খুন জখমের আর লুটপাটের মামলায় এতো জর্জরীত যে, কোনো কোনো সহী কেসও তাহারা কয়েক যুগে শেষ করিতে অপারগ। ইহা তাহাদের দোষ নয়। তাহার তো আর শুধু কোর্ট লইয়াই ব্যস্ত থাকেন না, তাহাদের শেয়ার মার্কেটে কাজ করিতে হয়, সামাজিক যোগাযোগে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দিনের বেলাতেও ব্যস্ত থাকিতে হয়। যখন হাতে সময় থাকে, তাহাদের তখন বিশ্রামের প্রয়োজন বিধায় ঐটুকু সময়ে তারা রেষ্ট না নিলে কিভাবে মাথা ঠান্ডা রাখিয়া কোর্টে আদেশ প্রদান করিবেন? 

সবাইকে আপাতত  অপেক্ষা করিতে হইবে।