২৮/০৬/২০২০- আমি ফিরে এসেছি আবার

Categories

ঈশ্বর নাই কে বলে? ঈশ্বর আছেন, তিনি অদৃশ্য বটে কিন্তু মানবের সব অন্তরের কথা তিনি শোনেন। রাতজাগা ক্লান্ত পাখীর মতো ভেজা চোখের ক্রন্দনের আরাধনা ঈশ্বর শুনেছেন। আমি ফিরে পেয়েছি আমার সেই পুরানো ঘর, পুরানো জানালা। সেই জানালা দিয়ে আজো সেই আগের বাতাসের গন্ধ আমি পাই। ঘরে যে টিকটিকিটা একদিন দেখেছিলাম, আজ আমার পদচারনায় সেও যেনো অনেক খুশী। ছোট সেই টিকটিকিটা আজ বেশ বড় হয়ে উঠেছে। কতদিন ছিলাম না? মাত্র তো ২৪ টা দিন। কোনো কিছুই তেমন পরিবর্তন হয় নাই, আবার অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার মন পরিবর্তন হয়ে গেছে, আমার দেহ পরিবর্তন হয়ে গেছে, ছোট সেই টিকটিকিটাও বড় হয়ে গেছে। ঘরের কোনায় একটা মাকড়শা জাল বেধেছে। এটা আগে ছিলো না। বাথরুমের মেঝটা একটু ধুলায় কালো হয়ে গেছে। হয়তো অনেক ব্যকটেরিয়ারা তাদের মতো করে বাসা বেধে ফেলেছে। টেপটা ভালো মতো বন্ধ করা হয় নাই বিধায় অবিরত টপটপ করে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ে জায়গাটা কালো হয়ে গেছে। রান্নাঘরের থালা ধোয়ার জায়গাটা শেওলা পড়ে সবুজ হয়ে গেছে। তারপরেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে আমার সবকিছু। ঘরের দেয়ালে হাত দিয়ে আমি বুঝতে পারি ওরাও অনেক খুশি। আমি ফিরে এসেছি এই সেই ঘরে যেথায় আমি কতই না অভিমান করতাম, গুনগুন করে গান গাইতাম। ছোট ছোট পায়ে এঘর থেকে ওঘরে হাটাহাটি করতাম। কি শান্তি আর কি সুখ। আমার চোখ ভিজে যায় আনন্দে। আমার অন্তর বিকশিত হয়ে উঠে সুখে। কি অসাধারন আমার এই ছোট ঘরটি।

এই তো, এখানে বসেই তো আমি চুল আচড়িয়েছি কতদিন। এইতো এই টুলটায় বসে আমি কতদিন আকাশ দেখেছি। যেখানে তাকাই, সব আমার মনে হয় আজ। কত আপন মনে হচ্ছে আজ। যেদিন সকালে আমি এই ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম, বুকের ভিতরে একটা কষ্ট বেধেছিলো, চিনচিন করে ব্যথা লেগেছিলো। ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া যে কত কষ্টের, যে ঘর ছাড়ে নাই, সে কখনো বুঝবে না পরিচিত ঘর কিভাবে নিঃশব্দে কাদে। সেই কান্না আমিও শুনেছিলাম সেদিন। কিন্তু অভিমানের পাল্লা এতো বেশী ছিলো যে, ঘরের নিঃশব্দ কান্না আমার অন্তরের অভিমানের কাছে হেরে গিয়েছিলো। আজ আমি ফিরে এসেছি। সমস্ত ঘরটা যেনো ফিকফিক করে হেসে উঠলো। এটা আমার ঘর। এই ঘরের প্রতিটি বাতাসে মিশে আছে আমার নিঃশ্বাস, মিশে আছে আমার আকাশের পায়ের ধুলো। ওর শরীরের গন্ধ। আমি চোখ বুঝে নিঃশ্বাস নিলেই যেনো ওর গায়ের গন্ধ পাই। কি অদ্ভুদ না?

ছলনার ফল ভালো হয় না। কিন্তু আমি তো ছলনা করি নাই।  যে আমার সাথে ছলনা করেছিলো, যে আমাকে ঘর ছাড়া করেছিলো, যে আমাকে আমার অতীব চেনা এই ঘর থেকে বের করেছিলো, আজ তার ঘর নাই। আজ সে নিজের ছলনায় নিজেই আটকে গেছে। স্ত্রী জাতীরাই আসলে স্ত্রীজাতীর চরম শত্রু। আর এ জন্যেই এক স্ত্রীর ঘর ভাংগে আরেক স্ত্রী জাতীর কারনে। পুরুষ সব সময়ই উদাসীন। তাকে ধরে রাখতে হয়। তার হাত ছাড়তে হয় না। আমি ওর হাত ছেড়ে বুঝেছিলাম, আরেকটা হাত আমার মনের মতো নাও হতে পারে। সেই হাত, সেই আংগুল, সেই হাতের ছোয়া আমার ফেলে যাওয়া হাতের মতো নাও হতে পারে। আমি এই উপলব্দিটা বুঝেছিলাম সেই রাতেই যেদিন আমি আমার আকাশ থেকে ছিটকে পড়েছিলাম। সেদিন বুঝেছি যেদিন রাতে আমি ঘন কালো আকাশ দেখে ভয় পেয়েছিলাম। আমি তো এই কালো আকাশকে চাই নাই। আমি চেয়েছিলাম জোস্নাভরা নীল আকাশ।

আজ আমার ঘরের সেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের ওই নীল আকাশটাকে দেখছি। ফুরফুরা বাতাস আমার জানালায় ঢোকছে আর আমাকে শীতল করে দিচ্ছে। কতদিন এই নির্মল বাতাস আমার এই ঘরে যে প্রবেশ করে নাই কে জানে। আজ বাতাসেরাও আনন্দিত। অফুরন্ত বাতাস। বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মধ্যে কত যে আনন্দ। আমি জানালায় দাঁড়িয়ে আমার আকাশের পানে ওর ভালোবাসার গন্ধ পাচ্ছি।

ঈশ্বর আমাকে আবারো ফিরিয়ে এনেছে আমার সেই পরিচিত ঘরে যেখান থেকে আমি একবার ঝরে পড়েছিলাম, আজ আবারো আমার বাগানে আমি মালী হিসাবেই ফিরে এসেছি। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দেয়ালকে বললাম, জানো দেয়াল, আমি আমার এই দূর্বল শরীর তোমার গায়ে হেলান দিয়ে আবার দাড়াতে চাই, তুমি আমাকে ধরে রেখো। আমি সেই টপটপ করে ফোটায় ফোটায় পানি পরা টেপটাকে বললাম, আমি আবার ফিরে এসেছি, এবার আর তোমাকে ফোটা ফোটা অশ্রু বিসর্জনে কাদতে দেবো না। তুমি আমাকে গরমে শীতল করো আর আমাকে পরিশুদ্ধ করো। আমি আমার সেই পরিচিত রান্নাঘরের চুলাটার কাছে গিয়ে বললাম, যে আগুনে আমি এতোদিন পূরেছি, আজ বুঝতে পারি, তুমি কতোটা আগুনে পূড়ে আমাকে অন্ন দাও, সুমিষ্ট খাবার দাও। আমি আবারো তোমাকে আমার আদরের হাত দিয়ে দিয়ে ভরে দেবো। খাটের কোনায় বসে আমি ভাবী আর ভাবী, এই পুরু সংসারটা আমার। এই সংসারে আছে টিকটিকি, আছে বাতাস, আছে জানালা, আছে রাতের জ্যোৎস্না। আর আছে আমার ভালোবাসা আকাশের জন্য।

আমি আর কখনো আকাশকে ছেরে কোথাও যাবো না।